মাহবুব আলম  ::

সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের পূর্নাঙ্গ কমিটি ঘটন নিয়ে জেলা সভাপতি আলহাজ্ব মতিউর রহমান ও সাধারন সম্পাদক ব্যারিষ্টার এম,এনামূল কবীর ইমন দীর্ঘ পৌনে দুই বছরেও ঐক্যমতে পৌছাতে পারেননি। পুর্নাঙ্গ কমিটি গঠন নিয়ে আলোচনা  মধ্যখানে স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর আবার এ নিয়ে  নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানাগেছে। এবার কমিটি পুর্নাঙ্গ হওয়ার আভাস মিলছে। এনিয়ে রোববার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্মসম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ এমপি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন (সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত) দফায় দফায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নেতাকর্মীরা বলছেন, সময় লাগলেও এবার কমিটি পূর্ণাঙ্গ গঠন হবে। প্রায় ২০ বছর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সম্পাদক দিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যক্রম। পরবর্তীতে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হলেও গ্রুপিং বিভক্তির কারনে প্রায় পৌনে দুই বছর ধরে চলছে দুই সদস্য দিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি। ২০১৬ সালের ২৫ ফ্রেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের দুই সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনের প্রায় ১০ মাস দুই পদের (সভাপতি ও সম্পাদক) সমন্বয় থাকলেও গত প্রায় ৮ মাস হতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে বিরাজ করছে দ্বন্দ্ব।

মুলত গত ২৮ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান দলীয় মনোনিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যরিস্টার এনামুল কবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রুপ নেয়। এরপর থেকে সুনামগঞ্জের ৫ সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত নারী আসনসহ) ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন একপক্ষে এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট আরেক পক্ষ হয়ে কাজ করছেন। এই দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়েছে জেলার প্রায় সব কয়টি সাংগঠনিক ইউনিটে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগও দ্বিধাবিভক্ত। সভাপতি আবুল কালাম মতিউর রহমানের বলয়ের সঙ্গে কাজ করেন। সম্পাদক মোবারক হোসেন আছেন ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমনের বলয়ে। সুনামগঞ্জ পৌরসভা আওয়ামী লীগের কমিটি দুটি। তাহিরপুরের আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন খান এবং সাধারণ সম্পাদক অমল কর। এখানে প্রকাশ্যে আলাদা আলাদা মিছিল-সমাবেশ না হলেও সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি আলী মর্তুজা, আলকাছ উদ্দিন খন্দকার, জালাল উদ্দিন এবং মোশারফ আলম স্থানীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ঘনিষ্টজন হিসাবে পরিচিত এবং আবুল হোসেন খান এবং অমল কর মতিউর রহমানের ঘনিষ্ট হিসাবে পরিচিত।

ছাতক উপজেলায় আবরু মিয়া তালুকদারকে আহ্বায়ক করে করা কমিটির নেতৃত্বে মতিউর রহমান এবং স্থানীয় পৌর মেয়র আবুল কালাম সমর্থকরা কার্যক্রম চালান। অন্যদিকে, ছানাউর রহমান ছানাকে আহ্বায়ক করে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক ও ব্যারিস্টার ইমন সমর্থকরা কার্যক্রম চালায়। ছাতক পৌরসভায় একাংশের (কালাম সমর্থক) সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শাহাব উদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক মৃদুল কান্তি দাস মিন্টু। অন্যদিকে, এই পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াহিদ মজনুও দাবি করেন তিনি পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন, পরে আর কমিটি হয়নি।দোয়ারাবাজার উপজেলায়ও কমিটি দুটি। সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক এবং ব্যারিস্টার ইমন এখানে ইদ্রিছ আলী বীরপ্রতীককে আহ্বায়ক বললে মতিউর রহমান এই উপজেলায় ফরিদ আহমদ তারেককে আহ্বায়ক বলে দাবি করেন। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগেও একই অবস্থা। এই উপজেলার সভাপতি বেনজির আহমদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার বর্মণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই জনের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেন। এই উপজেলার যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনগুলো মতিউর রহমান ও ব্যারিস্টার ইমনকে ঘিরে বিভক্ত। মধ্যনগর থানায় বলা হয়ে থাকে শতকরা ৮৫ ভাগই আওয়ামী লীগের ভোটার। থানার ৪ ইউনিয়নের ৩ টিতেই আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যান। দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে একটিতে কেবল আওয়ামী লীগ হেরেছে। অথচ. এই থানায় আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি দু’টি। দুই কমিটির নেতৃবৃন্দই নিজেদের বৈধ দাবী করেন।

২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক (মতিউর রহমান এবং নুরুল হুদা মুকুট) মধ্যনগর থানা আওয়ামী লীগের কমিটি বিলুপ্ত করে দলীয় নেতা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্মআহ্বায়ক গিয়াস উদ্দিন নূরীকে আহ্বায়ক, পরিতোষ সরকার, মোবারক হোসেন ও জামাল হোসেনকে যুগ্মআহ্বায়ক করে ৪১ সদস্যের কমিটি করে দেন। একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর আবার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পুরাতন কমিটি স্থগিত করে ধর্মপাশার সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সদ্য প্রয়াত আব্দুল আউয়ালকে আহ্বায়ক, নিপেন্দ্র রায়, প্রভাকর তালুকদার পান্না, আব্দুল খালেক, আলমগীর খসরু, প্রবীর বিজয় তালুকদার, ও মনোরঞ্জন তালুকদারকে যুগ্মআহ্বায়ক করে ১১ সদস্যের থানা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করে দেয়। এখন দুই কমিটিই নিজেদের থানা কমিটি দাবি করছে।

ধর্মপাশায় স্থানীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন সভাপতি এবং শামীম আহমদ বিলকিস সাধারণ সম্পাদক। এই উপজেলায় দলীয় কর্মসূচী আলাদা না হলেও সহ-সভাপতি আলমগীর কবির এবং আরেক সহসভাপতি ফখরুল ইসলাম এই বলয়ের সঙ্গে নেই। এরা মতিউর রহমানের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেন।জামালগঞ্জে অবশ্য সভাপতি মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক নবী হোসেন সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এবং মতিউর রহমানের বলয় দুটোর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেন বলে দলের নেতা কর্মীরা জানিয়েছেন। দিরাইয়ে আছাব উদ্দিন সর্দার সভাপতি এবং প্রদীপ রায় সাধারণ সম্পাদক। এরা সংসদ সদস্য ড. জয়া সেন গুপ্তা এবং ব্যারিস্টার ইমনের বলয়ের হিসাবে পরিচিত। এই উপজেলার সাবেক সভাপতি আলতাব উদ্দিন স্থানীয়ভাবে মতিউর রহমানের ঘনিষ্টজন হিসাবে পরিচিত। তাঁর নেতৃত্বে কয়েকজন নেতা কর্মী গত ৩০ মার্চ দিরাই-শাল্লা’র উপ-নির্বাচনে প্রকাশে দলীয় প্রার্থী’র বিরোধিতা করেন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হেকিম মতিউর রহমান বলয়ের রাজনীতিরি সঙ্গে যুক্ত। সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান স্থানীয় সংসদ সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান এবং ব্যারিস্টার ইমনের সমর্থক। জগন্নাথপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকমল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রিজু। জগন্নাথপুর পৌরসভায় সভাপতি ডা. আব্দুল আহাদ এবং সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন ভুইয়া। এরা ৪ জনই স্থানীয়ভাবে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি এবং ব্যারিস্টার ইমনের সমর্থক। তবে জগন্নাথপুর পৌরসভার মেয়র উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল মনাফের নেতৃত্বে একটি অংশের সঙ্গে মতিউর রহমানের যোগাযোগ রয়েছে। এরা স্থানীয়ভাবে আজিজুস সামাদ ডনের (প্রয়াত জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের ছেলে) অনুসারী।

জানা যায়, পুর্বে মতিউর রহমান ও ব্যারিস্টার ইমন নিজেদের মধ্যে কয়েকদফা বৈঠকে বসলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এসব নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করেন। কয়েকজন আবার দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও বৈঠক করেন। এদিকে, গত কয়েকদিন ধরেই আবার আলোচনায় আসে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের বিষয়টি। এর অংশ হিসেবে রোববার সকালে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম. এনামুল কবির ইমন দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের কারওয়ান বাজারের ব্যক্তিগত অফিসে বৈঠক করেন। রাতে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেনের সঙ্গে আবারো বৈঠক করেন এই দুই নেতা। দুই বৈঠকেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন নিয়ে কথাবার্তা হয়। তবে সুনামগঞ্জের দুই নেতা কমিটি নিয়ে একমত হতে পেরেছেন কিনা জানা যায়নি। ঢাকায় অবস্থান করা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, মতিউর রহমান ও ব্যারিস্টার ইমনের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রথমে কেন্দ্রীয় মাহবুবুল হক হানিফ ও আহমেদ হোসেনের কাছে যাবে। পরে তা দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেয়া হবে। তিনিই সব সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হতে কিছু সময় লাগবে।
উল্লেখ্য দীর্ঘ ১৮ বছর পর ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মতিউর রহমানকে সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা মুকুটকে বাদ দিয়ে তৎকালীন জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn