মন্তব্য প্রতিবেদনঃ মুকুটের বক্তব্য জেলার রাজনীতিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
ইমানুজ্জামান মহীঃ-সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জনাব আলহাজ্ব নুরুল হুদা মুকুটের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার সুনামগঞ্জ জেলার রাজনৈতিক মহলে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইছে। সাক্ষাৎকারের ভিডিও অনেকে ইনবক্সে আমাকে পাঠিয়েছেন। অনেকে আবার ফোন করে মন্তব্য জানতে চেয়েছেন। ব্যস্ততার কারনে ফেসবুকে যাওয়া হয়না। রাজনীতিবিদদের কর্মকান্ডে ইদানিং কিছুটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। আগের মতো নিউজ পর্টালে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখতে পারিনা।
জেলা সভাপতি মুকুটের এই ৮মিনিট ৮ সেকেন্ডের ভিডিও সাক্ষাৎকারটি নানা কারনে জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্ব বহন করে। বক্তব্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে আলোচনা করতে বাধ্য হলাম। জেলা আওয়ামী রাজনীতির অবিভাবক হিসাবে মুকুটের অসংলগ্ন বক্তব্য আমাকে পীড়া দিয়েছে। আমি নিশ্চিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী অনেককে তার এ বক্তব্য আহত করেছে।
মুকুটের ভিডিও সাক্ষাতকার দুই দিনে প্রায় ৬১ হাজার ভিউ হয়েছে। শেয়ার হয়েছে চার শতের উপরে। সে অনুপাতে কমেণ্ট ও লাইক খুব নগন্য । এর কয়েকটি কারন। কমেন্ট করে কেউ বিরাগভাজন হতে চান না। কেউ আবার রাজনীতির মারপ্যাচ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ভালো বাসেন। অনেকে বিপদ এড়িয়ে চলেন। কমেন্টের চেয়ে শেয়ার অত্যাধিক হয়েছে । কারন হচ্ছে একাধিক শেয়ার। নিজ টাইম লাইনে শেয়ার না করে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে শেয়ার করা হয়েছে ম্যাসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে। সবাই গোপনে মজা নিতে আগ্রহী। দশজনের উপর আমার ম্যাসেঞ্জারে শেয়ার করেছেন। স্থানিয় এক সাংবাদিকের ইটিউব চ্যানেলে সাম্প্রতিক সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়াম্যান নির্বাচন নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে জেলা সভাপতির মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে বেফাঁস মন্তব্যের কারনে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে এবং ভিউ হয়েছে প্রচুর। একজন দক্ষ রাজনীতিবিদের অরাজনৈতিক সুলভ বক্তব্য শুনে আমার মতো অনেকে অবাক হয়েছেন।
মুকুট বরাবর বেফাঁস কথা বলে আলোচনায় থাকতে চান। এর আগে তিনি দক্ষিন সুনামগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে বলেছিলেন, পরিকল্পনা মন্ত্রী এম,এ মান্নান আজিজুস সামাদ ডনের জয় চিনিয়ে নিয়েছেন। মান্নান সাহেবের নৌকা ১০ হাজার ভোটে ডনের ফুটবলের কাছে প্রকৃত পক্ষে পরাজিত হয়েছিল। মিডিয়া কু’র মাধ্যমে মান্নান সাহেব ডনের জয় হাইজ্যাক করেছেন। মুকুটের সে বক্তব্য তখন আলোচনায় আসে। দলের নেতা হয়ে তিনি বিরুধী দলের নেতার মতো মন্তব্য করেন। তার মন্তব্য দলকে বিব্রতকরে। জেলার রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও কেন্দ্র কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পরবর্তিতে এক জনসভায় মুকুট বলেন, সুনামগঞ্জ ১ তাহিরপুর ও ধর্মপাশা আসনের সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ২ কোটি টাকার বিনিময়ে নৌকার নমিনেশন কিনেন। সে সময় আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডকে তিনি অভিযুক্ত করার দৃষ্টতা দেখান। দলের মনোনয়ন বোর্ডের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও কেন্দ্র তখন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবার প্রয়োজন মনে করেনি। মুকুট দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি থাকাকালীন সাবেক জেলা আওয়ামীলীগ সাধারন সম্পাদক ব্যারিষ্টার ইনামূল কবীর ইমন বঙ্গবন্ধু খুনী মেজর পাশার ভাগিনা বলে প্রকাশ্য জনসভায় মিথ্যাচার করেন। ব্যারিষ্টার ইমন মুকুটের বিরুদ্ধে এ নিয়ে মানহানির মামলা করেন। সে মামলার ফলোআপ জানা যায়নি।
মুকুট স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে সময়ে অসময়ে নানা কটূক্তি করে পার পেয়ে গেছেন। বর্ষীয়ান নেতা সাবেক জেলা সভাপতি মতিউর রহমান ও সুনামগঞ্জ ৫ ছাতক ও দোয়ারাবাজার আসনের বর্তমান এমপি মহিবুর রহমান মানিক বিগত ইউপি নির্বাচনে যৌথ ভাবে কোটিকোটি টাকা মনোনয়ন বানিজ্য করছেন বলে মুকুট অভিযোগ করেন। মানিক মনোনয়ন বানিজ্যের সে টাকা মতিউর রহমান আমেরিকা থেকে ফেরার পর বিমানবন্দরে গিয়ে পৌছে দিয়েছেন বলে জানান। প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেন। সেনগুপ্ত মুকুটের অনেক পরে আওয়ামীলীগার হয়েছেন। সুরঞ্জিতের চেয়ে তিনি বড় আওয়ামী লীগার দাবী করেন। লণ্ডন সফরে এসে মুকুট বলেন, আমি ২ বার দলের বিরুদ্ধে বিদ্রাহী প্রার্থী হয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হয়েছি। নেত্রী দলে আমার প্রয়োজন আছে মনে করে এর পরও আমাকে জেলা সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছেন।
সম্প্রতি মুকুট জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক তার সহোদর খায়রুল হুদা চপল সুনামগঞ্জ জেলা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। প্রতিক্রিয়ায় তিনি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক নোমান বক্ত পলিন। জাতীয় পার্টির মনোনীত সাবেক সাংসদ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। সুনামগঞ্জ পৌর সভার মেয়র জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি নাদের বক্ত ও সাবেক জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক, বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি্র বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। মুকুটকে স্থানীয় সাংবাদিক মাসুম হেলাল উপজেলা নির্বাচনে তার ছোট ভাই জয়ী হওয়ায় তার অনুভুতি কি ? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার কোন অনুভুতি নেই।” ছোট ভাইয়ের জয়ের ব্যাপারে তিনি অনুভুতিহীন। তবে তিনি অনুভুতিহীন হলেও জেলা কমিটির সম্পাদক ও সহ-সাভাপতিদের ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি যা বলেন, তার অর্থ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, জেলা আওয়ামীলীগের সম্পাদকের পরিবার স্বাধীনতার পক্ষের বা আওয়ামীলীগ পরিবার দাবী করলেও তারা সকল সময় আওয়ামীলীগের বিপক্ষে ছিল। আগামী পৌরসভার নির্বাচনে কি ভাবে তাদের পরিবার থেকে মেয়র নির্বাচিত হয় তিনি তা দেখে নেবেন বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। নির্বাচনে ব্যারিষ্টার ইমন চপলের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। শহরের মাইজবাড়ী এলাকায় প্রতিদ্ধন্ধি প্রার্থী ফজলে রাব্বি স্মরনের আনারস প্রতীকের পক্ষে ইমনকে প্রচারনায় দেখা গেছে। ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠ ও উস্মা প্রকাশ করে মুকুট ইমনকে নান্দনিক নেতা উল্লেখ করে বলেন, আমি তাকে নিবৃত করতে গিয়েছি। পাইনি। অপর দিকে জাতীয়পার্টির মনোনীত সাবেক সাংসদ ফজলুর রহমান মিসবাহ মনিষ কান্তি মিন্টুর ঘোড়া প্রতীকের পক্ষালম্বন করেন। মুকুট মিসবাহ সম্বন্ধে বলেন, সাংসদ হবার আগে মিসবাহ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতো। এখন সে কোটিকোটি টাকার মালিক।
সদর উপজেলার সদ্য নির্বাচিত চেয়ারমান এর বড় ভাই মুকুটের বক্তব্যে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত কেউ আনুষ্টানিক প্রতিবাদ জানাননি। কানাঘোষা আছে প্রত্যেকের কিছুনা কিছু দূর্বলাতা আছে। মুকুটের কাছে সবার আমল নামা আছে। যার কারনে এদের কেউ মুকুটকে ঘাটাতে চান না। ভয় কেঁচো খুঁড়তে যদি সাপ বেড়িয়ে আসে। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ ৪ সুনামগঞ্জ উত্তর ও বিশ্বম্ভরপুর আসনের জাতীয়পার্টির সাংসদের বিরুদ্ধে কোটিকোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার যে মারত্মক অভিযোগ মুকুট করেছেন ৩ দিন বিগত হলেও সে ব্যাপারে সাবেক সাংসদ মিসবাহের কাছ থেকে কোন প্রতিবাদ না হওয়ায় অনেকে অভিযোগের সত্যতা ও মিথ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছেন। রাজনৈতিক সচেতন মহল মনে করছেন, দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসাবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতির এমন অভিযোগ হেলাফেলার নয়। নিশ্চয় তিনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন। কেউ কেউ বলছেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের অভিযোগ আমলে নিয়ে দুর্ণীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্ব-প্রণোদিত হয়ে তদন্ত স্বাপেক্ষে অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখা উচিত।
মিসবাহের সমর্থকরা বলছেন, দশ বছর সাংসদের দায়িত্ব পালনকালে মিসবাহ এর স্বচ্ছতা ও সততা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। আজকে মুকুটের ভাইয়ের পক্ষালম্বন না করায় ক্ষোভে মুকুট এসব কথা বলছেন। মুকুটকে তারা অকৃতজ্ঞ বলে উল্লেখ করে বলেন, বিগত সদর উপজেলা নির্বাচনে চপল নৌকার প্রার্থী না হলে আজ সে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে পারতো না। চপলের নৌকার প্রতিক পাবার পিছনের কারিগড় ছিলেন মিসবাহ এর বড় ভাই জাতীয় সাংবাদিক প্রয়াত পীর হাবীব। নৌকা পাবার পিছনে তার বড় একটা হাত ছিলো। সময়ে তিনি আজ তা ভুলে গেছেন। অপরদিকে সুনামগঞ্জ পৌর মেয়রের ঘনিষ্টজনরা মিসবাহ এর সমর্থকদের সাথে সুর মিলিয়ে একই কথা বলছেন। তাদের মতে বর্তমান মেয়রের বড় ভাই প্রয়াত পৌর মেয়র আয়ূব বখত জগলু না হলে মুকুট প্রথমবার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে পারতেন না। জগলুর একান্ত প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে মুকুট নির্বাচিত হন। মুকুটের প্রতিদ্ধন্ধী প্রার্থী জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক ব্যারিষ্টার ইমনকে রাজনৈতিক ভাবে কোনঠাসা করার জন্য সে সময় জগলু তার রাজনৈতিক শত্রু মুকুটের সাথে হাতমেলান। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুকুট জগলুর কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করেন। বিপুল ভোটে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মুকুটের সাম্প্রতিক বক্তব্য রাজনৈতিক ভাবে তার দেওলিয়াত্ব প্রমান করে। অনেকে মনে করেন দলের কাছে মুকুটের আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। দল তাকে অনেক দিয়েছে। এখন দল তাকে না চাইলে কিছু যায় আসেনা। নানা সময়ে বিতর্কিত বক্তব্য রাখায় আগামীতে মুকুটের রাজনৈতিক ভবিষ্যত তাকে কোথায় নিয়ে যায় সেটা এখন দেখার বিষয়।