মন্ত্রিসভায় এবং আ’লীগে বড় ধরনের রদবদল দরকার-গাফ্ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী–
ভালোই তো চলছিল দেশ। উন্নয়নের রথের চাকার ছাপ পড়ছিল সমাজের প্রতিটি স্তরে। সর্বত্রই প্রশংসিত হচ্ছিল অর্থনীতির গতিশীলতা। হঠাত্ যেন ঈশান কোণে কালো মেঘের আবির্ভাব। ‘দৈনিক ইত্তেফাকের’ গত ২৪ জুলাইয়ের প্রথম পাতার প্রথম খবরটিতেই বলা হয়েছে, “দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। শিল্প উদ্যোক্তারা উদ্বিগ্ন”।
খবরের বিস্তারিত বয়ানে বলা হয়েছে, “ঢাকার আশেপাশের শিল্প কারখানাগুলোতে দেখা গেছে, দিনে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। সাভার, গাজীপুর ও আশেপাশের শিল্প-উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে নিরবচ্ছিন্ন উত্পাদন সম্ভব হচ্ছে না। তাতে পণ্যের মান খারাপ হচ্ছে এবং সময়মতো রপ্তানি করাও যাচ্ছে না। সম্প্রতি জ্বালানি সংকট এতটাই তীব্র হয়েছে যে, কারখানা চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।”
পত্রিকাটির খবরে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলীর মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, “এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে উত্পাদনমুখী খাতে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে। তাতে ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই এবং ব্যাংকের ঋণ খেলাপিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে এখন পর্যন্ত যে তারল্য রয়েছে, তা বিনিয়োগ হচ্ছে না। তার মূল কারণ সুদের হার বেশি এবং পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সুবিধার অভাব।” গার্মেন্টস উত্পাদক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেছেন, “বিদ্যুৎ সংকট এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্টান্ডবাই জেনারেটর টানা দু’তিন ঘণ্টার বেশি চালানো যায় না। তাও উত্পাদনে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে সঠিক সময়ে পণ্য বায়ারদের কাছে পৌঁছানো যায় না।”
খবরটি পাঠ করলে বোঝা যায়, উত্পাদনমুখী দেশটিতে উত্পাদন নিম্নমুখী হয়েছে। রফতানি-বাণিজ্যে তার ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে যাচ্ছে। এই ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত কতটা সজাগ তা আমি জানি না। অন্তত চলতি আর্থিক বছরের বাজেটে তার কোনো প্রমাণ দেখি না। দেশের একজন শিল্প উদ্যোক্তা কামরুল ইসলাম বলেছেন, “গ্যাস-বিদ্যুত্ সংকটের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাজেটে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে জ্বালানির অভাবে শিল্প চালাতে না পারলে তার দায়ভার কার?” এই প্রশ্নের জবাব, এই দায়ভার তো অর্থমন্ত্রীর অনেকটাই বটে।
বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের সুদের হার খুবই বেশি। জানা যায়, বিশ্বের আর কোনো দেশে সুদের হার এত উচ্চ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান ব্যাংকের তারল্য বৃদ্ধি এবং শিল্পখাতে প্রদত্ত ঋণের হারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় যে নীতিটি গ্রহণ করেছিলেন, সেটি এখন অনুসৃত হয় কিনা আমি জানি না। তবে এটুকু জানি, সরকারের এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, বিদ্যুৎ উত্পাদন এত বাড়ানো সত্ত্বেও এই যে বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট তার একটি প্রধান কারণ, যেখানে চালু কলকারখানাগুলোই গ্যাসের অভাবে বন্ধ হওয়ার মুখে সেখানে নতুন করে গ্যাস-সংযোগ দেওয়া এবং অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার হিড়িক। সরকার এবং তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ যে অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করতে পারছেন না তার কারণ, সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে।
দেশে শুধু বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট নয়, আরও বহু সংকট ঘনিয়ে এসেছে। এ যেন হঠাত্ নীলাকাশে কালো মেঘের আবির্ভাব। উন্নয়নের রথে চড়ে সরকার যখন তরতর করে এগিয়ে চলেছেন একটি সাধারণ নির্বাচনের দিকে এবং আশা করছেন আবার দেশ শাসনে দেশের মানুষের ম্যান্ডেট লাভের, তখন একটি নয়, একটির পর একটি সংকটের আবির্ভাব অবশ্যই সকলের জন্য শঙ্কার কারণ। এই সংকট মোচনে সরকারের সক্ষমতার উপরে শুধু সরকারের নয়, দেশের ভবিষ্যত্ও নির্ভর করছে।
কে জানত এ সময়ে হঠাৎ পার্বত্য এলাকায় মাটির পাহাড়ে ধস নেমে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হবে, আশ্রয়হীন মানুষের সমস্যা থেকে সংকট সৃষ্টি হবে। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দেশের জরুরি স্বার্থে বিদেশ-গমন সমালোচিত হবে। বিএনপি সুযোগ পেয়ে এটাকে একটা ইস্যু করার চেষ্টা চালাবে। দেশে হঠাত্ বন্যা দেখা দেবে এবং তা চরম আকার ধারণ করবে। বন্যায় শুধু মানুষ ভাসবে না, গবাদিপশু এবং ক্ষেতের ফসল ধ্বংস হয়ে দেশে খাদ্য সংকট (যে সংকট সম্পূর্ণ দূর করা হয়েছিল) সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করবে। একই সঙ্গে জলবন্দি হাওরবাসীর সমস্যা প্রবল হয়ে দেখা দেবে। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকবে। বিদেশে উদ্বৃত্ত খাদ্য রফতানির গৌরব অর্জনের পর সরকারকে আবার খাদ্য আমদানির কথা ভাবতে হবে।
যেকোনো বড় সমস্যা মোকাবিলায় শেখ হাসিনার সাহস ও দক্ষতা অতুলনীয়। বিডিআর বিদ্রোহ থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের হুমকি ইত্যাদি মোকাবিলায় তার এই সাহস ও দক্ষতা তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এক বিশিষ্ট আসনে বসিয়েছে। কিন্তু এবারের সমস্যা ও সংকটগুলো বহুমুখী এবং জটিল। শুধু অর্থনৈতিক পর্যায়েই নয়, রাজনৈতিক পর্যায়েও সংকটগুলো বড় রকমের মুখব্যাদান করেছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ভাস্কর্য এবং হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক নিয়ে বড় রকমের বিতর্ক শুরু হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তা হয়নি। তবে সেকুলারিস্ট শিবিরে সৃষ্ট বিভ্রান্তি রয়ে গেছে।
এই বিভ্রান্তির ঘোর কাটতে না কাটতেই একশ্রেণির জামায়াতী এবং তাদের সন্তান-সন্ততির আওয়ামী লীগে যোগদানের ব্যাপারে বিরাট বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং সাধারণ সম্পাদক দু’জনেই এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। তাদের বক্তব্যে যুক্তিও রয়েছে। কিন্তু যুক্তি ও ভাবাবেগের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য আছে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতার শত্রু জামায়াতের বিরুদ্ধে দেশবাসীর এক বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে এখনো যে প্রচণ্ড ভাবাবেগ রয়ে গেছে, যুক্তি দিয়ে সেই ভাবাবেগ অদূর ভবিষ্যতেও দূর করা যাবে না। ইউরোপে নাসরা যুদ্ধাপরাধ করেছিল অর্ধশতাব্দীরও বহু আগে। কিন্তু শুধু ইউরোপে নয়, সারা বিশ্বে এখনো নাস এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের বিরুদ্ধেও জনমত প্রবল। নাস যুদ্ধাপরাধীদের এখনো তল্লাশ ও বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের নেতাদের সন্তান-সন্ততির সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কটির উত্তাপ কমতে না কমতেই আরও বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়। এই রায় যথার্থই সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। বিচারকদের বদলি ও অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্ট না সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকবে এই প্রশ্নটি উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর উদাহরণ অনুসরণ করে সহজেই মীমাংসা করা যেত। এ ক্ষেত্রে আমার ধারণা, বর্তমান আইনমন্ত্রীর ভূমিকা সমস্যাটিকে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে বিরোধে পরিণত করেছে।
আমি যা খবর পেয়েছি, তাতে মনে হয়, আইনমন্ত্রী রাজনৈতিক বিবেচনা দ্বারা চালিত না হয়ে আমলাদের বুদ্ধি দ্বারা চালিত হয়েছেন। আমলারা কখনোই দেশের শাসন ব্যবস্থার কোনো স্তরে তাদের ঔপনিবেশিক আমলের আধিপত্য হ্রাস করতে চায় না। এখনো তারা জুডিসিয়ারির উপর তাদের খবরদারি অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায় যা-ই হোক, তা সরকারের জন্য তেমন বিব্রতকর নয়; কিন্তু বিব্রতকর হলো দেশের বর্তমান অবস্থা এবং সরকার ও পার্লামেন্ট সম্পর্কে প্রধান বিচারপতির অবজারভেসন বা পর্যবেক্ষণ।
এই পর্যবেক্ষণ মূল রায়ের অন্তর্ভুক্ত নয়, তথাপি ঢাকার ইংরেজি দৈনিক স্টার এমনভাবে পর্যবেক্ষণটি প্রকাশ করেছে যে, যাতে মনে হতে পারে পর্যবেক্ষণটি রায়ের অংশ। এটা অপসাংবাদিকতা। কিন্তু এই অপসাংবাদিকতার সুযোগ নিয়েই বিএনপি সরকারের পদত্যাগ দাবি করার সাহস পেয়েছে। আমি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং মাননীয় প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে এখানে আলোচনায় যাচ্ছি না।
এই পর্যবেক্ষণগুলোই সরকারের জন্য দারুণ বিব্রতকর। এই বিব্রতকর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের নাজুক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করার জন্য অগণতান্ত্রিক ও অশুভ মহল যদি তত্পর হয়, তাহলে বিচার বিভাগও বিপন্ন হবে। আমরা কি আইয়ুবের আমলে বিচারপতি মুর্শেদ এবং এরশাদের আমলে বিচারপতি কেএম সোবহানের অবস্থার কথা জানি না? বর্তমান প্রধান বিচারপতি অত্যন্ত সাহসী ও স্বাধীনচেতা মানুষ। তিনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কথা বলুন, এটাই তার কাছে আমার সবিনয় নিবেদন।
বিচার বিভাগের সঙ্গে মনোমালিন্য বর্তমান সরকারের সামনে একটা বড় সংকট। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক সংকট। আগেই বলেছি, নানা সমস্যায় বহুমুখী চাপের ভেতরে রয়েছে সরকার। ঢাকায় দুই ছাত্রীকে হোটেলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ, শ্রমিক লীগের এক নেতার ছাত্রী ধর্ষণ এবং ধর্ষিতা ও তার মাথার চুল কেটে দিয়ে তাদের দু’জনের উপর বর্বর নির্যাতন, ছাত্রলীগ সভাপতির বিশাল বাড়ি ভাড়া করা নিয়ে তার দলের ভেতরেই কোন্দল, আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও কোন্দল ও সংঘাত, সাংগঠনিক দুর্বলতা বর্তমান সরকারকে এক চরম চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এই বহুমুখী সংকটের চাপ থেকে সরকার যদি নিজেকে মুক্ত করতে না পারে, তা হলে খালেদা-তারেককে লন্ডনে বসে ষড়যন্ত্র পাকাতে হবে না, দেশের মাটিতেই এই ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষ দ্রুত মাথা তুলবে।
আমার একটাই আশা, শেখ হাসিনা অতীতে অনেক বড় বড় সংকট তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা ও সাহস দ্বারা অতিক্রম করেছেন। এখনকার বহুমুখী চাপ ও সংকট থেকেও তিনি তাঁর সরকার ও দেশকে মুক্ত করতে সক্ষম হবেন। তাঁর মন্ত্রিসভায় এবং সংগঠনে একটা বড় ধরনের রদবদল অবিলম্বে দরকার।