আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিগগিরই রদবদল হতে যাচ্ছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ একাধিক মন্ত্রী আসন্ন রদবদলে ছিটকে পড়তে পারেন। এর মাধ্যমে সরকারকে আরও গতিশীল করতে চায় শাসক দলটি। এ ছাড়া কিছু মন্ত্রীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে দলের ক্ষুন্য হওয়া ইমেজ ২০১৯ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পুনরুদ্ধার করাও এ রদবদলের আরেকটি উদ্দেশ্য। সব মিলিয়ে এক ডজন মন্ত্রীর নাম বাদের তালিকায় রেখেছে দলটি। দপ্তর বদলের তালিকায়ও আছেন কয়েকজন। অন্তর্ভুক্তির তালিকায় নবীনদের চেয়ে সাবেক মন্ত্রীদের এগিয়ে রাখছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার কর্মকা- বিবেচনায় এনে পুনরায় মন্ত্রিসভা সাজানোর কাজ করছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, সব ঠিক থাকলে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সরকারের চলমান মন্ত্রিসভায় রদবদল হতে পারে। আর জাতীয় পার্টির (জাপা) তিন মন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্ত হলে আগামী জুনে বাজেট পেশের পর পরই মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আসতে পারে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে বলেছেন, মন্ত্রিপরিষদে পরিবর্তন আসবে। বহুদিন হলো মন্ত্রিপরিষদে রদবদল হয় না। তবে কারা আসবেন, এটা শুধু প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন। কে কে হতে পারেন মন্ত্রিপরিষদের নতুন সদস্যÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি এখন বলা সম্ভব নয়। আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখতে পাবেন।
দ্বিতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি শপথ নেয়। মন্ত্রিসভায় ২৯ মন্ত্রী, ১৭ প্রতিমন্ত্রী ও ২ উপমন্ত্রী আছেন। প্রথম দফায় মন্ত্রিসভার কলেবর বৃদ্ধি পায় ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। এ দফায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এএইচ মাহমুদ আলী ও নজরুল ইসলাম। পরের বছর ১৪ জুলাই মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করা হয়।

ওই দিন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন নুরুল ইসলাম বিএসসি। পদোন্নতি পেয়ে মন্ত্রী হন ইয়াফেস ওসমান ও আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন অ্যাডভোকেট তারানা হালিম ও নুরুজ্জামান আহমেদ। দুদিন পর দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর থেকে এ পর্যন্ত মন্ত্রিসভায় আর কোনো রদবদল বা অন্তর্ভুক্তি হয়নি। এর পৌনে দুই বছর পর সম্প্রতি আবার মন্ত্রিসভা রদবদলের কথা শোনা যাচ্ছে। সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মন্ত্রিসভার আসন্ন রদবদলে এক ডজন মন্ত্রী বাদ পড়তে পারেন। তাদের আমলনামা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর হস্তগত হয়েছে। অনেক আগে থেকেই এসব মন্ত্রীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

মন্ত্রী হওয়ার পর এলাকায় ক্যাডার বাহিনী গঠন, নিয়োগবাণিজ্য, দখলবাণিজ্যসহ নানা অপকর্মে দল ও সরকারকে বিতর্কিত করা, স্থানীয় আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, জাতিগত বিভেদ উসকে দেওয়ার অভিযোগ ওঠা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এ তালিকায় যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম রয়েছেন। তালিকায় বৃহত্তর ঢাকার দুই প্রভাবশালী মন্ত্রীও আছেন বলে জানা গেছে। এ দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা ও সংবিধান নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় মামলা হয়। মামলায় জরিমানা ও নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করে সে যাত্রায় রক্ষা পেলেও মন্ত্রিসভা রদবদলের জেরে কপাল পুড়তে পারে এ দুজনের।

জাতীয় পার্টির তিনজন মন্ত্রী অব্যাহতি পেতে পারেন। জাতীয় পার্টির পদত্যাগ সিদ্ধান্ত ও আগামী নির্বাচনে বৃহৎ পরিসরে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ করে দিতেই এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। সরকারে থাকা জাতীয় পার্টির এই তিনজন মন্ত্রী হলেন পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নু এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মো. মশিউর রহমান রাঙ্গা।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছায়েদুল হকের বর্তমান বয়স ৭৫ বছর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় দায়সারা আচরণের জন্য ব্যাপক বিতর্কিত ও সমালোচিত তিনি। সে ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়কে গালি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এতে করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় সমালোচনার তীব্র ঝড় ওঠে, মন্ত্রীর পদত্যাগ নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন তখন মানববন্ধন করে। কিছু দিন আগে এলাকায় তার আগমন ঠেকাতে হরতালের ডাক দেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ।

অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে ২৯ বছরের টগবগে যুবক এখন ৭৫ পেরিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। মন্ত্রণালয়ে উপস্থিতিও অনিয়মিত। নিজ নির্বাচনী এলাকায়ও তেমন একটা যান না। কয়েকবার হেলিকপ্টারযোগে নিজ এলাকা ময়মনসিংহে গিয়েছেন। এ ছাড়া নিজ জেলার আওয়ামী লীগে দলীয় বলয় সৃষ্টির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মুহা. ইমাজউদ্দিন প্রামাণিকের বর্তমান বয়স ৭৬ বছর। আওয়ামী লীগের জন্য নিবেদিত ও নওগাঁ-৪ আসন থেকে পাঁচবার নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য শেষবেলার এই মূল্যায়নে পিছিয়ে আছেন। সামছুর রহমান শরীফ। পাবনা-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে চারবার এমপি নির্বাচিত হন। দলে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বতর্মান আওয়ামী লীগ সরকার ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়। স্কুল বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘক্ষণ রাজপথে দাঁড় করিয়ে রেখে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেন তিনি। এ ছাড়া এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।

অনুষ্ঠানের ব্যানারে নিজের নাম না থাকায় নিজ মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিবের কক্ষ ভাঙচুর ও আরেক সিনিয়র সহকারী সচিবের কক্ষে তালা দেন নেত্রকোনা-২ আসনের এমপি এবং যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। এরও আগে আদম পাচারের অভিযোগ উঠেছিল জয়ের বিরুদ্ধে। নিজ এলাকায় এ উপমন্ত্রীর ভাইদের আধিপত্যে কোণঠাসা দলীয় নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকর্মী এবং পুলিশ পেটানোর অভিযোগও আছে।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে জানা গেছে, মন্ত্রিসভায় রদবদলের ক্ষেত্রে নবীন ও সাংগঠনিক দায়িত্ব নেইÑ এমন নেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও সরকারের এ মেয়াদের অবশিষ্ট সময়ের জন্য অভিজ্ঞ মন্ত্রীদেরই আনা হচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা বলেন, এত অল্প সময়ে অনভিজ্ঞদের দায়িত্ব দিয়ে আগামী নির্বাচনে তার রেশ টানতে চান না প্রধানমন্ত্রী। সামনের পৌনে দুই বছরে সরকারের সাফল্যের ওপর একাদশ নির্বাচনে প্রভাব পড়বে এই ধারণা থেকেই প্রবীণদের অগ্রাধিকার দেওয়ার চিন্তা করছে দলটি।

সে হিসেবে মন্ত্রিসভায় রদবদল হলে সেখানে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুুর রাজ্জাক, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব) ফারুক খান, দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন অগ্রাধিকার পাবেন। এর বাইরে তুণমূল থেকে দলে নিবেদিতপ্রাণ এমন ২ জন নেতাকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করার কথাও ভাবছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের পদ থেকে দুজন মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সরকার গঠনের প্রাক্কালে তালিকায় নাম থেকেও বাদ পড়া একজন সাংগঠনিক সম্পাদক এবার মন্ত্রী হচ্ছেন বলে সরকারের ও দলের শীর্ষ কয়েকজনের কাছে শোনা যাচ্ছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn