এই ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন অনেকেই
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলঙ্গা থানার হাটিকুমরুল ইউনিয়নের নবরত্ন মন্দিরের গেটে ঝোলানো মসজিদের একটি দানবাক্সের ছবি ফেসবুকে শেয়ারের কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ফের কারাগারে গেছেন সুনামগঞ্জের শালার ঝুমন দাশ আপন। ঝুমন এই ছবি ফেসবুকে শেয়ার করায় একে ‘উসকানিমূলক পোস্ট’ বলে তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। এরআগে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার পর গত বছরের মার্চে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ঝুমন। ছয় মাস কারাগারে থাকার পর গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান। এর ১১ মাস পর আবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার মুখে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেলেন ঝুমন। ৩০ আগস্ট ফেসবুকে ছবি শেয়ারের কারণে বাড়ি থেকে ঝুমনকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর রাতে পুলিশ বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাকে গ্রেপ্তার দেখায়।
ঝুমনের ব্যাপারে শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ঝুমনের এই স্ট্যাটাস শেয়ারের পর এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে স্বীকার করে সে নিজ ইচ্ছায় এই কাজ করেছে। তখন এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হামলার উত্তেজনা সৃষ্টির দায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় তাকে আমরা গ্রেপ্তার করি। এবার যে পোস্টটি শেয়ার দিয়ে ‘সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়ার’ অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন ঝুমন দাশ সেই দানবাক্স সরানো হয়েছে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির এখন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে মন্দিরটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘রামনাথ ভাদুড়ী মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর আমলে (১৭০৪ থেকে ১৭২৮ খ্রিষ্টাব্দ) এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। হিন্দু স্থাপত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন কারুকার্যমণ্ডিত নবরত্ন মন্দিরটি তিনতলা। এই মন্দিরে ছিল পোড়ামাটির ফলকসমৃদ্ধ ৯টি চূড়া। এ জন্য এটিকে নবরত্ন মন্দির বলা হতো।’ মন্দিরটি সম্পর্কে আরও বলা হয়, ‘দিনাজপুর জেলার কান্তজীউ মন্দিরের অনুকরণে গঠিত এই মন্দিরের আয়তন ৬৫.২৪ বাই ৬৫.২৪। বর্গাকার মন্দিরটি প্রায় ২ ফুট প্ল্যাটফরমের ওপর তৈরি। মন্দিরের মূল কক্ষটি বেশ বড়। চারদিকের দেয়ালের বাইরের চারপাশে পোড়ামাটির ফলক দিয়ে সাজানো ছিল। পরে কালের বিবর্তনে প্রাকৃতিক আর মানুষের অবহেলায় সংস্কারের অভাবে সব নষ্ট হলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মন্দিরটি অধিগ্রহণ এবং নতুন করে এর সংস্কার করে।’
নবরত্ন মন্দিরের গেটে পাশের একটি মসজিদের দানবাক্সের ছবিটি তোলা হয় গত ২৮ আগস্ট। ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পরদিনই স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে সেটি সরিয়ে ফেলা হয়। এই ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেন সুনামগঞ্জের ঝুমন দাশ আপন। মন্দিরের গেটে মসজিদের দানবাক্সের ছবি ঝোলানো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। এরপর তিনি ফেসবুক থেকে সেই ছবি সরিয়েও নেন।এদিকে, যে দানবাক্স নিয়ে এত ঘটনা সেই দানবাক্স সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মসজিদ কমিটির সভাপতি রঞ্জু আলম দাবি করছেন, তারা মন্দিরের গেটে দানবাক্স ঝোলাননি; ‘অজ্ঞাতপরিচয় লোকজন’ এ কাজ করেছে। তিনি বলেন, মসজিদ আমাদের গ্রামের, ওইটার নির্মাণকাজ করতেছি, ভাঙা মসজিদ। নবরত্ন মন্দিরের সামনে একটা খুঁটির সঙ্গে দানবাক্স লাগানো ছিল। হয়তো কোনো গাড়ির সঙ্গে লেগে খুঁটিটা ভেঙে গেছিল, পরে কারা জানি ওই মন্দিরের লোহার গেটের সঙ্গে নিয়ে ঝুলিয়ে রাখছিল।
ফেসবুকে ছবি ভাইরাল হওয়ার পর দানবাক্সটি সরিয়ে নেয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, পরদিনই আমাদের লোকাল থানার স্যার বলল, রঞ্জু ওখানে কী হইছে? পরে স্যার নিজে গিয়ে দেখছে ওখানে আর নাই। কেউ রাখছিল হয়তো এক দিনের জন্য, পরে সরায়ে দোকানের সামনে নিয়ে আবার রাখছে। আমি অবশ্য সেদিন ওইখানে ছিলাম না। তাই আমিও দেখি নাই। তবে মসজিদ কমিটির সহকারী সেক্রেটারি রুবেল আহমেদ জানান, দানবাক্সটি তাদের উদ্যোগেই প্রায় দুই মাস আগে ঝোলানো হয়। কোরবানি ঈদের দুই দিন আগে আমরা এটা লাগাইছিলাম। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিয়েই লাগাইছি। ওরা তো এটা নিয়ে কিছু বলে নাই। মন্দিরের কেয়ারটেকারকে (প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের) বলার পর দুই দিন সময় নিয়ে সে জানাইছে, ‘ঠিক আছে লাগাও।’ হিন্দুদের কেউ তো বাধা দেয় নাই।
এদিকে, নবরত্ন মন্দিরের গেটে মসজিদের দানবাক্স ঝোলাতে অনুমতি বা সম্মতি দেয়ার তথ্য এখন অস্বীকার করছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়োজিত কর্মী মোহাব্বত আলী। তিনি বলেন, এই দানবাক্স তো ওই মসজিদের লোকজন আর হিন্দুরা মিলেই লাগাইছে। আমি তো জানতাম না, এসে দেখি লাগানো। পরে আমি সরাইতে বললে ওরা বলে, ‘লাগাইছি তো কী হইছে?’ ওই হিন্দু লোকজনও আসছে। ওদের এক উকিল, সে আর কয়েকজন হিন্দু এসে বলতেছে, ‘আমাদের সামনেই লাগাইছে বাক্স, তো কী হইছে, আমাদের তো কোনো সমস্যা নাই।’ সলঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কাদের জিলানী বলেন, ফেসবুকে ছবিটি দেখামাত্র আমি মন্দিরের পাহারাদারকে কল দেই। সে বলল, ‘আমি দেখে জানাচ্ছি।’ এর মধ্যে আমি নিজেই সেখানে গেছি। গিয়ে দেখছি, ওটা ওখানে নেই। মানে ছবিতে দেখা গেছে যে মন্দিরের বাইরে গ্রিলে লাগানো, সেখানে সেটা নেই। হয়তো কেউ সরিয়ে ফেলছে।
উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজ্জল হোসেন বলেন, নবরত্ন মন্দিরের গ্রিলে মসজিদের দানবাক্স লাগানোর খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম, তবে গ্রিলে কোনো বক্স পাইনি। তার আগেই নাকি সেটা খুলে নেয়া হয়েছে।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১০৩ বার