মমিনুল মউজদীন : ‘তুমিহীন, দিন…’
উজ্জ্বল মেহদী-
‘জানালাটা খুলতেই শীতের সোনালী ভোর আমার গ্রীবায়
দু’বাহু জড়িয়ে বলে, নেই, সে তো নেই
নিঃশব্দ আকাশ বলে, নেই
পাতাঝরা শাখা বলে, নেই
রোদের চিকন ছায়া, সেও বলে, নেই…’
…
কবিতার নাম ‘তুমিহীন, দিন’।কবি মমিনুল মউজদীন। এ শহর ছেড়ে পালাবো কোথায় কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা। আজ ১৫ নভেম্বর, তাঁর এ কবিতার মতোই একটি দিন। ১০ বছর আগে, ২০০৭ সালের এই দিন শীতের সোনালী ভোর নয়, ছিল মেঘলা আকাশ। দক্ষিনাঞ্চলে বইছিল দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। পূর্বাভাস ছিল ঝড়ের। রাতে নেমেছিল ‘সিডর’। তছনছ করে দিয়েছিল মানুষ, বসতি আর প্রকৃতি। উত্তরপূর্বাঞ্চলের সিলেটে সিডর হয়ে এসেছিল একটি দুর্ঘটনা। কবি মমিনুল মউজদীন সপরিবারে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ ফেরার পথে ব্রাম্মণবাড়িয়ার সরাইলে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী তাহেরা চৌধুরী, ছোট ছেলে কহলিল জিব্রানসহ ঘটনাস্থলে নিহত হন। সঙ্গে থাকা বড় ছেলে ফিদেল নাহিয়ান গুরুতর আহত হন। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা সিডরের মতোই। দক্ষিণাঞ্চলের মতো শোক-কাতরতায় অাপ্লুত হওয়ার মতো দিন আজ। অন্য এক সিডর।
আমার হাত ধরে একটি অসাধারণ উদ্যোগ প্রকাশ পেয়েছিল। ‘আসমান ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে’ শিরোনামের সেই জোছনাবাদ উপাখ্যান। ১৯৯৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হওয়া ভোরের কাগজ-এর মেলার (তখন ভোরের কাগজে ছিলাম) সেই প্রধান ফিচারটি মমিনুল মউজদীনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। জোছনাবাদ-এর আরেক অনুঘটক ছিলেন শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী। অথচ, একই সাল, একই সময়, একজনের পর একজন করে তাঁরা দুজন অকালেই পাড়ি দিলেন। মৃত্যুর পরপরই প্রবাসী সাংবাদিক আ স ম মাসুম একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিল। তিন মিনিটের সেই তথ্যচিত্র ৩০০ মিনিট কাঁদিয়েছিল। ইউটিউবে আছে। আজও দেখলাম। সেই একই অনুভূতি! মৃত্যুর পর প্রথম জন্মবার্ষিকীতে (২০০৮ সালের ২৯ আগষ্ট) লিখেছিলাম ‘দিনটি ছিল তাঁর শুধু কবিতার’। আর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে (২০০৮ সালের ১৫ নভেম্বর) ‘অন্য এক সিডর’। দুটো লেখা শুধু প্রথম আলোতেই ছাপা হয়েছিল। এরপর চারদিক থেকে লেখার তাড়না, বছর ঘুরে দিনক্ষণ হিসেব কষে একই তাগাদা। বারকয়েক চেষ্টা করেও পারিনি। আমি নতশিরে না বলেছি। সাধ্য ছিল না। সঙ্গত কারণে কবিতায় ডুব দেই, মেলে স্তস্তিও।
চৈতন্য প্রকাশনের কর্ণধার রাজীব চৌধুরী ইতিমধ্যে আদায় করে নিয়েছে ‘নির্বাচিত কবিতা’ সংকলন (যৌথ সম্পাদনা : আমি ও খলিল রহমান)। ধ্রুব এষের প্রচ্ছদে এ বছরই বাজারে এসেছে। কাটছে সময়, কেটে গেছে এক দশক।মনে হলে এখনো ছবির মতো চোখে ভাসে সব। মানুষ তো মমি করে রাখার নয়, তাই বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাঁর সৃষ্টি কবিতা। সুদীর্ঘ শোক-কাতরতা কাটানোর মোক্ষম হাতিয়ার কবিতা। একেকটি কবিতা যেন তাঁর সরব উপস্থিতি, কিংবা চিরবিদায় পরবর্তী দৃশ্যপট। অকালপ্রয়াণের ১০ বছরে সিলেটের ঐতিহ্যবাসী নাট্যসংগঠন দর্পণ থিয়েটার আয়োজন করেছে মমিনুল মউজদীনের কবিতা অনুষ্ঠানের। কবিতা থেকে তাঁরা অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘তুমিহীন, দিন…।’
শোকে চুপসে নয়, ঘুরে দাঁড়াতেই কবির অকালপ্রয়াণের এক দশকের আজ এই দিন শেষে সন্ধ্যা ছয়টায় সিলেটের কিনব্রিজের পাশে সারদা হলের তৃতীয় তলায় (সম্মিলিত নাট্য পরিষদের মহড়াকক্ষে) জলসার মতো আয়োজন-তুমিহীন দিন-এ। কবিতা আবৃত্তি করবেন সিলেটের শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকারদের কয়েকজন।