মাইকে আযান দিয়ে টাংগুয়ার হাওরে মাছ ধরা বন্ধ করা হবে – জেলা প্রশাসক
আল-হেলাল:: সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোঃ সাবিরুল ইসলাম বলেছেন,সুনামগঞ্জে মোট ১০৭৬টা জলমহাল আছে যেগুলো বিভিন্নভাবে ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানে সেইসব ইজারাভোগীরা উপস্থিত থাকলে এই হল কানায় কানায় ভরে যেতো তিল ধারনের ঠাই থাকতোনা। এ থেকে প্রমাণিত হয় জেলার জলমহালগুলো প্রকৃত মৎস্যজীবিদের হাতে নেই। বিগত ২১ মে তারিখে যোগদানের পর থেকে আমি ছাতক ধর্মপাশা দোয়ারা শাল্লা ও জামালগঞ্জসহ প্রতিটা এলাকায় যাচ্ছি রাত্রিযাপন করছি। সব জায়গায় কিন্তু হাওর জলাশয় পুকুর সব পাচ্ছি। তারপর জামালগঞ্জের একটা বাজারে গেলাম টিআর কাবিখার কাজ ভিজিট করতে। সেখানকার বাজারে ঢুকে দেখি ফূলবাড়িয়া,ভালুকা ও ত্রিশালের পাঙ্গাস মাছ বিক্রয় হচ্ছে। তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। মনে হয় মাছের দেশ সুনামগঞ্জের নামকরনটা বাধ দিয়ে দিতে হবে। এ লজ্জাটি আসলে কার? আমি চাকরী করেছি ফুলবাড়িয়ায় সেখানে দেখেছি একটা জমিতে তিনটা ফসল ফলানোর পাশাপাশি মানুষ বাড়ীর পাশের কৃষিজমিকেও মৎস্য চাষের আওতায় এনে মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে স্বাবলম্বি হচ্ছে। ধানের দাম কম হওয়ায় জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে তারা মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অথচ সুনামগঞ্জ যেখানে অবিরত বৃষ্টি পানি জলরাশি আছে,সেখানে ডোবা নদী পানি বৃষ্টি হাওর বাওর সারাক্ষণ সবকিছু থাকা স্বত্তেও আজ সেই জায়গার মানুষ অন্য জেলার মাছ কিনে খান।
বুধবার সকালে শহরের শহীদ আবুল হোসেন মিলনায়তনে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০১৭ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি একথা বলেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক ড. জাহিদ হেসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শংকর রঞ্জন দাশ। বক্তব্য রাখেন জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ আশুতোষ দাস,মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ অফিসার ডাঃ বেলাল হোসেন,বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান,জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী নুরুল মোমেন,অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাবেরা আক্তার,অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার হেলাল উদ্দিন ভূইয়া, জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডাঃ মোজাম্মেল হক, হ্যাচারী কর্মকর্তা অশোক কুমার দাস, সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মোস্তফা মিয়া, জরীপ কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা অরুন কুমার দে,আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি সাংবাদিক আল-হেলাল,মৎস্যজীবি লীগের তৌহিদ হোসেন বাবু,মৎস্যজীবি সংগঠনের প্রতিনিধি আলাউর রহমান,মৎস্যচাষী জহুর মিয়া প্রমুখ। এর আগে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০১৭ উপলক্ষে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জেলা স্কাউট ও সরকারী কলেজের রোভার স্কাউট এর বাদক দলসহ ব্যানার ফেষ্টুন সহযোগে এক বর্ণাঢ্য র্যালী বের করা হয়। র্যালিটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে শহীদ আবুল হোসেন মিলনায়তন হলের সভাস্থলে এসে মিলিত হয়। জেলা প্রশাসক মোঃ সাবিরুল ইসলাম স্থানীয় জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন রিভারভিউ হতে সুরমা নদীতে রুই জাতীয় মাছের পোনা অবমুক্তির মাধ্যমে কর্মসুচির শুভ সুচনা করেন। সভা চলাকালে সাংবাদিক বাউল আল-হেলাল গানের স¤্রাট বাউল কামাল পাশা রচিত“দেশে আইলো নতুন পানি ঘুচে গেল পেরেশানী/মাছের বাড়লো আমদানী দু:খ নাইরে আর” গানটি পরিবেশন করে সমবেতদের মধ্যে সাড়া জাগিয়ে তুলেন।
জামালগঞ্জের মাছ বাজার পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম বলেন,আমার সেদিনই মনে হচ্ছে আমাদের মৎস্যজীবিরা কি করেন ? মৎস্য বিভাগ কি কাজ করে ? যারা বড় বড় বক্তব্য দিতে পারেন তাদের কাজটাই বা কি ? আমি কিন্তু কথার চাইতে কাজ করার ব্যাপারে অধিক আগ্রহী। আপনারা হয়তো ইতিমধ্যে জেনেছেন আমরা বোমা মেশিন বন্ধ করে দিয়েছি। টোকেনের বিনিময়ে মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরার অধিকার অনুমতি দিতে হবে বলে দাবী উঠেছে। আপনারা জেনে থাকবেন প্রত্যেক উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বলে দেয়া হয়েছে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে হাওর বাওর জলাশয়ের এলাকা চিহ্নিত করে দেওয়ার জন্য। যাতে ইজারা এলাকার বাইরে কোন ইজারাদার না যেতে পারে। ইজারাদার যদি ইজারা এলাকার বাইরে না যায় তাহলে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরতে অসুবিধা কোথায়। আমরা কোনক্রমেই ইজারা চুক্তি লঙ্গিত হতে দেয়া হবেনা। শুধু জলমহালই নয় বালিমহাল ও পাথর মহালের এলাকা পর্যন্ত ডিমার্কেশন করে দেওয়া হয়েছে যাতে নির্ধারিত সীমানার বাইরে কোথায়ও কেউ যেতে না পারে।
উন্নয়ন স্কীমের আওতায় ভাগিয়ে নেয়া জলমহালগুলোর ব্যাপারে তিনি বলেন,আইনে উল্লেখ আছে প্রথম বছর মাছের পোনা ও রেনু চাড়বেন,পরের বছরে হিজল তমাল করছ গাছ লাগাতে হবে। কিন্তু কোন ইজারাদার সমিতি বা কারা গাছ লগিয়েছে আর কারা লাগায়নি সে ব্যাপারে কেউ কোন কথা বলেননি। জেলা প্রশাসন,মৎস্য বিভাগ ছাড়াও আমি মনে করি এসব ব্যাপারে মৎস্যচাষী,মৎস্যজীবি,মুক্তিযোদ্ধা,রাজনীতিবিদ,ব্যবসায়ী,পেশাজীবি এবং এনজিও সকলেরই দায়বদ্ধতা আছে। দায়িত্ব নিতে গেলে হয়তো কারো স্বার্থে আঘাত লাগতে পারে। স্বার্থে আঘাত লাগলে স্বার্থান্বেষী মহল কারো উপর ক্ষুন্ন হতে পারে। কিন্তু দেশের স্বার্থে এলাকা ও সমাজের স্বার্থে দায়বদ্ধতা নিতে অসুবিধা কোথায় ? প্রকৃত মৎস্যজীবিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,যে জায়গায় নক করা দরকার সেখানে আমরা করিনা। আমি তাদেরকে অনুরোধ জানাবো সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করেন মুখে বক্তৃতা দিয়ে কোন লাভ নেই। আমি অধিক রিপোর্টে রাজস্ব ও মৎস্য বিভাগের জলমহালের সকল তথ্য চেয়েছি। আপনারাও তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চান। তথ্য দিতেতো আজ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন কোন গাফিলতি করেনি। তারপরও তথ্য না পেলে ফেসবুকে লিখুন। কোন জলমহাল কোন সমিতির নামে অমৎস্যজীবিরা লুটেপুটে খাচ্ছে। সমিতির সদস্যরা জলমহালের আয় ঠিকমতো পাচ্ছে কিনা? সমিতির ব্যাংক হিসেবে আদৌ কোন টাকা জমা হচ্ছে কিনা ? সরকারের দেয়া বরাদ্ধের টাকা ঠিকমতো ব্যায় হচ্ছে কিনা ? ইত্যাদি সকল বিষয় নিয়ে তথ্য চাওয়ার পাশাপাশি যেখানে যেরকম অনিয়ম হয় তা আমাদেরকে জানালে আমরা জেলা প্রশাসন অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।
তিনি বলেন,পত্রিকার রিপোর্ট দেখে তাহিরপুরে পোনা মাছ অবমুক্ত না করার কারনে সংশ্লিষ্ট বিভাগ এর বিরুদ্ধে সহকারী কমিশনার ভূমি (রাজস্ব) এর নেতৃত্বে মাছ অবমুক্ত না করার কারণ সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট আসার পর তিনি যেই হউন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নাই।
প্রতি উপজেলায় টিআর কাবিখা ও ৪০ দিনের কর্মসৃজনের কাজ,বরাদ্ধ ও সময়সীমার কথা ওয়েবপোর্টালে দেয়া আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন,সরকারের নির্দেশ,শেখ হাসিনার নির্দেশ,ডিজিটাল বাংলাদেশ এর আওতায় সব জায়গায় সেবার মান আমরা উন্মুক্ত করে দিচ্ছি। আগামীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সকল কাজ,বরাদ্ধ এর পরিমাণ ও বাঁধের সীমানা এলাকা সবকিছু তথ্য বাতায়নে পাবেন। যাতে আপনারা সব কাজ মনিটরিং করবেন। আমি যত জায়গায় কাজ করেছি সব জায়গাতেই আন্তরিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। যতদিন এ জেলায় কাজ করবো ততদিন এজেলাকে নিজের জেলা মনে করে কাজ করবো। প্রকৃত মৎস্যজীবি যদি না থাকে তাহলে সেই সমবায় সমিতি আমরা বাতিল করে দেবো। সমবায় অফিসার ও মৎস্য বিভাগের সার্টিফাই অনুযায়ী মৎস্যজীবি সমিতিগুলো রেজিস্ট্রেশন পায়। এক্ষেত্রে মৎস্য বা সমবায় বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কোন গাফিলতিও বরদাশত করা হবেনা।
মৎস্য চাষের ব্যাপারে আমার অনুরোধ আল্লাহর ওয়াস্তে বাড়ীর পাশের যে ডোবা আছে সেখানে ২টা মাছ ছাড়েন। তাতে কিন্তু মাছ বাড়বে। প্রকৃতির অফুরন্ত নেয়ামত এখানে আছে। আল্লাহ এখানে যা দিছেন তা কিন্তু উত্তরবঙ্গে নাই।
হাওর লীজ ও উন্নয়ন প্রকল্প এর শর্তের কোন ব্যত্তয় ঘটাতে কাউকে দেবোনা। জলাশয় সেচে মাছ ধরার প্রবনতা বন্ধ করার পাশাপাশি যারা এই বেআইনী কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
মাছের যেখানে উদ্ভব সেই জায়গাটা নষ্ট হতে দেবেননা। টাংগুয়ার হাওরে মসজিদের মাইকে আযান দিয়ে মাছ ধরার যে ট্র্যাডিশন যেকোন মূল্যে আমরা বন্ধ করবো। মাছের মূল আধারের জায়গা,দেশের মৎস্য সম্পদ ও প্রকৃতি রক্ষা ও জনগনের সম্পদ রক্ষার জন্য আমার সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
তিনি খোলামেলা অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য জেলা মৎস্য অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন,এর ফলে জেলার মৎস্য বিভাগের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে।
সভায় বক্তারা বলেন, ‘মৎস্য সম্পদ রক্ষা করতে হলে ইজারাকৃত জলমহালে মৎস্য আহরণের সময় পাম্প মেশিন দিয়ে জলমহাল সেচ করা বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে নদ-নদী ও হাওরে জেলেরা কারেন্ট ও কোনা জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে। এতে করে মাছের পোনা ধ্বংস হচ্ছে। মাছের পোনা ধরার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। মাছের পোনা রক্ষায় জেলা প্রশাসন প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করবে।’
সভায় জানানো হয়,২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে ১৭ হাজার একশতো ৫টি জলমহালে ৭হাজার ৭শত ৯৫ মেট্রিক টনেরও মাছ উৎপাদন করা হয়েছে। এবারের দুর্যোগ শুরু হওয়ায় প্রথমদিকে মনে করা হয়েছিলো মাছের যে ক্ষতি হয়েছে তা ব্যাপক আকার ধারন করবে। কিন্তু জেলা প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগের তৎপরতায় অল্পদিনের মধ্যেই মাছের উৎপাদন বেড়ে গেছে। আমরা মাছের দেশ সুনামগঞ্জের মানুষ ঘুরে দাড়িয়েছি। প্রশাসনের তৎপরতা অব্যাহত থাকলে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধিতে এ জেলা উত্তরোত্তর সাফল্য লাভ করবে বলে বক্তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।