রাজধানীর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস অব বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থী ফারাহ মাধুরী

বার্তা ডেক্সঃঃরাজধানীর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস অব বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থী ফারাহ মাধুরীকে (২২) ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দু’জনকে খুঁজছে পুলিশ। তারা ঘটনার দিন উত্তরার ‘ব্যাম্বু সুট’ রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে মদপান করেছিল। পুলিশ বলছে, তাদেরকে পাওয়া গেলে ঘটনার অনেক রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।

জানা যায়, গত ২৮ জানুয়ারি বিকালে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউল্যাবের ওই নারী শিক্ষার্থী তার বয়ফ্রেন্ড মর্তুজা রায়হান চৌধুরীসহ পাঁচজন উত্তরার ‘ব্যাম্বু সুট’ রেস্টুরেন্টে যায় এবং মদপান করে। এ সময় নেহা নামে তাদের এক বান্ধবী মদপানে অসুস্থ হয়ে পরলে সে (নেহা) ও তার বন্ধুকে উবারে তুলে দেয়া হয়। রেস্টুরেন্টে অবস্থানের সময় ইউল্যাবের ওই নারী শিক্ষার্থীও অসুস্থতা বোধ করে। পরে তাকে নিয়ে আসা হয় তাফসির নামে মোহাম্মদপুর এলাকায় তাদের এক বন্ধুর বাসায়। যেটি ছিল মোহাম্মাদীয়া হোমস লিমিটেডের তিন তলার একটি ফ্ল্যাটে।

পরের দিন (২৯ ডিসেম্বর) ওই বন্ধুর বাসায় থাকাকালে ইউল্যাব শিক্ষার্থীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে তার বয়ফ্রেন্ড মর্তুজা রায়হান। এতে সে আরও অসুস্থতা বোধ করলে গভীর রাতে তাকে প্রথমে নেয়া হয় কল্যাণপুরের ইবনে সিনা হাসপাতালে। সেখানে লাইফ সার্পোটের ব্যবস্থা না থাকায় ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ণ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার সকালে মৃত্যু হয় ওই শিক্ষার্থীর।

এদিকে, ৩০ জানুয়ারি ওই নারী শিক্ষার্থীর অসুস্থতার কথা পরিবারকে জানায় তার বয়ফ্রেন্ড রায়হান। এ সময় তার বাবা (ইউল্যাব শিক্ষার্থীর) চট্টগ্রাম থেকে আসেন এবং মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। সে সময় ওই নারী শিক্ষার্থী আনোয়ার খান মডার্ণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মামলার এজাহারে থাকা তিন নম্বর আসামি আরাফাত মামলার আগের দিন (৩০ ডিসেম্বর) মোহাম্মদপুর সিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এবং অনেক গোপনীয়তার সঙ্গে হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। যা পুলিশ রোববার বিকালে জানতে পারে। ইতোমধ্যে তার দাফনও সম্পন্ন করেছে পরিবার। তবে আরাফাতের মরদেহ কবর থেকে তোলার আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

গ্রেপ্তার মর্তুজা রায়হান চৌধুরী ও নুহাত আলম তাফসিরকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশি তদন্তের একটি প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, নিহত তরুণী ও রায়হান আগে থেকেই প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন। তারা আগে থেকেই ২৮ তারিখ বিকেলে দেখা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেদিন বিকেলে তারা হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজার সামনে একত্রীত হন। সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা হয় তাদের বন্ধু আরাফাতের। আরাফাত তাদেরকে গুলশানে একটি রেস্টুরেন্টে দাওয়াত আছে বলে নিমন্ত্রণ দেন। সেই দাওয়াতে যাওয়ার জন্য তারা প্রথমে আরাফাতের বাসায় যান। সেখান থেকে একযোগে উবার নেন। শেষ মুহূর্তে আরাফাত তাদের জানিয়েছিলেন, রেস্টুরেন্টের লোকেশন (ঠিকানা) একটু বদল হয়েছে, উত্তরায় যাচ্ছি আমরা। তখন তারা উবার নিয়ে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ‘ব্যাম্বু শুট’ রেস্টুরেন্টে যান।

রেস্টুরেন্টে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন- নিহত তরুণীর বান্ধবী নেহা ও তার আরেক ছেলে বন্ধু। রেস্টুরেন্টে তারা পাঁচ জন (মোতালেব প্লাজার দিক থেকে আসা তরুণী-আরাফাত-রায়হান, এছাড়া রেস্টুরেন্টে থাকা নেহা ও তার ছেলে বন্ধু) একত্রীত হয়ে মদপান শুরু করেন। মদ সরবরাহ করেন নেহার ছেলে বন্ধু। সন্ধ্যার পরপরই তারা একসঙ্গে মদপান করেন। এক পর্যায়ে নেহা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রেস্টুরেন্টের টয়লেটে গিয়ে বমি করেন। তখন নেহা ও তার ছেলে বন্ধু চলে যায়। রেস্টুরেন্টে আরাফাত, রায়হান এবং ওই তরুণী মদপান করতেই থাকেন। এক পর্যায়ে নিহত তরুণী টয়লেটে গিয়ে বমি করেন। তরুণীর অবস্থা ‘বেগতিক’ দেখে রায়হান ও আরাফাত তরুণীকে নিয়ে একসঙ্গে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে একটি উবার নেন। ওই তরুণী ও রায়হানকে গুলশান-২ এ নামিয়ে দেন আরাফাত।

গুলশান-২ এ নেমে ওই তরুণী বলেন, তিনি বাসায় যাবেন না, তাকে তার বান্ধবী তাফসিরের বাসায় নিয়ে যেতে বলেন। তখন তারা দুজন মিলে (ওই তরুণী ও রায়হান) মোহাম্মদপুর হোমস লিমিটেডের ৯ নম্বর বিল্ডিংয়ের বাসায় যান। সেই বাসায় তাফসির তার মায়ের সঙ্গে থাকেন। তবে সেদিন একা ছিলেন। বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) রাতে তারা তাফসিরের বাসায় ঢোকেন। এর পরপরই ওই তরুণী বমি করেন। সেই বমি পরিষ্কার করেন তাফসির ও রায়হান। এরপর রায়হান ও তরুণীকে এক রুমে রেখে অন্য রুমে চলে যান তাফসির।

রাতে রায়হানের সঙ্গে একাধিকবার ওই তরুণীর ‘শারীরিক সম্পর্ক’ হয়। এরপর ২৯ তারিখ ভোরেই ওই তরুণীকে তাফসিরের বাসায় রেখে নিজের বাসায় চলে যান রায়হান। সকাল থেকে দুর্বল বোধ করছিলেন ওই তরুণী। দুপুরে তাফসিরের বাসায় এসে আবার খোঁজখবর নিয়ে যান রায়হান। নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ উঠলেও সোহরাওয়ার্দীর ফরেনসিক বিভাগ ময়নাতদন্তের পর প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, ওই ছাত্রীর সঙ্গে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গমের আলামত পাওয়া যায়নি। তবে ফরেনসিক রিপোর্ট পেতে একমাস লাগতে পারে। এরপরই বোঝা যাবে বিষাক্ত মদ পানে নাকি অতিরিক্ত মদপানে তার মৃত্যু হয়েছে।

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ বলেন, নিহতের বাবার করা মামলায় নেহা ও তার বন্ধুকে (অজ্ঞাত) পাওয়া গেলে ঘটনার দিনের অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া আমরা ঘটনার দিনে রেস্টুরেন্টের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। ওসি বলেন, রায়হানের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ইতোমধ্যে চেক করা হয়েছে। সেটি দেখে আমাদের মনে হয়েছে, রেস্টুরেন্টে যাওয়ার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং এ বিষয়ে দুজনই অবগত ছিলেন। বাকিদের মোবাইল ফোনগুলো সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। সেগুলো পেলে প্রযুক্তিগত পরীক্ষা করা হবে। এটি মূলত একটি ড্রিংকস পার্টি ছিল (মদপানের)। পার্টি আয়োজনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য তদন্তে পাইনি।

ওসি আরও বলেন, মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত জানা যাবে। এ বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে শুনেছি, নেহার এক বন্ধু বিমানবন্দর থেকে মদ এনে উত্তরার ব্যাম্বু শুট রেস্টুরেন্টে পান করেছেন। আমরা সেই ছেলের নাম পরিচয় এখনও পাইনি। তাকে খোঁজা হচ্ছে। সেই মদপানের কারণেই কিছু হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এছাড়া মদপান করার কারণে বিষক্রিয়া হয়েছে কি না- তা আমরা তদন্ত করছি। এছাড়াও উত্তরার যে রেস্টুরেন্ট থেকে এই মদপান করা হয়েছিল, তাদের লাইসেন্স আছে কি না- তাও তদন্ত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, নিহত তরুণীর ভিসেরা নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রেপ্তার দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্তে প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হয়েছে, অতিরিক্ত মদপান, মদে বিষক্রিয়া অথবা বেশি মদপান করিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারে।-পূর্বপশ্চিমবিডি

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn