মানুষই নষ্ট হয়, বদলে দেয় সমাজ!-পীর হাবিবুর
পীর হাবিবুর রহমান।।
মানুষই নষ্ট হয়, বদলে দেয় সমাজ! মানুষই ভুলে যায় কি নিয়ে গর্ব, কাকে নিয়ে লজ্জা! একজন মানুষকে দেখেছি কাল যাকে অনেক মর্যাদাসম্পন্ন উঁচু দরের মানুষ ভেবে সম্মান করেছি, সেই দেখি নষ্টদের সমীহ করে! চরম নষ্ট মানুষের সাথে চলতে পারাই অনেক বড়। গর্ববোধ করে। কি নিয়ে গর্ববোধ,তাও জানে না!! সকালে ঢাকার বাইরে যাবো, তবু কথা বাড়াইনি। তবু লজ্জায় গ্লানিতে রাত পার হয়! তবু ঘুম আমার হয় না। তবু আমি জেগে থাকি! ভাবতেই থাকি একটি সমাজ কেমন করে দিনে দিনে বদলে গেলো! সকালের মানুষ বিকেলে, বিকেলের মানুষ রাতেই চেনা যায় না!! সাদাকালো একটা সময় ছিলো, এত বিত্তবৈভব মানুষের ছিলো না। এত অস্হিরতা ও নয়। এত বিত্তবৈভবের লোভ ও নয়! নয় যেনতেন ক্ষমতার মোহ! মূল্যবোধ, নীতিবোধ, আদর্শ ও আত্মসম্মানবোধ ছিলো প্রখর। সৎ সাহসী ভদ্র ও আদর্শিক মানুষদের প্রতি ছিলো সমাজের শ্রদ্ধার কুর্নিশ।
একটা সময় ছিলো মানুষ জেনেছিলো, টাকার প্রয়োজন, কিন্তু টাকাই সব নয়। সেই সময়ও স্লোগান উঠেছিলো, এ সমাজ নষ্ট সমাজ, এ সমাজ ভাঙতে হবে। যারা যে আদর্শ বুকে নিয়ে শ্লোগান তুলেছিলেন,তারা ভাঙতে পারেননি। তবে রাজনীতিবিদরাই ভেঙ্গেছেন। সাদাকালো সেই সময়ের সুখ,শান্তি নেই তো কি হয়েছে! সমাজ ভেঙ্গে মূল্যবোধহীন আদর্শহীন নীতিহীন ভোগবাদী আগ্রাসনে পতিত হয়েছে। একটা সময় ছিলো, এত টুপি এত হিজাব এত এত হজ্ব ছিলোনা। এখন হিজাব বেড়েছে, টুপি বেড়েছে, কমরেড কমিউনিস্টরাও হজ্বে যাচ্ছেন, কিন্তু ধর্মের নামে মানুষ হত্যা, ব্যভিচার, ঘুষ, দুর্নীতি, মধ্যস্বত্তভোগী দালাল নষ্ট মানুষের প্রভাব বেড়েছে! ধর্মের মর্মবাণী, সত্য বলো, সৎ পথে চলো, ন্যায়পরায়ণ হও, অসৎ পথ পরিহার করো-উপেক্ষিত হচ্ছে, অথচ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের উন্মাসিকতা চলছে! একটা সময় ছিলো সমাজে বিত্তে নয়, ক্ষমতায় নয়, মানুষ প্রকৃত মানুষকেই সম্মান করেছে। তাই এপিজে আবুল কালাম বলেছেন,’টাকা দিয়ে পদ কেনা যায়, সম্মান নয়’। অথচ যেনতেন টাকা কামিয়ে কৃত্রিম লোক দেখানো সম্মান অর্জনের এক অরুচিকর উৎসব চলছে! যার যেনতেন দুআনা ক্ষমতা, যার যেনতেন অঢেল সম্পদে যেমন লজ্জা নাই, তেমনি সমাজের শিক্ষিতদের মধ্যেও কিছু কিছু পুরুষ তাদের সমীহ করে গদগদ হচ্ছে। কিছু কিছু নারী মুগ্ধ হয়ে গড়িয়ে পরছে।
কোনো কোনো পুরুষকে এরা ক্ষমতাও বিত্তের আকর্ষণে চাটুকার বানালেও দাস হয়ে তারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। গর্বিত হয়ে পথ হাটছেন, কিছু কিছু নারীকে যৌনদাসী বানাবার দৃষ্টি নিয়ে,অসম্মানের চোখে দেখলে, তারাও ধন্য ধন্য করছেন। আত্মসম্মান ভুলে গৌরববোধ করছেন। গর্ব আর গ্লানির ব্যবধান তারা আজ ভুলে গেছেন! এখন আড্ডার টেবিলে রবীন্দ্র, নজরুল, সুকান্ত, শামসুর, সরদার ফজলুল করিম বা আহমদ ছফারা উঠে আসছেন না! আসছেন নষ্ট সমাজের নীতিহীন মানুষরা, কেউ নানা ক্ষমতার পদে, কেউ বিত্তের উপরে বসা।
সমাজের শিক্ষিত মানুষেরাও ভুলে গেছে ফেসবুকে কার সাথে ছবি দেবে, কাকে নিয়ে গর্ব করবে! মানুষের বিচার, রুচিবোধ, চিন্তা ও ভাবনার জগৎ মানসিক বিকৃতির শিকার। একসময় মানুষ যাদের এড়িয়ে চলতো, আজ সম্মান মর্যাদা কেনাবেচার এই অসুস্থ প্রযুক্তি নির্ভর সময়ে ভুলে যাচ্ছে! উল্টো তাদের নষ্টদের সাথে উঠাবসা করেই ধন্য হচ্ছে। একসময় অসৎ চরিত্রহীন-লম্পট-দুর্নীবাজরাই সমাজে নিন্দায় গ্লানিতে ডুবে থাকতো। এখন সমাজে সৎ আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ভালো মানুষেরাই, উপহাসের পাত্র। এক সময় মানুষ মানুষের সমাদর সম্মান করেছিলো, একালে মানুষ বিত্তবান ও ক্ষমতাবানদেরই কুর্নিশ করে, মানুষকে সম্মান করতে ভুলে গেছে। সমাজে একদা সৎ রাজনীতিবিদ থেকে আদর্শ শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করে ধন্য হয়েছে। এখন মানুষ তা ভুলে গেছে। মানুষ তার অতীত ভুলে গেছে। সমাজে বিত্তবান ও ক্ষমতাবানদের ছায়ায় এখন তদবিরবাজ ও বেশ্যার দালালদের কদর বেড়েছে। সৎ রাজনীতিবিদ থেকে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ নির্বাসিত হচ্ছে। অবাক বিস্ময়ে ভাবি, এই সমাজ চোখের সামনে বদলাতে বদলাতে শেষ তলানিতে, কিন্তু কারো সেদিকে খেয়াল নেই। স্রোতে গা ভাসাচ্ছে সবাই, আমরাও ভাসাবো?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক