রাত প্রায় পৌনে ৯টা। রাজধানীর মালিবাগের রাস্তাগুলো তখন ব্যস্ত। যানজটে আটকে ছিল অনেক গাড়ি। এরমধ্যে হঠাৎ বিকট শব্দ। চিৎকার। কান্নার আওয়াজ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এসবি অফিসের ফটকের উল্টোদিকে ফ্লাইওভারের নিচে পুলিশের একটি সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ ভ্যানে আগুন জ্বলতে থাকে। ততক্ষণে আগুন ও ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ ও পলওয়েল জি গ্যাস স্টেশনের কর্মচারীদের সহযোগিতায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বিকট বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন রিকশা চালক লাল মিয়া ও ট্রাফিক পুলিশের এএসআই রাশেদা খাতুন। এটি ককটেল বিস্ফোরণ। তবে পুলিশ বলছে, গত রোববার রাতের এই ককটেল সাধারণ কোনো ককটেল না। এটি অত্যন্ত শক্তিশালী। তদন্ত সংশ্লিষ্ট অনেকের ধারণা, এটি ইমপ্রভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)। ইতিমধ্যে মালিবাগের এই ঘটনার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এ ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।

মামলায় বলা হয়েছে, এই ঘটনায় কনস্টেবল শফিক চৌধুরী বাদী হয়ে গতকাল মামলা দায়ের করেছেন। যে গাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে এটি তখন গণভবনে যাওয়ার কথা ছিলো। গণভবনে ডিউটিরত পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যদের আনতে গাড়িটি স্টার্ট করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন চালক কনস্টেবল শফিক চৌধুরী। এর মধ্যেই গাড়ির পেছনে বিকট শব্দ হয়। তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ি থেকে নামেন শফিক চৌধুরী। ততক্ষণে গাড়ির পেছনের হুটে ও বাম পাশের সীটে আগুন জ্বলছিলো। শফিক চৌধুরী চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ও পলওয়েল জি গ্যাস স্টেশনের কর্মচারীদের সহযোগিতায় অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রন করা হয়। এসময় ট্রাফিক পূর্ব বিভাগের এএসআই রাশেদা খাতুন বাম পায়ে রক্তাক্ত জখম হন। রিকশাচালক লাল মিয়া মাথায় রক্তাক্ত জখম হন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্য ট্রাফিক পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি সাধনের জন্য এই বোমা নিক্ষেপ করে।

গতকাল সকালে সরজমিন ঘটনাস্থল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, মালিবাগ মোড়ের গ্যাস স্টেশন সংলগ্ন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ফটকের উল্টোদিকে ফ্লাইওভারের নিচে ছিলো গাড়িটি। গতকালও সেখানে অনেক গাড়ি পাকির্ং করা ছিলো। কথা হয় প্রত্যক্ষদর্শী ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল মজনু মিয়ার সঙ্গে। ঘটনার সময় তিনি মোড়ের মগবাজার-রাজারবাগ সিগন্যালের দায়িত্ব পালন করছিলেন। অন্যদিকে মোড় থেকে কাকরাইল সিগন্যালে এসবি অফিসের সামনে দায়িত্ব পালন করছিলেন এএসআই রাশেদা। ওই মোড়ে রাশেদা, মজনুসহ ট্রাফিকের তিন সদস্য দায়িত্ব পালন করছিলেন। মজনু জানান, সিগন্যাল তখন বন্ধ ছিল। এরমধ্যেই হঠাৎ বিকট শব্দ এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুন দেখতে পান। সবাই তখন দৌড়াচ্ছিলো। চিৎকার শুনে তিনি এগিয়ে যান। ধোঁয়া কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। কাছে গিয়ে দেখতে পান এএসআই রাশেদা পায়ে আঘাত পেয়েছেন। আরেকজন রিকশা চালক রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। একই কথা বলেন প্রত্যক্ষদর্শী আরও কয়েকজন।

এ ঘটনায় গুরুতর আহত রিকশাচালক লাল মিয়াকে দেখতে গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন,  মালিবাগের বোমা হামলা কারা কী উদ্দেশ্যে করেছে তা তদন্তাধীন, একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। বিস্ফোরণটি একটি ককটেলের। নরমাল ককটেলের চেয়ে এটি শক্তিশালী ছিলো। এটা পুলিশকে টার্গেট করা হয়েছে নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য করা হয়েছে এটি তদন্তসাপেক্ষ বলে জানান তিনি। ডিএমপি কমিশনার বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা দেখছি এটি পুলিশকে লক্ষ করে করা হয়েছে। নাকি রেনডমলি মেরেছে। এটি ছুঁড়ে মারা হয়েছে, নাকি পুতে রাখা হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে এটি গাড়িতে রেখে দেয়া হয়েছিলো। জনমনে ভীতিকর পরিস্থিতি, নৈরাজ সৃষ্টির জন্যই এটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এর আগে গুলিস্তানে ট্রাফিকবক্সের সামনে যে বিস্ফোরণ হলো এতে ৩ জন পুলিশ কনস্টেবল আহত হলো। মালিবাগে পিকআপে হামলা কোনো স্বার্থনেস্বী মহল, গোষ্ঠী করেছে। এই গোষ্ঠী কারা, এটা তদন্ত করে বের করতে হবে। তারা এ ধরনের নৈরাজ্য করে, ভীতি সৃষ্টি করে জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছে বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি জঙ্গি তৎপরতা ছাড়াও অতীতের অগ্নিসন্ত্রাস, বিদেশি নাগরিক হত্যার কথা উল্লেখ করেন।

এদিকে, গতকাল বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে কথা হয় রিকশা চালক লাল মিয়ার স্বজনদের সঙ্গে। লাল মিয়ার মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তখন তাকে রক্ত দেয়া হচ্ছিলো। কথা বলতে পারছিলেন না। তার বড় ভাই মো. বিল্লাল জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলা সদরের হেরুরাবালুঘাটে। গত ২০ বছর যাবত ঢাকায় রিকশা চালান লাল মিয়া। তেজকুনিপাড়ায় একটি গ্যারেজে থাকেন। ঘটনার সময় মালিবাগে রিকশা থামিয়ে তাতে বসে একটি পান খাচ্ছিলেন। ওই সময়ে বিস্ফোরণে মাথায় আঘাত পান তিনি। এ বিষয়ে ঢামেকে’র অধ্যাপক ডা. রেজাউল হক বলেন, লাল মিয়ার মাথায় গুরুতর আঘাত। হাড় ভেঙ্গে ব্রেনে আঘাত পেয়েছেন তিনি। তবে লাল মিয়া আশঙ্কামুক্ত বলে জানান তিনি। ডা. রেজাউল হক জানান, লাল মিয়ার মাথায় কোনো স্প্রিন্টার পাওয়া যায়নি। এমন হতে পারে বোমার স্প্রিন্টার মাথায় ঢুকেনি বা প্রাথমিক চিকিৎসা করার সময় স্প্রিন্টার বের করা হয়েছে। এদিকে এ ঘটনায় জঙ্গিগোষ্ঠি আইএস দায় স্বীকার করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সাইট ইন্টিলিজেন্স জানিয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn