রোকনুজ্জামান পিয়াস-

মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে দেশটির সরকার। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া ওই অভিযানের কারণে বৈধ কাগজপত্র না থাকা বিদেশিরা আতঙ্কে রয়েছেন। এ অবৈধ বিদেশিদের তালিকায় সবচেয়ে বেশি রয়েছে বাংলাদেশি নাগরিকরা। এর আগে গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০শে জুন পর্যন্ত অবৈধভাবে     পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ১
অবস্থানরত বিদেশি শ্রমিকদের বৈধকরণের জন্য সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু অনেকেই এ সুযোগ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। দেশটির অভিবাসন কর্মকর্তারা বলছেন, এ ব্যাপারে শ্রমিকরা যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিল। ফলে নতুন করে আর কোনো সুযোগ দেয়া সম্ভব নয়। এদিকে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর বিপাকে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। গ্রেপ্তারের ভয়ে তারা ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। অনেকে নিজেদের ভিসার মেয়াদ বাড়াতে দালালের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েও কোনো ফল পাননি। এছাড়া দূতাবাসে ফোন করেও কোন সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা।  গতকাল টেলিফোনে মানবজমিন-এর কাছে দেশটিতে অবস্থানরত শ্রমিকরা এমন অভিযোগ করেছেন। সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার অভিবাসন কতর্ৃৃপক্ষ অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে মালয়েশিয়াজুড়ে শুরু হওয়া এই অভিযানের প্রথমদিন বৈধ কাগজপত্র না থাকা ৫১ জন শ্রমিককে আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে বেশির ভাগ শ্রমিক বাংলাদেশি বলে জানা গেছে। দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য স্টার এর খবরে বলা হয়েছে, অভিবাসন কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক দাতুক সেরি মুস্তাফার আলী নিজেই একটি অভিযানে নেতৃত্ব দেন। শুক্রবার দিবাগত রাতে কাপার এলাকার জালান জাতি কিরিতে অবস্থিত একটি অস্থায়ী ডরমিটরিতে এ অভিযান চালানো হয়। এ সময় ২৩৯ জন শ্রমিকের কাগজপত্র যাচাই করা হয়। এদের মধ্যে ৫১ জনের বৈধ কাগজপত্র ছিল না। পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তাদের আটক করা হয়েছে। মুস্তাফার জানান, এসব শ্রমিকের বেশির ভাগই ফার্নিচার ও প্লাস্টিক উৎপাদন কারখানায় কাজ করতেন। এর আগে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে দাতুক সেরি মুস্তাফার আলী বলেন, ১লা জুলাইয়ের পর কোনো প্রতিষ্ঠানে অবৈধ শ্রমিক ধরা পড়লে জনপ্রতি ১০ হাজার রিঙ্গিত জরিমানা করা হবে। কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে তাদের আদালতে নেয়া হবে। অবৈধ শ্রমিকদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। চলতি বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার ঘোষিত ওই ই-কার্ড বা এনফোর্সমেন্ট কার্ড আবেদনের সুযোগ দেয় মালয়েশিয়া সরকার। ই-কার্ড রেজিস্ট্রেশনের চূড়ান্ত সময়সীমা ছিল ৩০শে জুন। এর মধ্যদিয়ে অবৈধ শ্রমিকদের অস্থায়ীভাবে কাজ করার অনুমতির সুযোগ দেয়া হয়। শ্রমিকদের বিনামূল্যে এই কার্ড দেয়া হচ্ছে। ২০১৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ই-কার্ডের মেয়াদ থাকবে। এদিকে, দ্য স্টার-এর আরেকটি খবরে বলা হয়েছে দেশটির পিরাক এলাকায় পৃথক দু’টি অভিযানে ৩৫ জন অবৈধ শ্রমিককে আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে মিয়ানমারের ২২ জন, ইন্দোনেশিয়ার ৩ জন, বাংলাদেশের ১ জন ও নেপালের ৯ জন শ্রমিক রয়েছেন। পিরাক অভিবাসন অভিযানের প্রধান সুহাইরি বাহ আলী জানান, অভিযান দু’টি চালানো হয় মেংলেম্বু ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ও তামান মেংলেম্বু ইম্পিয়ানা আদ্রিলে। তদন্তের জন্য কারখানার মালিককেও আটক করা হয়েছে। দেশটির অভিবাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ সুযোগ নেয়া শ্রমিকের হার মাত্র ২৩ শতাংশ। আর মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থান করছেন প্রায় ৬ লাখ শ্রমিক।
এদিকে এই ধরপাকড়ের কারণে দেশটিতে অবস্থানরত বিদেশিদের মতো আতঙ্কে রয়েছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। এমনই একজন নোয়াখালীর বাহাউদ্দিন জুয়েল। তিনি ২ বছর আগে মালয়েশিয়াতে গেছেন। দেশটির সেলেংগর এলাকার এসএল ইনসুলিন নামে একটি ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে তিনি কাজ করেন। চার মাস আগে তার ভিসার সময়সীমা শেষ হয়েছে। এরপরও তিনি নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু গত ৪ দিন ধরে কাজে যাচ্ছেন না। ধরপাকড় শুরু হওয়ায় বাইরে বের হতে পারছেন না। জুয়েল বলেন, তার সময় এখন বাসার ভেতরেই কাটছে। সব সময় গ্রেপ্তারের ভয়। বাসার সমানে পুলিশ ঘোরাফেরা করছে। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজে যেতে পারছেন না। তাছাড়া রাস্তাঘাটেও পুলিশ। তারাও অবৈধ অভিবাসীদের ধরতে তৎপরতা চালাচ্ছে। তিনি আরো জানান, বৈধ কাগজপত্র না থাকা শ্রমিকদের এর আগে সময় দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু দালালের ফাঁদে পা দিয়ে তিনি সেই সুযোগ নিতে পারেননি। বলেন, তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশি এক দালাল তার কাগজপত্র করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এজন্য ওই দালালকে ৩ মাস আগেই ৪ হাজার মালয়েশিয়ান রিংগিত দিয়েছিলেন তিনি। একমাসের মধ্যে ভিসা করে দিতে চেয়েছিলেন। এরপর আরো ১৫ দিন সময় নেয়। এরপর তিনদিন। কিন্তু সময়ক্ষেপণ করে শেষ পর্যন্ত তার কাগজপত্র দেয়নি। এমনকি এখন ফোনও রিসিভ করে না ওই দালাল। তার মতো অনেক বাংলাদেশিই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের কেউই এখন কাজে যেতে পারছেন না। একদিকে কাজ হারানোর ভয় অন্যদিকে গ্রেপ্তারের আতঙ্কে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারছেন না তারা। জুয়েল জানান, তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করেন সেখানে চার বাংলাদেশির মধ্যে ২ জনেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। অপরজন সোহাগ। তার বাড়ি যশোর জেলায়। তিনিও বাসা থেকে বের হতে পারছেন না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো সহযোগিতা চেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকটা হতাশার সুরে এই বাংলাদেশি বলেন, দূতাবাসে ফোন করলেও কেউ রিসিভ করছেন না। এছাড়া নানা ভোগান্তির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পাসপোর্ট রিনিউ করতে নির্ধারিত ১১৬ রিঙ্গিত লাগে। কিন্তু তার কাছ থেকে ৩৫০ রিঙ্গিত নিয়েছিলো দূতাবাসের লোকজন।
ধরপাকড়ের ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব জাভেদ আহমেদ বলেন, অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া মালয়েশিয়ান সরকারে নিয়মিত কার্যক্রম। এটা নিয়ে আমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। সেখানে চার লাখ বাংলাদেশি কর্মী বৈধভাবে কর্মরত রয়েছে। তিনি বলেন, জি টু জি প্লাস শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৫-৬ হাজার কর্মী গেছে। তবে জাভেদ আহমেদ স্বীকার করেন মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্র্রমিকের ডিমান্ড রয়েছে। একশ্রেণির প্রতারক চক্র অবৈধ শ্রমিক পাঠায় যাদের বৈধ কাগজপত্র থাকে না। এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশি হাইকমিশনার মো. শহিদুল ইসলাম জানান, কতজন বাংলাদেশিকে তারা এ পর্যন্ত আটক করেছে সেই সংখ্যাটি আমরা এখনো জানি না। এটা জানাতে তারা ১০-১৫ দিন সময় নেয়। এই ধরপাকড় তাদের রুটিন ওয়ার্ক বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn