রোকনুজ্জামান পিয়াস:

এনামুল হাসান ভূঁইয়া কাউছার (২০)। ২০১৫ সালের জুন মাসে উচ্চশিক্ষা নিতে মালয়েশিয়া যান। সেখানেই পরিচয় নাটোরের যুবক আলমগীর ওরফে আলম (৩২)-এর সঙ্গে। এ সময় আলম তার অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছিলো কাউছারকে। বলেছিলো- সে বেকার। আয়-রোজগার নেই, নেই থাকার জায়গাও। কাজ খুঁজছেন। কিন্তু তার আগে দরকার মাথা গোঁজার ঠাঁই। কাজ পেলেই নিজের মতো করে থাকবেন। কোনোরকম থাকার একটা জায়গা পেলেই খুঁজে নেবেন কাজ। তার অসহায়ত্বের কথা শুনে মন গলে যায় কাউছারের। তিনি তার রুমেই থাকার ব্যবস্থা করেন আলমের। এটাই কাল হয় কাউছারের। তার আশ্রয়ে থাকা আলমই তাকে অপহরণ করে। দাবি করে মোটা অঙ্কের টাকা। সেই টাকা না দিলে মেরে ফেলবে বলেও হুমকি দেয় পরিবারকে। শুধু আলম একাই নয়। তার এই ভয়ঙ্কর অপহরণ সিন্ডিকেটে রয়েছে দু’জন মালয়েশিয়ান। তাদের মাধ্যমে সহজেই ভিকটিমকে লুকিয়ে রাখতে পারে সে। এছাড়া বাংলাদেশেও রয়েছে তার এই সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্য। তাদের কাজ- মালয়েশিয়া থেকে আলমের দেয়া ডিরেকশন মোতাবেক পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা হাতিয়ে নেয়া। রাতুল তাদেরই একজন। শনিবার বিকালে মুক্তিপণের টাকা নিতে এসে পুলিশের বিশেষ শাখা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর হাতে গ্রেপ্তার  হয় সে। রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে পিবিআই সদস্যরা তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। এরপরই মুক্তি মেলে অপহৃত কাউছারের। এর আগে গত বুধবার অপহরণের শিকার হয়েছিলেন তিনি। পুলিশ ও ভিকটিমের পারিবারিক সূত্র জানায়, এর আগেও কাউছারকে অপহরণ করা হয়েছিলো। সেবার দেড় লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তিনি ছাড়া পান। পরিবারের ধারণা, ওই অপহরণেও জড়িত আলমগীর হোসেন ওরফে আলমের এই সিন্ডিকেট।
পিবিআই সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় এনামুল হাসান ভূঁইয়া কাউছার অপহরণের পর তার চাচা নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও থানার কুমারচর গ্রামের নজরুল ভূঁইয়া গত ২৭শে এপ্রিল যাত্রাবাড়ী থানায় একটি জিডি করেন। একইসঙ্গে তিনি ঢাকা মহানগর পিবিআই অফিসেও যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, তার ভাই আমিনুল হক ভূঁইয়ার ছেলে  মো. এনামুল হাসান ভূঁইয়া ওরফে কাউছার মালয়েশিয়াতে ‘ইন হাউজ মাল্টিমিডিয়া কলেজে’ লেখাপড়া করে। অবসরে কুয়ালালামপুর শহরে তার মামা শামীমের সবজির দোকানে বসে। মামাকে সাহায্য করেন। কুয়ালালামপুরে তার রুমে থাকতো নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে আলমগীর হোসেন আলম। গত বুধবার দুপুরে একব্যক্তি কাউছারের মোবাইল ফোন থেকে তার (চাচা নজরুলের) নম্বরে ফোন করে বলে আলমসহ তার লোকজন কাউছারকে মালয়েশিয়ায় একটি সবজি বাগান দেখাতে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে। অপহরণকারীরা ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে কাউছারকে ছেড়ে দেবে। টাকা না দিলে মেরে ফেলবে। এ কথা বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরে একাধিকবার বিভিন্ন নম্বর থেকে তার নম্বরে ফোন করলে একই কথা বলে। তারা উত্তরার রাকিবুল হাসান রাতুল নামে একব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে তার ডাচ্‌ বাংলা ব্যাংকের একাউন্টে টাকা দিতে বলে। এরমধ্যে মালয়েশিয়ায় কাউছারের মামা শামীমও ‘মে ব্যাংক-এর একটি একাউন্টের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার অপহরণকারীদের ৪০০০ রিঙ্গিত দেন। এরপরও ওই নম্বর থেকে ভিকটিম কাউছারের চাচা নজরুলকে ফোন করে আরো ১ আখ টাকা দাবি করে। ওই টাকা নিয়ে দক্ষিণ খান বাজারের সুলতান মার্কেটে যেতে বলে। এ ঘটনা জানার পর পিবিআই দল সিন্ডিকেটের এই সদস্যকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে অভিযানে যায়।  ওই সময় পরিবারের লোকজন সুলতান মার্কেটের পূর্ব পাশের চিপা গলির মধ্যে রাতুলের হাতে ১ লাখ টাকা তুলে দেয়। টাকাগুলো গুনতে থাকাবস্থায় পিবিআই দল তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তার কাছ থেকে ওই ১ লাখ টাকা এবং ১টি মোবাইল সেট জব্দ করা হয়। পিবিআই সূত্র জানায়, রাতুলকে আটক করার পর মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত আলমকে টাকা বুঝে পেয়েছে বলে ফোন করতে বলা হয়। এরপর রাতুল তাদের নির্দেশমতো আলমগীরকে ফোন করে জানানোর পর ছেড়ে দেয়ার কথা জানায়। পরে ভিকটিম কাউছার তার মামার কাছে পৌঁছানোর পর রাতুলের মোবাইল জব্দ করা হয়। এর আগেও প্রায় ৩০-৩৫ দিন পূর্বে কাউছারকে তার মামা শামীমের দোকান থেকে কৌশলে অপহরণ করা হয়েছিলো বলে সূত্রটি জানায়। সে যাত্রায় ২ দিন আটক রাখার পর কয়েকটি বিকাশ নম্বরে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়ে তাকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা।
আটক রাতুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআইকে জানিয়েছে, অপহরণকারী এই চক্রটি মালয়েশিয়াতে অবস্থানকারী ছাত্র-শ্রমিকদের বিভিন্ন কৌশলে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে রুমের মধ্যে আটক রাখে। মালয়েশিয়ায় অবস্থান করা আলম এই সিন্ডিকেটের হোতা। তার সঙ্গে কয়েকজন মালয়েশিয়ানও জড়িত। আলম ভিকটিমের পরিবারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে। আর সে পরিবারের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করে।
কাউছারের পরিবার ও পিবিআই সূত্র আরো জানায়, আলম বেকার সেজে তার অসহায়ত্বের কথা বললে কাউছার তাকে নিজের রুমে থাকতে দেন। তার কাছে থাকার সুবাদে আলম তাকে ব্যবসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়। বলে- সে এমন একটি জায়গা চেনে যেখান থেকে তার মামা কমদামে সবজি কিনতে পারবে। ফলে বেশি লাভ হবে। তার কথামতো একদিন সেখানে যান কাউছার। পরে ফেরতও আসে তারা। এভাবে বিশ্বাস অর্জন করে আলম। এরপর আলম পরামর্শ দেয়- তার মামা নিজেই সবজি চাষ করে ব্যবসা করতে পারেন। এমন একটি জায়গা তিনি চেনেন। তার কথা মতো আবারও ওই জায়গা দেখতে যান কাউছার। কিন্তু এবার আর ফিরে আসেননি। আলম তাকে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করে। এদিকে দু’দফা অপহরণের ব্যাপারে কাউছারের মামা শামীম দুই মালয়েশিয়ান অপহরণকারীর বিরুদ্ধে সেদেশের পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn