মায়ের খোঁজে সুইজারল্যান্ড থেকে কুড়িগ্রামে রওফা
জানা যায়, সম্প্রতি সুইজারল্যান্ড থেকে নিজের হারিয়ে যাওয়া বাবা-মাকে খুঁজতে কুড়িগ্রামে আসেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী রওফা। তার কাছে থাকা তথ্য অনুসারে, উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নে নিজের পরিবারকে খুঁজে ফেরেন তিনি। কিন্তু কাউকে না পেয়ে ঢাকায় চলে আসেন, আবারও তার সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার কথা। চার দশকের বেশি সময় আগের হারিয়ে যাওয়া বাবা-মাকে খুঁজতে রওফাকে সহায়তা করছে ‘ইনফ্যান্টস ডু মনডে’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর রাকিব আহসান জানান, ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সাড়ে তিন বছরের এক শিশু কন্যা। এরপর ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত চিলমারী উপজেলার বেসরকারি শিশু সংগঠন ছিন্নমুকুল এর একটি লঙ্গরখানায় স্থান হয় তার। সেখান থেকে সুইজারল্যান্ডের এক দম্পতি দত্তক হিসেবে নিয়ে যান তাকে। তারপর জেনেভা শহরে বেড়ে ওঠে শিশুটি। রওফা নাম দেওয়া হয় তাকে। লেখাপড়া শেষ করে পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার একজন সুইস অধিবাসীকে বিয়েও করেন রওফা। সেদিনের সেই হারিয়ে যাওয়া শিশু রওফা এখন পাঁচ বছর বয়সী এক ছেলের মা।
রাকিব আহসান আরও জানান, সুইজারল্যান্ডে নিজের পরিবার নিয়ে সুখে থাকলেও রওফা একটা শেকড়ের টান অনুভব করতেন মনের ভেতর। বড় হয়ে যখন জানলেন তার দেশ সুইজারল্যান্ড নয়, বাংলাদেশে, তখন স্বামীর সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশে হারিয়ে যাওয়া পরিবারকে খুঁজতে আসেন তিনি। সপ্তাহ খানেক বিভিন্ন জায়গায় চষে বেড়িয়েছেন। কিন্তু পরে ১৯ জানুয়ারি অনেকটা হতাশ হয়েই ঢাকায় ফিরে যেতে হয় তাকে। শনিবার (২৬ জানুয়ারি) সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে তার। এদিকে বাবা-মার খোঁজে রওফার এই আগমনের খবর পেয়ে হারিয়ে যাওয়া সন্তানের কথা বলছেন স্থানীয় নারী। উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী ওকিতনের দাবি, সুইজারল্যান্ড প্রবাসী রওফা তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে সাহেরা হতে পারে। একারণেই কুড়িগ্রাম থেকে রওফা ফিরে যাওয়ার চারদিন পর শুক্রবার (২৫ জানুয়ারি) জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গিয়েছেন তিনি। রওফার সঙ্গে দেখা করতে প্রশাসন ও গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতাও চেয়েছেন এই বৃদ্ধা মা।
ওকিতন জানান, স্বামীর নাম ছাত্তার আলী। ২২ বছর আগে মারা গেছেন স্বামী। দুটি মেয়ে এবং এক পুত্র সন্তানের জননী তিনি। বড় সন্তান সাহেরা ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় খাবার খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘মঙ্গাত (দুর্ভিক্ষে) ছাওয়ালের ঘরক (বাচ্চাদের) খাবার দিবার পাই নাই। ছওয়ালটা মোর হারে গেইল (হারিয়ে গেল)। ম্যালা (অনেক) খোঁজা খুঁজি করছি, পাই নাই।’ ওকিতন আরও জানান, সুজারল্যান্ডের অধিবাসী রওফা কয়েকদিন আগে যখন এলাকায় এসে বাবা-মার খোঁজ করছিলেন তখন বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। আর একমাত্র ছেলে রংপুরে বেড়াতে যাওয়ায় তারা ওই মুহূর্তে রওফার বিষয়ে জানতে পারেননি। পরে এলাকার লোকজনের মাধ্যমে রওফার ব্যাপারে সব শুনেছেন এবং নিজের চেহারার সঙ্গে রওফার চেহারার মিলের কথা জানতে পেরেছেন। এরপর রওফাকে দেখতে কুড়িগ্রাম জেলা সদরে ছুটে যান তিনি। কিন্তু ততদিনে কুড়িগ্রাম ছেড়েছেন রওফা।
ওকিতন বলেন, ‘এলাকার মানুষ কয়, যে বিদেশি হামার এলাকাত গেছিল তার চেহারার সঙ্গে মোর চেহারার মিল আছে। সবাই কয় ওটায় মোর বেটি।’১৯৭৪ সালে হারিয়ে যাওয়া শিশু কন্যার চোখের কাছে একটি তিল ছিল জানিয়ে ওকিতন বলেন, ‘মুই দেখলে চিনবার পাইম (আমি দেখলে চিনতে পারবো)। সেজন্যে একবার দেখপার আসছি। মোর বেটি কই? এক নজর তাক মুই দেখিম। তোমরা একনা ব্যবস্থা করি দেও।’ ওকিতনের একমাত্র ছেলে রফিকুল জানান, হারিয়ে যাওয়া সাহেরা ছিল সবার বড় বোন। জীবনের শুরুতে তারা প্রথমে দলদলিয়ার অর্জুন গ্রামে থাকলেও তিস্তার গ্রাসে সেই বাড়ি ভেঙে যায়। পরে থেতরাই শেখের খামার গ্রামে ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেন তারা। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় সেখান থেকেই হারিয়ে যায় তার বোন। এখনও মাকে নিয়ে সেখানেই বসবাস করছেন তারা। এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, বাবা-মাকে খুঁজতে আসা মেয়ে রওফা ও কন্যাকে খুঁজে ফেরা মা ওকিতনের বর্ণনার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। তবে পুরো ব্যাপারটি যাচাই করে দেখা যেতে পারে। এ ব্যাপারে রওফাকে বাংলাদেশে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান ইনফ্যান্টস ডু মনডে’র কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর রাকিব আহসান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমাদের সোর্সদের কাজে লাগিয়ে আমরা রওফার মা-বাবা এমনকি তার স্বজনদের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু কেউ কোনও তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেনি। তবে কেউ যদি কখনও খোদেজার মা-বাবা হিসেবে পরিচয় দাবি করেন, সে বিষয়ে আমরা সঠিক তথ্য উপাত্তসহ ডিএনএ টেস্ট করিয়ে শতভাগ নিশ্চিত হবো। কেননা আমরা চাই না এই সময় এসে রওফা কোনও প্রতারণার শিকার হোন।’