২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। ক্ষমতার লোভ তাঁকে ভালোই পেয়ে বসেছে। ভারত সফর করে, কোনো সবুজ সংকেত পেলেন না, পেলেন কয়েকটা ঘোড়া। এবার ঠিক করলেন মার্কিন মুলুকে যাবেন। সেখানে যদি কোনো অভয়বাণী শুনতে পান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর অনেক কর্মসূচি। জনগণের টাকায় এসব কর্মসূচির আয়োজন করতে ব্যস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস।এসব কর্মসূচির মধ্যে আয়োজন করা হলো ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনার। বিশ্বের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় হাভার্ডে আয়োজিত এই সেমিনারে প্রধান বক্তা সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন। কেনেডি স্কুলের এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত তরুণ শিক্ষার্থীরা।

সেনাপ্রধান তাঁর মূল প্রবন্ধ শেষে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন নেবেন। বলে রাখা ভালো, এই কেনেডি স্কুল হলো নেতা তৈরির কারখানা বিশ্বের অন্তত ১০০টি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা কেনেডি স্কুলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জেনারেলের মূল প্রবন্ধের পর হাত তালি হলো সামান্যই। জেনারেল মনে করলেন, হাভার্ডের শিক্ষার্থী, এরা বোধহয় সহজে হাততালি দেয় না। প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রথম দুটি প্রশ্ন ভালো ভাবেই উতরে গেলেন জেনারেল। তৃতীয় প্রশ্ন করতে উঠে দাড়ালেন, এক দীপ্ত তরুণ, বললেন আমার দুটি প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন কোনো সভ্য দেশে কি বিনা বিচারে কাউকে আটক করা যায়? জেনারেল মৃদু হেসে উত্তর দিলেন ‘অফকোর্স নট। আমরা সেটা করছিও না।’
এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন, আমার মায়ের কী অপরাধ, কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করেছেন? এবার জেনারেল বিব্রত। পুরো সভাস্থলে পিন পতন নিস্তব্ধতা। জেনারেল বললেন ‘আমি ব্যাপারটা দেখব।’ তরুণ বললেন ‘আমার মাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কারণ তিনি গণতন্ত্র চান, কারণ তিনি দেশের মানুষকে ভালোবাসেন’। হলভর্তি শিক্ষার্থীরা করতালি দিলো। সভা শেষে কেনেডি স্কুলের চেয়ার সেনাপ্রধানকে বললেন ‘কাউকে জোর করে আটকে রেখে গণতন্ত্র হয় না’। জেনারেল মঈন বুদ্ধিমান। তিনি বার্তা বুঝে ফেললেন। ওই দীপ্ত তরুণের নাম সজীব ওয়াজেদ জয়।
জয়ের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ এ। যখন তাঁর মা, নানী বন্দী পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। ধানমন্ডির একটি বাড়িতে তাঁদের আটকে রাখা হয়েছিল। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছিল মাত্র কয়েক দিনের জন্য। নানা, তখন বন্দী পাকিস্তানি কারাগারে। মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। পুরো দেশ এক অসম যুদ্ধে। তাদের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু এবং চোখে স্বাধীনতা স্বপ্ন। নানা আগেই বলে রেখেছিলেন, জয় বাংলার ‘জয়’ই হবে নাতির নাম। মাত্র ৪ বছর বয়সে দেখেছেন মায়ের সর্বস্ব হারানোর ব্যথা। মায়ের কান্না, আর্তনাদ, আহাজারি কতটা বুঝেছে এই শিশুটা? ১০ বছর বয়সে, মায়ের ব্যস্ততা দেখেছে সে। মায়ের জন্য অপেক্ষা করেছে, কেঁদেছে। রাজনীতিতে ব্যস্ত মা সন্তানের জন্য তাঁর আকুতি, কান্না লুকিয়ে জনগণের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ সময় কিশোরটি গেছে বোডিং স্কুলে। অপেক্ষা করেছে, মা কবে আসবে। মায়ের হাতের রান্না যে তাঁর প্রিয়। জয়ের শিশুকাল আর কৈশোর ছিল এমনই।
আর দশটা সন্তানের মতো মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়া তাঁর হয়নি। মায়ের সঙ্গে পড়তে বসা হয়নি। মায়ের হাতে রান্না খাওয়াও হয়নি নিয়মিত। কিন্তু তাঁর মা তাঁকে গড়েছেন আদর্শ দিয়ে। তাঁর মা তাঁকে তৈরি করেছেন, নতুন যুদ্ধের এক সৈনিক হিসেবে। যে সন্তান হবে উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী, আদর্শবান এবং সৎ।
শেখ হাসিনা তাঁর সন্তানদের এভাবেই মানুষ করেছেন। জয়ের সম্পর্কে অনেক কথাই বলা হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার, তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবের নেপথ্য কারিগর। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে, মনে হয় জয়ের সবচেয়ে বড় পরিচয় জয় মায়ের ছেলে। মায়ের দু:খে সে ব্যথিত হয়। মায়ের স্বপ্নের সে সারথী হয়। আবার দিন শেষে এই বয়সেও মায়ের আঁচলে মুখটা মুছে সব ক্লান্তি নিংড়ে ফেলতে চায়। মায়ের রান্না খেতে ছুটে আসে সুদূর আমেরিকা থেকে।

সমাজের সব থেকে বড় শক্তি সম্ভবত পরিবার। বাবা-মা সন্তানদের সুশিক্ষায় গড়ে তুলবে। সন্তানরাও বাবা-মায়ের আদর্শ অনুসরই করবে। সবগুলো পরিবারের মধ্যে যদি এই চর্চা হয়, তাহলে সমাজ শক্তিশালী হয়, রাষ্ট্র হয় বিকশিত। আমাদের সমাজে পরিবার বন্ধন গুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। সন্তান বাবা মায়ের জন্য আবেগ অনুভব করে না। এখানেই জয় এর অনন্যতা। জয় যেমন হাভার্ডে দাড়িয়ে সেনাপ্রধানকে নি:সংকোচে প্রশ্ন করে, তেমনি ভুল সংবাদ পরিবেশনের জন্য সম্পাদকের শাস্তি দাবি করে। মায়ের ভালো কাজে সহযোগিতা করে, কর্তৃত্ব চায় না। মাকে ধমকে রাজনীতি শেখায় না। আমাদের সমাজে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ অনেক হবে। অনেক জ্ঞানী মানুষও হবে। কিন্তু মায়ের ছেলে ক’জন হবে এই ভঙ্গুর সমাজে? আমাদের জয় মায়ের ছেলে। আজ এটা যে বড় প্রয়োজন।

 

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn