মা দিবসের ভাবনা
আসমা হক-
‘মা’ শব্দটি পৃথিবীর সবচেয়ে দামি। মা-শুধু একটি শব্দ বললে ভুল হবে। মা হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান, মা হচ্ছে একটি খুঁটি, মা হচ্ছে একটি বটবৃক্ষ। একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হলে যেমন তার সুফল মানুষ ভোগ করতে পারে, একটি শক্ত খুঁটিকে আঁকড়ে ধরে মানুষ যেমন দিগ্বিজয় করতে পারে, একটি বট বৃক্ষের ছায়াতলে মানুষ যেমন শান্তির নীড় হিসেবে ঠাঁই খুঁজে পায়, ‘মা’ হচ্ছে সেইরকম একটি অতিআশ্চর্য অতিমানবীয় নাম।
যুুক্তরাষ্ট্রের আনাজারভিসের হাত ধরেই ১৯০৮ সাল থেকে মা-দিবসটি পালন করা শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী। যদিও এই দিবসটি মানবজাতির সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই পালিত হতে পারত বা হলে কোনো সমস্যাও ছিল না। কারণ, মায়ের গুরুত্ব মানবজাতি ছাড়াও প্রতিটি সৃষ্টিকুলের মধ্যে একই মাতৃত্ব প্রবহমান। জ্ঞান-বিজ্ঞানও সৃষ্টির প্রসারতার ফলে আজ হয়ত আরো মায়ের আত্মত্যাগ, গুণাবলী ইত্যাদি নিয়ে অনুসন্ধান করার সুযোগ লাভ করছি এবং মানুষকে জানাতে পারছি। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ব্যাতিরেকে মায়ের গুরুত্ব সবসময়ের জন্য অপরিসীম এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর একটি মাত্র দিনের জন্য মাকে স্মরণ করা বা মায়ের অবদান পরিমাপ করার কোনো যৌক্তিকতাও নেই। তবে মা-দিবস উদ্যাপনের শুরুর আগে মাকে নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পৃথিবীতে ছিল না। এই দিবসটি উদযাপনের ফলে মায়ের কর্ম, আত্মত্যাগ, অবদান ও গুণের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি শুরু হলো যা আরো অনেক ইতিবাচক দিক হিসেবে মনে করি।
পৃথিবীর সৃষ্টির প্রারম্ভে বা আদিমযুগে সংসারে মা-ই ছিলেন প্রধান। মা-ই ছিলেন সর্বেসর্বা। নৃ-তাত্ত্বিক ভাষায় যাকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বলা হয়। কালের বিবর্তনে ও যুগের পরিবর্তনে সেই মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে বা সমাজ রূপান্তরের মাধ্যমে পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা শুরু হয়। যা বর্তমান সমাজ কাঠামোতে বিদ্যমান। একটি পরিবারকে সুখী করা বা হওয়ার পেছনে মায়ের ভূমিকা অসংখ্য। পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করাটা যুক্তিযুক্ত নয়। বর্তমান সামাজিক কাঠামোর আদলে মা তিলতিল করে একটি পরিবারকে করে তুলেন একটি জগত্ সংসার। যে সংসারের আমরা সবাই হচ্ছি একেক জন সদস্য। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় মা হচ্ছে একটি যন্ত্র যে কিনা সন্তানদের জন্মদান ও লালনপালন করে বড় করে তোলে। কিন্তু মাকে দেখার কেউ নেই। সংসার, সন্তান-সন্তুতি ও স্বামী সামলানোই হচ্ছে মায়ের একমাত্র ও প্রধানতম কাজ। তার কোনো নিজস্বতা নেই, তার কোনো দুনিয়া নেই, তার কোনো শখ বা আহলাদ নেই বা থাকতে পারে না। মা শুধু সংসারের একজন সেবক হিসেবে সব দায়িত্ব পালন করে যাবে এবং দিন শেষে তার জন্য থাকবে শুধু অবহেলা, অযত্ন, অত্যাচার, নির্যাতন, লাঞ্ছনা এবং গঞ্জনা।
ছেলে-মেয়ে একসময় বড় হয়ে যায়, স্বামী তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই সময়মতো পূরণ করে নেয় এবং সবশেষে মায়ের জন্য পড়ে থাকে অযত্ন ও অবহেলা এবং উত্কণ্ঠা। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই মা-ই কত কষ্ট, অপমান ও নির্যাতন সহ্য করে সে তার নিজের সংসারকে ভালো রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করে যায়। কোনো মা-ই কোনো সংসারের অমঙ্গল চায় না। কিন্তু ভাগ্যচক্রের খেলায় মাকেই সকল মন্দ কাজের ভার নিতে হয় এবং লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। পরিবারের বাকী সদস্যরা কেউই মন্দ কাজের ভার নিতে চায় না। সবাই সবার সুবিধাটুকু হিসেব করে নিয়ে নিতে চেষ্টা করে। তবে হ্যাঁ, এর বাইরেও মায়ের অনেক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজ কাঠামোতে বিদ্যমান আছে। তবে সেটা সাধারণ দৃষ্টান্তের মধ্যে পড়ে না। ক্ষেত্র বিশেষে সেগুলো দেখা যায়। কিন্তু দু’একটি দৃষ্টান্ত তো আমাদের জন্য সুখকর হতে পারে না। প্রায়শই আরো দেখতে পাই, কিছু কিছু রত্নগর্ভা মাকে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু আমাদের পুরো সমাজের আনাচে-কানাচে কত রত্নগর্ভা মা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন কে তাদের খোঁজ রাখে বা রাখছেন।
আমাদের সমাজ কাঠামোয় পুরুষতান্ত্রিক বা পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব এতটাই প্রভাব বিস্তার করে আছে যে মা-নামের একটি সুউচ্চ্ কাঠামোর দিকে কারোর নজর পড়ছে না। এছাড়াও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বা পাঠ্যপুস্তকে মায়ের অবদান বা কাজকে মূল্যায়ন করার বিষয় সু্স্পষ্টভাবে বিদ্যমান না থাকার কারণে এই ফাঁক থেকেই যাচ্ছে। ফলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মতোই ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েই মা-নিয়ে ভাববার বা চিন্তা করার কোনো তাগাদাও অনুভব করছে না। তবে এর যে ব্যতিক্রম নেই তা নয়। মনের কষ্টে ও সংসারের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে অনেক বাবা-মা-ই বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকছে বা থাকার চিন্তা করছে। এটা খুবই দুঃখজনক।
কোনো মা-ই চায় না তার ছেলে-মেয়েরা অসুখী থাকুক বা খারাপ থাকুক। কিন্তু জীবনচক্রের অশুভ খেলা মা-কে সেই সুখ দেখা বা উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত করছে বা মা-দের বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে। পরিশেষে, মা দিবসের ভাবনায় আমরা মনে করি, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিবর্তন এই অবস্থা অনেকখানি বদলে দিতে পারে এবং ছোটবেলা থেকেই ছেলে-মেয়েদের সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে যাতে মায়ের যোগ্য মূল্যায়ন করতে কেউ কুণ্ঠাবোধ না করে। একটি সমাজ তখনই একটি সুস্থ ও সুখী সমাজে রূপান্তর হতে পারবে যখন সেই সমাজে মাকে তার সঠিক মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। মাকে অবমূল্যায়ন করে বা তার অবদানকে খাটো করে কোনোক্রমেই পরিবারকে বা সমাজকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা, মাকে অবজ্ঞা করার এই ধারাবাহিকতা পরবর্তী প্রজন্মকে একই বার্তা দিয়ে যাবে এবং তাতে করে সুস্থ ও সাবলীল সমাজের রূপান্তর ঘটানোও সম্ভব হবে না। এজন্য আমাদের প্রয়োজন শুধু মা- দিবস নয় বছরের প্রত্যেকটি দিনই মাকে নিয়ে চিন্তা করা। তবে আমি মনে করি, সব সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাকে নিয়ে একটি ক্লাস বা সেশন থাকা উচিত, যে ক্লাসে বা সেশনে মাকে নিয়ে চর্চা করা হবে এবং যাতে আগামী প্রজন্ম সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে নতুন, উন্নত ও বিবেকবান সমাজ ব্যবস্থা আমাদেরকে উপহার দিতে পারে।
লেখক :মহিলা ও শিশু বিষয়ক সম্পাদিকা, উত্তরা ১৩ নং সেক্টর কল্যাণ সমিতি, ঢাকা