মিশরের সিনাইতে ভয়াবহ হামলার নেপথ্য কারন
মুহাম্মদ নোমান:বাক রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। মিসরের সিনাইয়ের একটি এলাকার নাম ‘বি’র আল আব্দ’। এই এলাকার সবচেয়ে বড় মসজিদ হচ্ছে ‘আর রাওদাহ’ গ্রামের ‘আলে জারীর মসজিদ’। এলাকা হিসেবে মসজিদটি অনেক বড়ই বলা যায়। প্রায় ১৫০০ মুসল্লি একসাথে নামাজ পড়তে পারে। গতকাল শুক্রবার ইমাম সাহেব জুমার খুতবা দেয়ার জন্য মিম্বারে উঠেছেন, এমন সময় মসজিদে ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করে একদল মুখোশধারী সন্ত্রাসী। হ্যান্ড গ্রেনেড এবং স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র নিয়ে মুসল্লিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্র্যান্ডের মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ এবং স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধাস্ত্রের ব্রাশফায়ারে লুটিয়ে পড়ে শতশত মুসল্লী। মসজিদে বয়ে যায় রক্তের বন্যা। দরজা দিয়ে কিংবা জানালার কাঁচ ভেঙ্গে যারা পালাতে চেয়েছিল তাদেরও শেষ রক্ষা হয় নি। তাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিলো আরেকদল নরপিচাশ। নারকীয় হত্যাকাণ্ডের এখানেই শেষ নয়। আহত মুসল্লিদেরকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, তখন রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে এম্ব্যুল্যান্স আটকে দেয়া হয় এবং আহত ও উদ্ধারকারী লোকগুলোকেও সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে সন্ত্রাসীরা ৩ টি জীপে করে এসেছিল এবং অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে, সম্পূর্ণ কমান্ডো স্টাইলে হামলা করেছিলো। মিসরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বক্তব্য মতে ঘটনাস্থলে এবং হাসপাতালে নেয়ার পরে যারা নিহত হয়েছে তাদের সংখ্যা ২৩৫ জন। আরও ১০৯ জন মতো আহত, যাদের অধিকাংশের অবস্থা আশংকাজনক।
এই হল ঘটনার মোটামুটি বিবরণ। এমন মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা মিসরে আর ঘটেনি। তাছাড়া ইতিপূর্বে বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলেও মসজিদে কোনদিন হামলা হয়নি। খ্রিষ্টানদের গির্জায় প্রায়ই হামলা হয়। কিন্তু ইসলামী কোন স্থাপনায় এধরণের হামলা এ-ই প্রথম।ঘটনার ভয়াবহতা এবং হামলাকারীদের স্টাইল দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এটি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। ছোটোখাটো কোন অপরিণামদর্শী গোষ্ঠীর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাও নয়। এর পেছনে থাকতে পারে অনেক বড় কোন সংঘবদ্ধ শক্তি। ঘটনার শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত থাকতে পারে। কারা থাকতে পারে এর নেপথ্যে- তা যদিও নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবে ঘটনার পটভূমি এবং মিসরের ভূ-রাজনৈতিক বিভিন্ন পটপরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য করলে এর সম্ভাব্য কারণগুলো বের করা কঠিন হয় না। এধরণের ঘটনার নেপথ্যকারণ অনুসন্ধান করার নীতি হচ্ছে- ঘটনার সময়টা এবং ঘটনার সাথে স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিখুঁত ভাবে চিহ্নিত করা।
১.
মিসরের সরকারী বক্তব্য হচ্ছে- আইসিসই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এর পক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন যুক্তিও দাঁড় করানো হচ্ছে। যেমন- সিনাই অঞ্চলে ‘আহমাদিয়া’ এবং ‘জারীরীইয়া’ নামে দুটি সুফীবাদী ফেরকার মানুষ বসবাস করে। এই মসজিদটি ‘জারীরীইয়া’দের মসজিদ। সিনাইতে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যারা মিশরীয় সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করছে- জারীরীয়ারা তাদের অন্যতম। তাই প্রতিশোধ নিতে আইসিস এই হামলা করেছে।এটি সরকারী বক্তব্য। আইসিস যদিও এখনও পর্যন্ত দায় স্বীকার করেনি, কিন্তু সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কারণ, প্রথমতঃ আইসিস ধ্যানধারণায় যারা প্রভাবিত তাদের পক্ষে এরকম হামলা করাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কাবুলে এবং সৌদি আরবের মসজিদে তাদের হামলা করার রেকর্ড রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ গতবছর সিনাইতে তারা শায়খ সুলাইমান নামে একজন ৯০ বছরের প্রবীণ বৃদ্ধ গোত্র-প্রধানকে ‘তাবিজ-দোয়া করা’র অপরাধে প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ করে হত্যা করেছিলো। শুধু তাই নয়, জবাই করার দৃশ্য রেকর্ড করে আইসিসের ওয়েব সাইট থেকে প্রচার করা হয়। জবাই করার পূর্বে এক আইসিস সন্ত্রাসী একটি বক্ত্যব্য প্রদান করে। এতে সে হুংকার দিয়ে বলেছিল যে, ‘সিনাইয়ের সকল ভ্রান্ত মুরতাদ সূফীদেরকে এভাবে হত্যা করে সিনাইয়ের মাটিকে পবিত্র করা হবে’।
২.
মিসরের গির্জাগুলোতে প্রায় সময় রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। বিগত ৪/৫ বছরের কায়রো জীবনে এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা নিজ চোখে দেখেছি। কিছুদিন পূর্বেও কায়রোতে এরকম একটি ঘটনায় শতাধিক খ্রিষ্টান হতাহত হয়েছিলো। প্রত্যেকবারই খ্রিষ্টানরা প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়ে হুংকার ছাড়ে- রক্তের বদলে রক্ত নেব। অতীতে তাদের হুমকি বাস্তবায়ন করার কোন রেকর্ড না থাকলেও কোন সময়ই যে করবে না- তার তো কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে, এই ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা থাকলেও বেশ কিছু কারণে একে দুর্বল মনে হয়। কারণ, তাদের এমন কাজের জন্য কায়রোর মসজিদগুলোই আদর্শ জায়গা। তাছাড়া, সিনাইতে গিয়ে এমন কিছু করার সামর্থ্য তাদের আদৌ আছে বলে মনে হয়না।
৩.
মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সরকারবিরোধী মনোভাব দিনদিন চাঙ্গা হচ্ছে। বিরোধী শক্তিগুলো পরস্পরের কাছাকাছি আসছে। এমন কি ২০১৩ সালের সামরিক ক্যু পরবর্তী সময় থেকে নিয়ে ইসলামপন্থীদের প্রতি যে নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা চলে আসছিলো- এখন তা স্তিমিত হয়ে আসছে। বড় একটি অংশের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত হয়েছে যে, আমাদের একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। আর বেশী কিছু বলবো না। বুঝে নেন।
৪.
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে যখন এই ধারা যুক্ত করা হয়েছিলো যে, ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন নামে দুটি রাষ্ট্র তৈরি করা হবে- একটি ইহুদীদের জন্য আরেকটি আরবদের জন্য, তখন ইসরাইলীরা সেই চুক্তিতে সাক্ষর করতে চায় নি। তখন ক্যাম্প ডেভিডের মূল কারিগর হেনরি কিসিঞ্জার ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী মোনায়েম বেগিনকে বলেছিলেন- চুক্তি আর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তো এক নয়। দেখুন না কী হয়। আমাদের উপর আস্থা রাখুন। একদিন এর সুফল ভোগ করবেন। তখন থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যে, আমেরিকানরা কোনদিনই একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ছিল না। এখনও নেই। দুনিয়ার চোখে ধুলো দেয়ার জন্য এতদিন আলোচনা আলোচনা খেলে আসছিলো। কিন্তু আর কতো দিন! ৪০ বছর ধরে এই খেলা খেলতে খেলতে তারা এখন নিজেরাই ত্যাক্ত-বিরক্ত। তাই এখন আমেরিকা মুখোশ খুলে আসল কাজ সেরে ফেলতে চায়। তার কিছু ইশারা ট্রাম্পের নির্বাচনী বক্তব্য থেকেই আঁচ করা গিয়েছিলো।
ট্রাম্পই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি কুদসকে ইসরাইলের বৈধ রাজধানী মনে করেন এবং তেলআবীব থেকে কুদসে আমেরিকান এমব্যাসি স্থানান্তর করার ঘোষণা দেন। পশ্চিমতিরে বসতি স্থাপন করার গ্রীন সিগন্যাল দেন এবং নিজের যায়নবাদী ইহুদী জামাতার মাধ্যমে বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ সহায়তার ব্যাবস্থা করেছেন। এগুলো তো কিছুটা আলামত। আসল কাহিনী এগুলো না। মূল কাহিনীটা হচ্ছে- ‘ডীল অব দ্যা সেঞ্চুরী’ বা ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে জেনারেল সিসির প্রথম আমেরিকা সফরের পর থেকেই এই ইস্যুটি দুনিয়ার সামনে আসে। স্বয়ং আমেরিকান মিডিয়াগুলই এটি ফাঁস করেছে। পরে সিসির ভাষণে এবং মিশরীয় মিডিয়ায় হরহামেশাই শুনা যেতে থাকে এই শব্দটি। এই চুক্তির খোলাসা হচ্ছে- ফিলিস্তিন সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করে ফেলা। কীভাবে করবে? মিয়ানমার স্টাইল। গোটা ফিলিস্তিন ইসরাইল হবে। সেখানে আরবদের কোন স্থান হবে না। ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা ল্যান্ড খোঁজা হবে এবং তাদেরকে সেখানেই পুনর্বাসন করা হবে। বিকল্প ভূমির তালিকায় প্রথমেই আছে মিসরের সিনাইয়ের নাম। এটি কেবল ধারণা-প্রসূত কথা নয়। স্বয়ং ইসরাইলী মিডিয়ায় বেশ কয়েকবার এ ব্যাপারে রিপোর্ট করা হয়েছে। এই ঘৃণ্য চক্রান্তে মিসরের পাশাপাশি আমেরিকাকে সহযোগিতা করছে সৌদি আরব।
কিছুদিন পূর্বে লেবানন সমস্যা তৈরি করার পরে মাহমুদ আব্বাসকে সৌদি আরবে ডেকে নেয়া হয় এবং এই চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হতে চাপ দেয়া হয়। না হলে পদ ছেড়ে দিতে বলা হয়। হামাসের সাথে চলমান সন্ধির সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। যখন চুক্তি এবং শর্তগুলো মানতে ফাতাহ ইতস্তত করছিলো তখন আমেরিকা চাপ সৃষ্টি করার জন্য ওয়াশিংটনে ফাতাহের অফিসের লাইসেন্স নবায়ন করবে না বলে হুমকি দেয়। ফিলিস্তিনি অথরিটিকে দেয়া আমেরিকার অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার ইঙ্গিত দেয়। মার্কিন চাপ যে সফল হচ্ছে তার প্রমান- গত পরশু কায়রোয় ফাতাহ-হামাসের বৈঠক কোন উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত ছাড়ায় শেষ হয়। হামাসের কাছ থেকে গাজার দায়িত্ব নিলেও হামাস সরকারের অধীনে চাকরি করা কোন কর্মচারীর বেতন দিবে না বলে ঘোষণা দেয়। এই সবের পেছনে কলকাঠি নাড়া হচ্ছে ওয়াশিংটন আর রিয়াদে। হামাসের এগুলো না বোঝার কথা নয়। তাই, এই প্রথম গতকাল খালেদ মেশাল ডীল অব দ্যা সেঞ্চুরী নিয়ে মুখ খুলেছেন এবং জীবন দিয়ে হলেও এর প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েছেন।
কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে- সিনাইতে এখনও প্রচুর মিসরী বসবাস করে। তাহলে তো সিনাইকে খালি করার একটা প্রয়োজন সামনে চলে আসে। আসল নেপথ্য-কারণ তো জানি না। কিন্তু সিনাইয়ের কালকের ঘটনার পর থেকে আমার কেবলই দুঃখিনী ‘ফিলিস্তিনে’র কথা মনে আসছে। আমার মন কি ভুল চিন্তা করছে? দোয়া করি যেন আমার আশংকাটি মিথ্যা হয়। রহম করো মালিক!