যাদুকাটা নদীর তীরে পণতীর্থ বারুণী স্নান আজ
গোলাম সরোয়ার লিটন- ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে এই তীর্থের সূচনা করেন শ্রীমান অদ্বৈত আচার্য প্রভু। মানুষ তাকে গৌরাঙ্গ ঠাকুর বলে জানে। তাঁর জন্মস্থান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের নবগ্রামে। নদীভাঙনে নবগ্রাম আজ বিলীন। সে সময় নবগ্রামের অবস্থান ছিল লাউড় রাজ্যের লাউড়ের গড় এলাকায়। বর্তমানে মন্দির গড়ে উঠেছে যাদুকাটা নদীর তীরবর্তী লাউড়েরগড়ের পার্শবর্তী রাজারগাঁও গ্রামে। প্রতি বছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে পুণ্যস্নানের জন্য এই স্থানে কয়েক লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। এখানে ভক্তরা স্নান ও তর্পণ করেন। এই পণতীর্থ প্রতি বছর একবারই হয়ে থাকে। এই দিন ও ক্ষণের জন্য ভক্তরা অধির আগ্রহে থাকেন পুরো বছর। আজ ২৫ মার্চ শনিবার যাদুকাটা নদীর তীরে সমবেত হবেন পুণ্যার্থীরা। এ বছর স্নানের সময় আজ শনিবার রাত ১২টা ৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ড হতে পরদিন রোববার (২৬ মার্চ) সকাল ১১টা ১৩ মিনিট ৫১ সেকেন্ড পর্যন্ত।
ঐতিহাসিক সূত্র মতে জানা যায়- প্রাচীন শ্রীহট্ট এক সময় জৈন্তা রাজ্যের অংশ ছিল। পরবর্তীতে তিনটি অংশে বিভক্ত হয়। রাজ্য তিনটির নাম ছিল জৈন্তা, গৌড় ও লাউড়। ভারতের আসাম কামরুপ থেকে রাজা কামসিন্ধুর বিধবা স্ত্রী উমরী রাণী জনৈক প্রগশপতির দ্বারা হুমকিপ্রাপ্ত হয়ে শ্রীহট্টের উত্তরাঞ্চলে চলে আসেন। ইতিমধ্যে তিব্বতের হাথক শহরের যুবরাজ কৃষক চৌদ্দ ভাগা নদীর তীর ধরে ঘুরে ঘুরে জৈন্তাপুর এসে উপনীত হন। এখানে উমরী রাণীর সাথে পরিচয়ের পর চৌদ্দভাগা তাকে বিয়ে করেন। তাদের একটি পুত্রসন্তান হলে নাম রাখা হয় হাথক। পরবর্তীতে হাথক নামধারী কমপক্ষে ৯ জন রাজা জৈন্তাপুর রাজত্ব করেন। দশম রাজা গোবিন্দ রাজ কেশব দেব একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজত্ব করেন। এরপর হাথকের পুত্র গুহক জৈন্তার রাজা নিযুক্ত হন। গুহক তার তিন পুত্রকে সমানভাবে রাজত্ব ভাগ করে দিলে লুব্দুকের নামানুসারে তাহার অংশের নাম হয় লাউড়। লাউড় রাজ্য বর্তমান লাউড়ের পাহাড় এবং সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীতে লাউড়ের রাজত্ব করেন আচার্য্য পরিবারের অরুণাচার্য্য বিজয় মানিক্য। সর্বশেষ দিব্যসিংহ।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব সাধক অদ্বৈতাচার্য্যর পিতা কুবেরাচার্য্য বা কুবের মিশ্র তর্ক পঞ্চানন রাজা দিব্য সিংহের মন্ত্রী ছিলেন। কুবেরাচার্য ছিলেন পণ্ডিত শাস্ত্রবিদ ও সভা-পণ্ডিত। কিন্তু মন্ত্রী কুবেরাচার্য্যের পর পর ছয়টি সন্তান মারা যাওয়ায় তার মনে ছিল প্রচণ্ড কষ্ট। তাই তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে রাজা দিব্য সিংহের আহবানে তিনি পুনরায় লাউড়ে ফিরে আসেন। কিছুকাল পর ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে তার স্ত্রী নাভা দেবীর গর্ভে এক সন্তান লাভ করেন। কমলের মত সুন্দর বলে তার নাম রাখেন কমলাক্ষ। কমলাক্ষের মাতা নাভাদেবী স্বপ্নে দেখতে পান তার ক্রোড়স্থ শিশু শঙ্খচক্র গদাপদ্মধারী মহাবিষ্ণু। তার অঙ্গজ্যোতিতে চারদিক আলোকিত, মুখে দিব্য আভা। হতবিহবল নাভা দেবী সেই স্বর্গীয় মূর্তির সম্মুখে প্রণত হয়ে শ্রীচরণোদন প্রার্থনা করেন । কিন্তু মাতা কর্তৃক সন্তানের পাদোদক প্রার্থনা করা অনুচিত। তাই স্বপ্ন ভেঙে গেলে নাভা দেবী মহাচিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কমলাক্ষের অনুরোধে স্বপ্নের সকল বৃত্তান্ত তাকে খুলে বলেন। সবশেষে বললেন সপ্ততীর্থ বারি অবগাহনের ভাগ্য কি আমার হবে? মায়ের অভিলাষ পূরণে কমলাক্ষ হাত মুষ্টি করে বললেন- “সপ্ততীর্থ হানি হেথায় করিব স্থাপন”। আজ রাতে সকল তীর্থের এখানে আগমণ ঘটবে এবং আগামী প্রাতে মাতা সে তীর্থ বারিতে অবগাহন করবেন। নিকটস্থ শৈল শিকড়ে কমলাক্ষ অবস্থান করে প্রভাতে ঘণ্টাধ্বনি করলেন। সাথে সাথে সকল তীর্থবারী অঝোর ধারায় বইতে শুরু করল। কমলাক্ষের মাতা নাভা দেবীর যেন বিশ্বাস হতে চায়না-মনে প্রশ্ন জাগে এ সত্যই কি সপ্ততীর্থ? কমলাক্ষ তার মায়ের সঙ্গে সপ্ততীর্থ বারিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই হল শ্যামার সামৃত যমুনা, পাপনাশিনী গঙ্গা এবং রক্তপীথ আদি তীর্থ বারী। আনন্দ উৎফুল্ল মনে জননী তীর্থগণকে প্রণাম করে সপ্ততীর্থ বারিতে অবগাহন করলেন। সেই থেকে এই তীর্থের নাম হল পণতীর্থ।
তীর্থগণ পণ করে গিয়েছিলেন পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন প্রতি বছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে তীর্থগণের আগমন ঘটবে এখানে। এই সত্য আজো প্রতিফলিত হয় যাদুকাটা নদীর তীরে । এ পুণ্য তিথিতে বেড়ে যায় জলের ধারা । প্রতি বছর এই সময়ে কয়েক লক্ষ মানুষের আগমণে নিভৃত এই জনপদে নেমে আসে অফুরন্ত প্রাণ চাঞ্চল্য। সকলেই এই পুণ্যসলিলার পুতঃ বারীতে স্নান করে ধন্য হন, নিজেকে করেন কলুষমুক্ত। তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- জয় জয় অদ্বৈতাচার্য্য দয়াময়, যার হুঙ্কারে গৌর অবতার হয়।