পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়ার কিশোর পরিতোষ সরকার রোববার বিকালে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি পোস্ট দেয়। ওই পোস্টটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে বিকালে বটেরহাট মাঝিপাড়ায় পরিতোষের বাড়ি ঘেরাও করে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় একটি মন্দিরসহ আশপাশের বেশকিছু বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় হামলাকারীরা। পরিতোষ সুযোগ বুঝে পরিবারসহ বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এড়াতে বাদ মাগরিব রামনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম সাদেক ও মসজিদের ইমাম পরিতোষের বাড়িতে ছুটে যান। অবস্থা বেগতিক হলে রাত ৮টায় পুলিশ এসে পরিতোষের পুরো বাড়ি ঘেরাও করে স্থানীয়দের বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে। রংপুর পুলিশ লাইন্স থেকে বাড়তি পুলিশ পাঠানো হয় সেখানে। উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মাঝেই রাত ১০টায় পার্শ্ববর্তী আধা কিলোমিটার দূরে ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত বড় করিমপুর, কসবা ও উত্তরপাড়া এলাকায় ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়ে লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। এরপর ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে যায় তারা। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রাণ রক্ষায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, দুর্বৃত্তরা হিন্দু বাড়িগুলো থেকে টাকা, স্বর্ণালংঙ্কার, গবাদিপশু লুটপাট করেছে। শেষে পেট্রোল ঢেলে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয়রা জানায়, পরিতোষের বাড়ির পার্শ্ববর্তী গ্রামে হিন্দুবাড়িতে অগ্নিসংযোগের খবর পেয়ে থানা পুলিশ ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, রংপুর থেকে দাঙ্গা পুলিশ, র্যাব, ১৬ প্লাটুন বিজিবি বড় করিমপুর, কসবা ও উত্তরপাড়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। অবস্থা বেগতিক হলে ১০ রাউন্ড টিয়ার শেল ও ৬১ রাউন্ড শটগানের ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। এ সময় দুর্বৃত্তদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। মধ্য রাতে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এদিকে রাতভর অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় বর্তমানে ওইসব গ্রামে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। এদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, বিকাল থেকে ফেসবুকের পোস্ট নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় বাদ মাগরিব পরিতোষের বাড়িতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ছুটে গেলেও পুলিশ প্রথম দিকে বিষয়টি নিয়ে কর্ণপাত করেনি। পরে অবস্থা বেগতিক হলে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে এসে পরিতোষের বাড়ি ঘিরে রাখে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রাম অরক্ষিত থাকায় দুর্বৃত্তরা সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে।
রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, বিষয়টি শোনামাত্রই পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিল। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তার বাড়ি ঘিরে নিরাপত্তা দেয়াসহ পরিস্থিতি শান্ত করেছে। পুলিশ যখন মাঝিপাড়ায় ব্যস্ত ছিল তখন পরিকল্পিতভাবে পার্শ্ববর্তী গ্রামে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনায় রাতেই রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান, পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার ঘটনাস্থলে ছুটে গেছেন। সোমবার সকালে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আবদুল ওয়াহাব ভূঞা, রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য, বিজিবি উত্তর-পশ্চিম রিজিয়নের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ইয়াছির, ৫১ বিজিবি’র অধিনায়ক ইসহাক আহম্মেদ, পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিরোদা রানী, উপজেলা পূজা উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক সুধীর চন্দ্র রায়সহ অন্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে চাল, ডাল, তেল, লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয় এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস দেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
রংপুর জেলা পুলিশের পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, এ ঘটনা শোনার পর আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। ওই সময় প্রায় ৩ শ’ মানুষ মাঝিপাড়ায় সমবেত হয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যেই পার্শ্ববর্তী গ্রামে পেট্রোল ঢেলে ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে পেট্রোল ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি আমরা মনে করছি এটি সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। যারা দু’মুঠো ভাতের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যারা এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে তারা মানবতাবিরোধী। আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। অপরাধ যেই করুক না কেন, কেউ ছাড় পাবে না।