যুদ্ধের গল্প
সায়েজ বদরুল এর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকেঃঃ
মুক্তি যুদ্ধের সময়। সুনামগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থল পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের কাছেই আমাদের বাসা। বাসার সামনে অনতিদূরে পিটিআই। ওখানেই পাক বাহিনীর আস্তানা। একদিন আমার বড় ভাইকে পাক বাহিনী ধরে পিটি স্কুলের মাঠে তাদের ব্যাংকারে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ঘরে কান্নার শব্দ লুকাতে শিশু ছোট ভাইকে আম্মা বড় বালতির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছেন। আব্বা টেনশন লুকাতে পারলেন না। আম্মাকে ভাইসাবের কথা বলে দিলেন। আম্মা শুনেই অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। আব্বা নামাজে দাড়ালেন, আম্মা জায়নামাজে উপুর হয়ে পড়লেন। আমি ৮/৯ বছরের। তবু সাহস করে দরোজার বাইরে বারবার যাওয়া আসা করি আর পান্জাবীদের কাজ কর্ম দেখি। গুলীর শব্দ সারাক্ষণ শুনা যেতো। আম্মা কিছুক্ষণ পর পর আমাকে চরম নির্ভরশীলতায় জিজ্ঞেস করেন, “দেখা যায় যাদু বাছাইরে”? আমি অসহায় মায়ের মুখ দেখে চোখের পানি ফেলি নিরবে। সেদিন আমি মা আর সন্তান যে কি সম্পর্ক কিছুটা বুঝেছিলাম। আজো আমার মনে স্পষ্ট হয়ে আছে আম্মার এক বিকেলের কষ্টের কথা। সন্ধ্যার একটু আগে আম্মা পুরো প্রস্তুতি নিলেন। পান্জাবীদের ক্যাম্পে যাবেন। ওখানে গেলে আর ফেরা হবেনা জেনেও মা তার ছেলের জন্য জীবন দিতে চলেছে। মিনিটে কয়েকবার আমি বারান্দায় যাই আর আসি। এমনি সময় ভাইসাবকে নিয়ে ব্যাংকার থেকে এক পাকসেনাকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। দৌড়ে এসে আম্মাকে জানালাম। দেখা গেছে। সাহস করে বের হলেন আব্বাও। কি যেনো দেখিয়ে দেখিয়ে ভাইসাবকে বাইরে নিয়ে আসছে। ভাইসাবকে ছেড়ে দিতেই দিলেন দৌড়। আম্মা আবারো ঝাপিয়ে পড়লেন জায়নামাজে। সেদিন আম্মা মহান আল্লাহর শুকরিয়া করতে যেয়ে যা বলছিলেন, সব যেনো কান্নায় ভেসে যাচ্ছিলো। সন্তানের জন্য মায়ের যে কি ঠান কি মায়া যে সন্তান বুঝেনা তার মতো দূর্ভাগা আর নেই। পরে শুনেছিলাম, পান্জাবিরা পাড়ার সব মোরগ ধরে ধরে তাদেরকে সরবরাহ করতে বলেছে। ভাষা না বুঝায় মোরগের “ফইর” দিয়েছে সাথে।
আম্মা ওইদিন রাতেই আমাদের নিয়ে নানার বাড়ী কুতুবপুর চলে গিয়েছিলেন। আমরা এতোগুলো ভাইবোনকে কিভাবে যে আম্মা নয় মাস বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন সেটা মনে হলে আজো হৃদয় তোলপাড় হয়। একদিন দুপুরে প্রচন্ড ক্ষিধেয় কান্না করছি। খাবার কিছু নেই। যুদ্ধের সময় কিছু কেনা ও সহজ ছিলো না। আম্মা রান্নাঘরের কোনায় একটা ঝুলি থেকে একটা ছোট্ট আম বের করলেন। আমার খাদক মনটা বেজায় খারাপ। আমাদের বাড়ীর মরিচ বিছড়ার আম গাছে খুব ছোট্ট মিষ্টি আম ধরতো। আমার খুব পছন্দ ছিলো এ গাছের আম। সেদিন সেই ছোট্ট আম, ভাত আর চিনি মিশিয়ে আম্মা আমাকে যা খাইয়ে ছিলেন আমার জীবনে এতো মজার পেটভরা আমভাত আর খাইনি। মায়ের হাতের খাবার এখনো যাদের ভাগ্যে আছে, আমার চোখের জলের কসম দিয়ে বলছি তোমরা লেট না করে লুটিয়ে পড়ো তোমার ঘরের বেহেশত তোমার মায়ের পদতলে। কখনো কোনো কারনে মায়ের পা ছেড়োনা। জীবনের সব কিছুর বিনিময়ে একজন মা পাওয়া যায় না।