যেভাবে তছনছ হয় জঙ্গী ফাতেমার সুখী সংসার
জঙ্গীবাদের ভয়াল থাবায় তছনছ হয়ে গেছে সুখী সুন্দর পরিবার। আত্মঘাতী জঙ্গী হয়ে গেছে পিতামাতা ও তাদের যমজ পুত্র। এদের মধ্যে পুলিশের অভিযানকালে আত্মহত্যা করেছে পিতা। আর মা মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে ও বঁটি দিয়ে কুপিয়ে আহত করেছে পুলিশকে। গুলি চালিয়ে পুলিশকে হত্যার সময় হাতেনাতে গ্রেফতার হয় সে। আর যমজ দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলেকে পিতা নিজে বাঁচতে গলায় ছুরি ধরে হত্যার চেষ্টা করেছিল।
ওই আত্মঘাতী ছেলেও পুলিশের ওপর হামলার চেষ্টা করেছিল। অপর আত্মঘাতী ছেলে পলাতক। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। গত বছর আজিমপুর থেকে গ্রেফতারকৃত আত্মঘাতী নারী জঙ্গী আবেদাতুল ফাতেমা আশা ওরফে খাদিজা ও তার ছেলে তাহরীম কাদেরীর ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে এমন চাঞ্চল্যকর ও হৃদয় বিদারক কাহিনী ছাড়াও স্বামীর মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষিত ওই নারী ও তাদের যমজ ছেলের আত্মঘাতী জঙ্গী হয়ে ওঠার অজানা তথ্য এবং গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার অনেক অজানা ইতিহাস প্রকাশ পেয়েছে।
সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি অভিযানের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগ রাজধানীর আজিমপুরের লালবাগ সড়কের ২০৯/৫ নম্বর পাঁচতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে অভিযান চালায়। অভিযানকালে জঙ্গীদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গ্রেফতারের হাত থেকে বাঁচতে এবং সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যাতে প্রকাশ না পায় এজন্য আত্মহত্যা করে নব্য জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য তানভীর কাদেরী।
অভিযানে গ্রেফতার হয় তানভীর কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা ও তার ছেলে উত্তরার মাইলস্টোল স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তাহরীম কাদেরী ওরফে আবির ওরফে রাসেল ওরফে অনিক ওরফে মুয়াজ ওরফে ইসমাইল, পলাতক নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা জামান ওরফে বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেটের স্ত্রী শায়লা আফরিন ও গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তি। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাতে নুরুল ইসলাম মারজান (২৩) রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এক সহযোগীসহ নিহত হয়।
আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া তিন শিশু সন্তানের মধ্যে দুই জনকে তাদের দাদা-দাদি ও নানা-নানীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর আস্তানা থেকে এক বছরের শিশুপুত্র নিয়ে পালিয়ে যায় রাজধানীর রূপনগরে নিহত জঙ্গী মেজর মুরাদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা। গ্রেফতারকৃত তিন নারী ও এক কিশোর সবাই নব্য জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য। জেবুন্নাহার শিলার স্বামী নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মেজর জাহিদুল ইসলাম মুরাদ ওরফে মেজর মুরাদ গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকার ৩৩ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর ছয়তলা বাড়িতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
আস্তানা থেকে গ্রেফতারকৃত আবেদাতুল ফাতেমা গ্রেফতারের এক মাস পর গত বছরের ১০ অক্টোবর ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক মোঃ নূর নবীর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। তার ছেলে তাহরীম কাদেরীও আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে।
আবেদাতুল ফাতেমার জবানবন্দী থেকে জানা যায়, তার পিতার নাম আবদুত তাওয়াব। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মুন্সেফপাড়ার ২৬৪ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেধাবী ছাত্রী ফাতেমা ১৯৯৬-৯৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হাঙ্গার প্রজেক্টে জড়িত হন। প্রজেক্টে কাজের সুবাদে পরিচয় হয় ঢাকা কলেজের ছাত্র তানভীর কাদেরের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেম। শেষ পর্যন্ত তারা বিয়ে করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ও ২০০১ সালে এমএ পাশ করেন। এরপর সেভ দি চিলড্রেন ও মুসলিম এইডে চাকরী করেন।
জবানবন্দীতে আবেদাতুল ফাতেমা জানান, তিনি ও তার স্বামী ২০১৪ সালে হজ করেন। হজ থেকে ফেরার পরেই স্বামীর মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ২০১৫ সালের শেষ দিকে খেলাফত (ইসলামী শাসন ব্যবস্থা) নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করতে থাকেন। স্বামী ডাচ বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং শাখার হেড অব দি ডিস্ট্রিবিউশন ছিলেন। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেয়। এরপর নিজেই হোম ডেলিভারি ব্যবসা শুরু করে। তার কাছে প্রায়ই মেজর জাহিদের কথা বলতেন। মেজর জাহিদের কাছ থেকে তার স্বামী খেলাফতে জড়ানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। স্বামী আমাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে একাই হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন।
স্বামীর এমন সিদ্ধান্তে আমার মধ্যে ব্যাপক ভয় কাজ করে। কিভাবে একা থাকব? এছাড়া আত্মীয়স্বজনের কাছে স্বামীর বিষয়ে আমি কি জবাব দেব? এমন ভয়ের কথা জানানোর পর স্বামী আমাকে বাচ্চাদের স্কুলে চাকরি করবে বলে লোভ দেখাত। সেখানে অনেকেই শিক্ষিত লোক সমাজ সেবার জন্য চাকরি করছে। আমিও সমাজ সেবার জন্য চাকরি করতে পারব। লোভ আর ভয় থেকেই আমি ২০১৬ সালের মার্চে হিজরত করতে রাজি হই।
এরপর স্বামীর কথামতো আমি এক মাসের নোটিসে সেভ দি চিলড্রেনের চাকরি ছেড়ে দেই। এরপর মেজর জাহিদের হাতে হাত রেখে আমার স্বামী বায়াত (খেলাফতের জন্য আনুগত্য) গ্রহণ করেন। আমি আমার স্বামীর কাছে বায়াত নেই। ২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিল মেজর জাহিদের নির্দেশে আমরা মিরপুরে বাসা নেই। মিরপুরে বাসা নেয়ার পর এ বাসায় রাহুল নামে একজন দেখা করতে আসে। পুলিশ জানায়, রাহুলই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা হামলার আসামি গ্রেফতারকৃত রাজীব গান্ধী।
রাহুল খেলাফতের জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত, তার পরীক্ষা নিয়ে যায়। আমার স্বামীকে সংগঠনের তরফ থেকে (নব্য জেএমবি) প্রশিক্ষণ দিতে দেরি করে। এমনকি সংগঠনের লোকজন তাদের বাসায় দেরিতে যাতায়াত শুরু করে। রোজার আগের মাসেই বাশারুজ্জামান রাহুলকে বাসায় নিয়ে যায়। তারা জানায়, সংগঠনের কয়েকজনের জন্য বসুন্ধরায় একটি বাসা ভাড়া করে দিতে হবে আমার স্বামীকে। রাহুল কয়েক দিন আমাদের বাসায়ই আমাদের ছোট ভাইয়ের মতো থাকে। এরপর বসুন্ধরার বাসায় চলে যায়। পরবর্তীতে তারাও বসুন্ধরার বাসায় চলে যায়।
পুলিশ জানায়, ওই বাসাটি ছিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি গিয়াস উদ্দিনের। বসুন্ধরার বাসায় রাহুল সান, মামুন, শুভসহ পাঁচ জনকে নিয়ে আসে। কয়েকদিন পর রাহুল ওই বাসায় তামিম চৌধুরীকে নিয়ে আসে। পরে ওই বাসায় মারজানও আসে। কয়েক দিন ধরেই বাসায় তারা অবস্থান করে। এরপর বাসাটিতে শুভ তার বাবা, মা এবং প্রায় ২০ বছরের ছেলে হুদয়কে নিয়ে উপস্থিত হয়। তখন তামিম চৌধুরী ওই বাসায় ছিল। মাস্টার বেডে থাকা পাঁচ ছেলে কোন সময়ই রুমের বাইরে বের হতো না। তামিম চৌধুরী বাসায় থাকা তিনটি দলকে ভাগ করে দেয়। আমার স্বামীর অধীন একটি দল। রাহুল আর মাস্টার বেডে থাকা পাঁচ জনকে নিয়ে একটি দল। আর শুভ, তার পিতা ও প্রায় ২০ বছরের ছেলে হুদয়কে নিয়ে একটি দল। কোন দল কোন দলের রুমে যেতে পারবে না বলে তামিম চৌধুরী নির্দেশ দেন।
তামিম চৌধুরী জানায়, মাস্টার বেডে থাকা পাঁচ ছেলে একটি বড় কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হলি আর্টিজানে হামলার আগে শুভ, তার পিতা ও ছেলে হৃদয় বাসা থেকে চলে যায়। গুলশান হামলার সকাল বেলা মাস্টার বেডে থাকা পাঁচ ছেলে, রাহুল ও তামিম চৌধুরী চলে যায়। আমরা মাগরিবের আযানের সঙ্গে সঙ্গে বাসা থেকে নেমে ট্যাক্সিক্যাবযোগে মিরপুরের বাসায় চলে যাই। আমার স্বামী একজনকে এসএমএসের মাধ্যমে একজনকে মিরপুরে চলে যাওয়ার কথা জানায়। তার কিছুক্ষণ পরেই বসুন্ধরায় বাসায় জুনিয়র নামে আসা ছেলেটি আমাদের এসএমএস করে টেলিভিশন দেখতে বলে। আমরা টেলিভিশনে গুলশানে হামলার বিষয়টি দেখতে পাই। পরদিন সকালে অন্য একটি মোবাইল নম্বর থেকে এসএমএসের মাধ্যমে গুলশান হামলায় সবাই শহীদ হয়েছে বলে জানায়। আমার স্বামী সিরিয়ায় মিত্র বাহিনীর হামলা হয়েছে। সিরিয়ায় নিহতদের পাশে দাঁড়ানো উচিত বলে আমার স্বামী আমাকে বলেন।
ঈদের কয়েক দিন পরে মুসা নামে একজন আমাদের বাসায় আসে। মুসা আমাদের নতুন বাসা খোঁজার পরামর্শ দেন। এছাড়া জুনিয়র নামের ছেলেটিও নতুন বাসার খোঁজার কথা বলেন। তারা জানায়, রাহুলকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওইদিনই আমরা রাজধানীর রূপনগরের ৩ নম্বর সড়কের বাসায় শুধু ব্যাগ নিয়ে চলে যাই। এরই মধ্যে কল্যাণপুরের ঘটনা টিভিতে দেখি। এরপর আমরা মিরপুর এলাকা ছেড়ে লালবাগের বাসায় উঠি। এরই মধ্যে জুনিয়র ওরফে মুসা নামের ছেলেটি আমাদের একটি টাকার ব্যাগ দেয়। ইতোমধ্যেই আমাদের যমজ ছেলের মধ্যে আফিফ ওরফে আদরকে কম্পিউটার শেখানোর কথা বলে আমার স্বামী নিয়ে যায়। পরে তার কাছ থেকে মুসা নিয়ে যায়।
লালবাগের বাসায় অবস্থান করার সময়ই নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই সহযোগীসহ তামিম চৌধুরী নিহত হয়। ঘটনার দিন সকাল নয়টা কি দশটার দিকে মেজর জাহিদ এসএমএস দিয়ে আমার স্বামীকে পরিবারসহ তার বাসায় যেতে বলে। আর নারায়ণগঞ্জের ঘটনা টেলিভিশনে দেখতে বলেন। পরে মেজর জাহিদ তার স্ত্রী ও দুই সন্তান, সাব্বির ওরফে মারজানের স্ত্রী, রাহুলের স্ত্রী ও ১০ মাসের মেয়েসহ রাত নয়টার দিকে ওই বাসায় যান। এর ৫/৬ দিন পরই পল্লবীতে মেজর জাহিদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এরপর সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলেন আমার স্বামী। পল্লবীর ঘটনার পর সবার ওই বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। পরে পুলিশ বাড়িতে উপস্থিত হয়। পুলিশ সবাইকে তাদের সামনে এসে উপস্থিত হতে বলে। সবার পরিচয় জানতে চায়। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের কাছে থাকা মরিচের গুঁড়া পুলিশের চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়া হয়। বঁটি দিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করা হয়। পুলিশ গুলি চালাতে থাকে। এমন অবস্থার মধ্যেই আমার স্বামী একটি কক্ষে গিয়ে আত্মহত্যা করেন। এক পর্যায়ে পুলিশ আমার মাথায় আঘাত করে। আমি জ্ঞান ফিরে হাসপাতালের কেবিনে নিজেকে আবিষ্কার করি। তখনই আমার উপলব্ধি হলো, আমি কি করলাম। আমি বন্দী। আমার ছেলে বন্দী। আমার স্বামী আত্মহত্যা করেছে। আমি এখন স্বামী হারা। সোনার সংসার রেখে কি পেলাম আমি এ পথে এসে? আমরা ভুল করেছি। অনুশোচনা হচ্ছে। আমি কেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেলাম? আমি তো রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে পারতাম। আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাই।-নতুন সময়