যেভাবে দাগী আসামি হয়ে যেতে পারেন!
আপনার ফোনে নেটওয়ার্ক নেই, গেলেন মেরামত করতে। দোকানদার বলে দিলেন ‘নেটওয়ার্ক আইসি’ লাগাতে হবে। আপনি তাতেই সম্মত হয়ে গেলেন। আর এতেই আপনার ফোনের পরিচিতি খোয়ালেন। আসল ‘আইএমইআই ’ নম্বর বদলে কোনও দাগী আসামির ব্যবহার করা ফোনের কোড আপনার হয়ে গেলো। এরপর যা হওয়ার তাই হবে। ধরা পড়বেন পুলিশের হাতে। কারণ পুলিশের কাছে প্রমান আছে, আপনি যে ফোন ব্যবহার করছেন সেটি একজন দাগী আসামীর ফোন। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী যে কেউ, এই পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান যেকোনও ধরণের অপরাধী শনাক্তের জন্য মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটির সাহায্যেই মূলত আসামীদের পরিচিতি ও অবস্থান শনাক্ত করা হয়।
গত ছয় মাস ধরে এই পদ্ধতি আর তেমন কাজে আসছিল না। বেশিরভাগ আসামি গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও বেশ কয়েকজন আসামির অবস্থান ও পরিচিতি কোনোভাবেই শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তবে কয়েকজন গ্রেপ্তার হওয়ার পর মোবাইল ফোনের পরিচিতি বদলের এই তথ্য উদঘাটন হয়। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ গত ২৭ এপ্রিল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার টুইনটাওয়ার কনকর্ড শপিং কমপ্লেক্স এর গাড়ি পার্কিং এর গেট সংলগ্ন ফুটপাত থেকে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। এসময় তাদের কাছে মোবাইল ফোনের পরিচিতি কোড ভাঙ্গার কিছু হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের সন্ধান পান গেয়েন্দারা। এগুলোর মাধ্যমে একটি ইলেক্ট্রেনিক্স ডিভাইসের আসল পরিচিতি গায়েব করে নতুন পরিচিতি দেওয়া যায়।
উদ্ধার হওয়া যন্ত্রগুলোর মধ্যে মধ্যে ‘জেড থ্রি এক্স’ নামের একটি ডিভাইস বক্স ছিল। এর মাধ্যমে আরও কিছু সফটওয়্যার ব্যবহার করে পুলিশের তালিকাভূক্ত আসামিদের পরিচয় গোপন করা হতো। সংশ্লিষ্টরা জানান, মোবাইল ফোনের জন্ম পরিচিতি থাকে ‘আইএমইআই ’ নম্বরে। এটি একটি ইউনিক কোড। এর সাহায্যে মোবাইল ফোন কোম্পানির বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। এই নম্বরের সূত্র ধরেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অপরাধীকে শনাক্ত করেন। অপরাধচক্রের তথ্য ও অপরাধের ধরণও জানতে পারেন। মোবাইল ফোনে যে কোম্পানির সিম ব্যবহার করা হোক না কেন, এই নম্বরের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর অবস্থান সহজেই শনাক্ত করা যায়। উদ্ধার করা যায় আসামির ব্যবহার করা ফোনের সিকিউরিটি কোড।
গোয়েন্দা তথ্যমতে, রাজধানীর শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মোবাইল মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন এই পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। অনেকেই হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনের অবস্থান শনাক্ত করতে তাদের কাছে যাচ্ছেন। আবার অনেক আসামিরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তার ফোনের গোপন কোড বদলে ফেলছেন। ফলে ওই ফোনে ব্যবহার করা আগের নম্বরগুলো শনাক্ত করতে পারে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে অপরাধীরা প্রযুক্তিগত ট্র্যাকিংয়ের আওতার বাইরেই থাকে। তাদের ধরা যায় না। ফোনও উদ্ধার করা যায় না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহমুদ নাসের জনি বলেন, ‘শিমুল চন্দ্র পাল ও মামুন নামে দুই মোবাইল ফোন এক্সপার্টকে গ্রেপ্তার করার পর ফোন সেটের গোপন কোড বদলের তথ্য দেয় তারা। টাকার বিনিময়ে অপরাধীদের মোবাইল ফোনের পরিচিতিও মুছে ফেলে দেওয়া হয়। এতে একজন নিরীহ মানুষও হয়রানীর কবলেও পড়তে পারেন।
যেভাবে ‘আইএমইআই ’ কোড বদল হয়
মোবাইল ফোনসেটের নেটওয়ার্ক সমস্যার মেটাতে আইসি বদল করলেই আইএমইআই নম্বর বদলে যায়। নতুন নম্বর বসিয়ে দেন দোকানীরা। এতে নেটওয়ার্ক সমস্যা দূর হয়ে গেলেও ওই সেটে ব্যবহার করা আগের সব সিমের ডাটা মুছে যায়। গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাহমুদ নাসের বলেন, ‘এই পদ্ধতি কেবল নিম্নমানের ও কমদামী সেটের ক্ষেত্রেই বেশি হয়। আইফোনের নম্বর পরিবর্তন করা যায় না। আইফোনের মতো দামী ফোন ছিনিয়ে নেয় না। ভুলে নিলেও রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যায়।’ সংশ্লিষ্টরা জানান, সেটের আইএমইআই নম্বর বদলে ফেলার সফটওয়্যার এখন ইন্টারনেটেই পাওয়া যায়। চোরাই ফোনসেট কেনা-বেচা চক্র এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। চোরাই মোবাইল ফোনসেট কেনা দোকানদাররা দ্রুত বদলে ফেলে আইএমইআই নম্বর। এরপর বিক্রি করে দেয়। এই কারণে চুরির ঘটনায় জিডি বা মামলা হওয়ার পরও ফোনসেট উদ্ধার করা সম্ভব হয়না। গোয়েন্দা তথ্যমতে, রাজশাহী, খুলনা বরিশাল, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুরসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে এমন মোবাইল টেকনিশিয়ানের খোঁজ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তাদের তথ্যমতে ঢাকার ১০০ জনের মধ্যে ৯৫ জন মোবাইল ফোন মেরামতকারী এ অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন।
মাত্র ছয় মাস আগেও আইএমইআই নম্বর বদলের জন্য পাশের দেশ ভারতে যাতায়াত যেতে হতো। এখন এই চক্র দেশে বসেই এই নম্বর বদল ফেলতে পারছে। অন্যান্য দেশে পুরনো ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি রিসাইকেলের ব্যবস্থা করে এই ধরণের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশে রিসাইকেলের ব্যবস্থা না থাকায় পুরনো সেটে ব্যবহার বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মোবাইল ফোনে অপরাধ কর্মকাণ্ড। সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ মাহমুদ নাসের জনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে প্রায় ১০ শতাংশ সেট শনাক্ত করা যাচ্ছে না। যেগুলোর ইউনিক কোড বদলে ফেলেছে অপরাধীরা। তবে ‘বর্তমানে বাজারে থাকা দামী ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোনসেট যে ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাজারে আসছে, তাতে অপরাধচক্রের নতুন করে কোড বদলের আর সুযোগ খাকছে না। তবে যে পরিমাণ সেট এখন চলছে, সেই সেটের বিশাল সংখ্যা নিয়েই আশঙ্কা গোয়েন্দাদের। মোবাইল মোরমতকারীরা জেট থ্রি এক্স, পিরানহা নামে সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করছে। এটি মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত করে সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল যন্ত্র মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এমনকি কম্পিউটারের ইউনিক কোড বদলে দেওয়া হচ্ছে। এটি এখন দেশের মোবাইল ফোন টেকনিশিয়ানরাই ব্যবহার করছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে।