আনিসুল হক– জো বাইডেনের জীবনকাহিনি কি তোমরা জানো? তিনি যে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, সেই ঘটনাটা জানা আছে তোমাদের? ১৯৭২ সালে বাইডেনের বয়স ৩০, তাঁর স্ত্রী, কন্যা ও দুই পুত্র ক্রিসমাসের উপহার কিনতে বের হন। গাড়ি দুর্ঘটনায় স্ত্রী নিলিয়া, কন্যা অ্যামি মারা যান। দুই ছেলে হান্টার আর বো আহত হয়ে হাসপাতালে। জো বাইডেনের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। তিনি ভাবেন, আত্মহত্যা করবেন। ডেলাওয়ারে সেতুর ওপরে যাবেন, ঝাঁপ দেবেন। কিন্তু তিনি ছেলে দুটোর দিকে তাকালেন। জো বাইডেন বলেন, ‘আমি জীবনেও মদ খাইনি। ওই সময় আমি মদ হাতে নিয়েছিলাম। কিন্তু পান করিনি। টেবিলে রেখে দিয়েছি।’ সেই ৩০ বছর বয়সে তিনি যদি মারা যেতেন, তাহলে আজ যুক্তরাষ্ট্রকে ট্রাম্পের হাত থেকে বাঁচাতে কে এগিয়ে আসতেন? আজ প্রায় ৭৮ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং তাঁর ভাষণে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান ভোটারদের বলেছেন, ‘আপনাদের মনের অবস্থা আমি বুঝি। আমিও অনেকবার পরাজিত হয়েছি।’
জয়-পরাজয় মানুষের জীবনে আসবে। প্রেম আসবে, বিচ্ছেদ আসবে। প্রিয়জন প্রতারণা করতে পারে। বড় আঘাত দিয়ে চলে যেতে পারে। এগুলো সবার জীবনেই হয়। এসব নিয়ে যদি মনে দুঃখ আসে, তাহলে সেই দুঃখ থেকে ভালো কিছু করা যায় কি না, সেটাই বরং চেষ্টা করা যায়।আমি বলছি না যে অনেক বড় আঘাত আসে না। আসে। আমি বলি না যে এত বড় আঘাত আসে না যে মনে হয় জীবন তুচ্ছ। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা মানুষকে এমন দুঃখ দেন না, যা সে সহ্য করতে পারে না। প্রেম ভেঙে গেলে কবিতা লেখো, গান গাও, গান শোনো, খাওয়াদাওয়া করো, বাগান করো, খেলা দেখো, খেলাধুলা করো। আমি আমার জীবনের ব্যক্তিগত দুঃখ ভোলার জন্য স্টেডিয়ামে যাই খেলা দেখতে। একটা দলকে সাপোর্ট করি। সেই দল জিতলে আনন্দে লাফাই, হেরে গেলে কাঁদি। তাতে লাভ হয় যে আমার নিজের জীবনের দুঃখ আমি ভুলে যেতে পারি।
এই গল্প আমি অনেকবার করেছি—এ পি জে আবদুল কালাম হতে চেয়েছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। দেরাদুনে গিয়ে বিমানবাহিনীর ভর্তি পরীক্ষায় তিনি অবতীর্ণ হলেন। নেওয়া হবে আটজন, তিনি হলেন নবম। মন খারাপ করে নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকলেন। সন্ধ্যা নামছে। তাঁর মনে হচ্ছে, এই জীবন রেখে কী লাভ। এই সময় এক সাধু এলেন তাঁর কাছে। বললেন, ‘খোকা তুমি কেন এভাবে নদীর ধারে বসে আছো।’ এ পি জে আবদুল কালাম নিজের ব্যর্থতার কথা বললেন। সাধু বললেন, ‘ওঠো, তুমি বিমানবাহিনীতে টেকোনি, এর মানে জীবন তোমার জন্য বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়া নির্ধারণ করে রাখেনি। তোমার ভাগ্যে আছে অন্য কিছু হওয়া। ওঠো। যাও। তোমার নিয়তিকে অনুসন্ধান করো।’ আবদুল কালাম উঠলেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞান পড়লেন। হলেন একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। হলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
আকাশ তবু সুনীল থাকে,
মধুর ঠেকে ভোরের আলো,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
যার জন্য কেঁদেকেটে অশ্রুর সাগর বইয়ে দিচ্ছ, তাকে ছাড়াও দুনিয়াটা অনেক বড়, অনেক সুন্দর। মানুষের জীবনে প্রেম আসে, চলে যায়। এগুলো কোনো ব্যাপারই না। ভালোবাসো, বাঁচো। ভালোবেসে মরে যেয়ো না। মরার কথা ভাববেও না। আঘাত দেওয়ার কথাও ভাববে না। তুমি যদি প্রতিদান না পাও, তাহলে তুমি তো জিতে গেলে। কারণ, তুমি দান করেছ, তুমি দাতা, প্রতিদান পাওনি, তুমি শ্রেয়তর। তুমি জিতে গেলে। সে তোমার চেয়ে ঊন থেকে গেল। তোমার এই জয়কে উদ্যাপন করো। হাসো। বাঁচো। দেখবে, জীবনের শেষে তুমিই জয়লাভ করবে। জীবন তোমার জন্য সোনার মেডেল রেখে দিয়েছে। শেষ ফিতাটা পর্যন্ত তোমাকে দৌড়াতে হবে। দৌড়াও। বাঁচো। লড়ো। ভালোবেসে মরে যেয়ো না। লেখক: সাহিত্যিক ও সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক প্রথম আলো। (ফেসুবক থেকে সংগৃহীত)
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৫৫ বার