রইছ সাহেব আমাদেরে স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন-নুরুজ্জামান চৌধুরী শাহী-
কয়েক বছর ধরে শারীরিক নানা টানাপোড়নে যাচ্ছে। বহুদিন ধরে পিংকুর অনুরোধ ফাইলবন্দি হয়ে আছে। দক্ষিন সুনামগঞ্জ ও জগন্নাথপুরের সাবেক সাংসদ, রাজনীতিবিদ জনাব আবদুর রইছ অ্যাডভোকেট যিনি তার অ্যাডভোকেট নাম ছাড়িয়ে সুনামগঞ্জবাসীর কাছে ব্যাপক ভাবে পরিচিতি পান ‘রইছ সাব’ নামে। পিংকুর আবদার রইছ সাহেবকে নিয়ে কিছু লেখতে হবে।
রইছ সাহেবের কথা মনে হলে প্রথমে উনার শেষ জীবনের কথাই বেশী মনে পড়ে। ১৯৩১ সালে জন্ম নিয়ে ১৯৮৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর মাত্র ৫৭ বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন। একজন ক্ষণজন্মা মানুষকে আমরা অকালে হারালাম।
‘৭৮ সালের শেষ দিকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশায় দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়িজমাই। প্রথমে নেদারল্যান্ড পরে পশ্চিম জার্মান হয়ে আমেরিকা । একদশক পর প্রবাস কাটিয়ে ‘৮৮ সালে দেশে ফিরলাম। রইছ সাহেব আমার রাজনৌতিক গুরু। যার রাজনৈতিক শিষ্টাচার, ভদ্রতা, মানবিকতা আর অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাকে অনুপ্রানীত করে। সুনামগঞ্জের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের প্রেক্ষাপটে জনাব আবদুর রইছ সাহেব ছিলেন মানুষ হিসাবে উদার, বিনয়ী, বন্ধুবৎসল, সৎ ,সাহসী, বিপ্লবী, সংগ্রামী ও আপোসহীন। ছিলেন উচ্চ ব্যক্তিত্ব সম্পর্ণ আপাদমস্তক ভালো মানুষ।
দেশে গিয়ে শুনলাম রইছ সাহেব গুরুতর অসুস্থ। মরনব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত (Colon cancer) । ২০০৭ সাল থেকে প্রায় ষোল বছর ধরে আমি সেই রোগে আক্রান্ত । মরতে মরতে বেঁচে আছি। তার সাথে আমার মিল খোঁজে পাই। রইছ সাহেব বিছানায় শয্যাশায়ী। দেখতে গেলাম। দুই চার কথা যা হয়েছে অসুস্থতার চেয়ে বেশী রাজনৈতিক। বললেন, জেলা সভাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চান। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সে অনুরোধ জানিয়েছেন। নেত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন হবে না । অন্ততঃ দলের আমৃত্যু সভাপতির তগমার সম্মান তাকে দিতে চান।
১৯৬৭ সালের দিকে সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হই। এর আগের বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন। পরে আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায় ছয়দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয় এবং ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়।
ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য ছিল- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য(প্ররাষ্ট্র/উপরাষ্ট্র)হবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত। ছয়দফা কর্মসূচীর ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ম্যাগনা কার্টা বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়।
আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে রিজাল্টের অপেক্ষায়। ইতিমধ্যে ‘ছয় দফা দাবী জোরালো হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের ভূমিকা সম্বলিত ‘আমাদের বাচার দাবী’ পুস্তিকা পাঠে আমার মনোজগতে বিপ্লবের উন্মাদনার উণ্মেষ ঘটে। রাজনীতিবিদ ও সাংসদ হিসাবে জনাব আবদুর রইছ সাহেবকে মূল্যায়ন করতে গেলে ভূমিকাতে পূর্ব-পাকিস্থান সময়ে সুনামগঞ্জ মহকুমার স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে হয়।
১৯৬৯ এর ৪ঠা জানুয়ারি ছয়দফার প্রতি একাত্বতা প্রকাশ করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি পেশ করে। পরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি বা ড্যাক (DAC) গঠিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা দাবির মধ্যে আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবির ব্যাপক প্রতিফলন ঘটে। এগারো দফায় বাঙালি মধ্যবিত্ত কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দাবিও অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে ছয় ও এগারো দফার আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণসমর্থন লাভ করে এবং আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব কার্যত চলে আসে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রদের হাতে। কিছুকিছু রাজনৈতিক দল ছয়দফার বিরোধীতা করে। সুনামগঞ্জে তখন ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ কমিউনিষ্ট পার্টির ব্যাপক প্রভাব। ৬৯ এ সর্বদলীয় ‘ছাত্র ঐক্য পরিষদ’- ঘটিত হলে তারা এতে সরিক হয়। তদুপরি ছাত্র ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা মেনে নিতে পারেনি। ছয়দফার শ্লোগান দিলে ছাত্র ইউনিয়ন বিরোধীতা করে। এ নিয়ে স্থানীয় ভাবে ছয়দফার পক্ষ বিপক্ষদের মধ্যে প্রায় সময় বিরোধ ও বিবাদ লেগে যেত। কোন সময় হাতাহাতি থেকে মারামারি হতো।
স্কুল জীবনে বঙ্গবন্ধু আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের প্রতি অনুরত ছিলাম। সুনামগঞ্জ কলেজের একাদ্বশ শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়ি। সুনামগঞ্জ আওয়ামীলীগের আমৃত্যু সভাপতি আবদুর রইছ সাহেবের সাথে কলেজ জীবিনে রাজনৈতিক কারনে ঘনিষ্ট সম্পর্ক। প্রথমে আত্মীয়তা পরে ছাত্র রাজনীতির কারনে সে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীর হয়।
(মরহুম মাহমুদ আলী)
‘গণতন্ত্রী দল’-
১৯৫৩ সালের ১৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ‘গণতন্ত্রী দল’ প্রতিষ্টিত হয়। দলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন তেভাগা আন্দোলনের কিষান নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ আর সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন সুনামগঞ্জ শহরের আলীমাবাগ মিনিষ্টার বাড়ীর মাহমুদ আলী। মাহমুদ আলী পাকিস্থান মুসলিম লীগ থকে পদত্যাগ করে নতুন এই দলে জড়িত হন। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্থান সৃষ্টির পর মাহমুদ আলী এবং মিনিষ্টার বাড়ীকে কেন্দ্র করে সুনামগঞ্জের রাজনীতি আবর্তিত হতে থাকে। মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বামধারার ‘গণতন্ত্রী দল’ শুরু থেকে সুনামগঞ্জে একটা শক্ত অবস্থানে চলে আসে । স্থানীয় প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিদিপ্ত ও মননশীল ছাত্র নেতারা এই দলে ভীড়তে থাকেন। বলতে গেলে সুনামগঞ্জের জনাব আবদুর রইছ, আবদুল হক, আবদুজ জহুর, দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী, খলিলুর রহমান চৌধুরী, আফাজ উদ্দিন, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল হাই, হোসেন বক্ত সহ আওয়ামীলীগের প্রায় সকল নেতাই ছিলেন এই মিনিষ্টার বাড়ীর প্রডাক্ট। একমাত্র আবদুল হেকিম চৌধুরী ও আকমল আলী মুক্তার ছিলেন ব্যতিক্রম। সুনামগঞ্জ তথা সারা সিলেট জেলা জোরে ‘গণতন্ত্রী দল’-এর জোয়ার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সুনামগঞ্জের তরুন ও শিক্ষিত মেধাবীরা ‘গণতন্ত্রী দল’-এর পতাকা তলে এসে জড়ো হতে থাকেন । এক সময় স্থানীয় ভাবে এই দল শক্তিশালী অবস্থানে চলে আসে। এই গণজোয়ার বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি এড়ায়নি। তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও দূরদর্শীতা সুনামগঞ্জ তথা সিলেটের রাজনীতিকে আকৃষ্ট করে। মাহমুদ আলীর শক্তিশালী এই বলয় ভাঙতে সিলেট ও মফস্বলের প্রত্যন্ত অঞ্চল সুনামগঞ্জে তিনি কয়েকবার রাজনৈতিক সফরে আসেন। সুনামগঞ্জ তার সর্বমোট আটবার সফরের মধ্যে তিনবারই ছিল পাকিস্থান আমলে। অত্র অঞ্চলে ‘গণতন্ত্রী দল’-এর দূর্গকে দূর্বল ও মাহমুদ আলীর নেতৃত্বের শক্তিকে খর্ব করে আওয়ামীলীগের রাজনীতি শক্ত ভীত্তির উপর দাড় করাতে এক সময় তিনি সফল হন।
মিনিষ্টার বাড়ী-
মিনিষ্টার বাড়ী আর আমাদের বাসা কাছাকাছি ছিল। এছাড়া মাহমুদ আলী সাহেবের ছোট ভাই মুশাররফ মুত্তাকি আলী (সুহাজ) আমার সহপাটি। পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের খেলার প্রধান মাঠ ছিল সুহাজদের বাড়ীর আঙ্গিনার সামনের প্রসস্থ জায়গাটি। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন কিংবা ক্রিকেট কোন কিছু বাদ যেত না। সুহাজের বাসায় যাওয়া আসায় এই রাজনৈতিক পরিবারের অন্দর মহল পর্যন্ত আমার দাবী ছিল। মাহমুদ আলীর সম্পাদনায় ‘নও-বেলাল’ নামে ঢাকা থেকে একটি প্রগতিশীল দৈনিক প্রকাশিত হতো। সুনামগঞ্জের একজন ক্ষুদে সংবাদদাতা হিসাবে নও-বেলালে স্থানীয় খুটিনাটি সংবাদ পাঠাতাম। মাঝেমধ্যে ছাপাহতো। বলতে গেলে ‘নও-বেলাল’ ছিল আমার লেখালেখির হাতে কড়ি।
মিনিষ্টার বাড়ীতে তত্কালীন সুনামগঞ্জের স্থানীয় ও জাতীয় নেতাদের আনাগোনা । সে সুবাদে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অনেককে কাছ থেকে দেখার সুভাগ্য হয়েছে। ছোটবেলায় রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে মনোজগতে প্রভাব বিস্তার হয়। এভাবে কখন জানি বুঝে না বুঝে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়ি। মাহমুদ আলী ‘গনতন্ত্রী দল’ গঠনে অগ্রণী ভুমিকা রাখলেও মাত্র ৪ বছরের মাথায় নিজের তৈরী দল ছেড়ে তিনি চলে যান। যোগদেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ )-এ।
সুনামগঞ্জ রাজনীতি, ন্যাপে’র প্রভাব-
১৯৫৭ সালে পররাষ্ট্রনীতিকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগের দুই নেতা সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মধ্যে মতবিরোধের দেখা দেয়। ৭-৮ ফেব্রুয়ারীর কাগমারী সম্মেলনে এই মতবিরোধ চরম রূপ নেয়। বিরোধের কারনে ১৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্থান আওয়ামীলীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী দল থেকে পদত্যাগ করেন। মওলানা ভাসানীর প্রচেষ্টায় একই সালে ২৫-২৬ জুলাই সম্মেলনে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ )। গনতন্ত্রী দল ত্যাগ করে মাহমুদ আলী ন্যাপে যোগ দিলেন। মওলানা ভাসানী সভাপতি ও মাহমুদ আলীকে সাধারন সম্পাদক করে ন্যাপের প্রথম কার্যকরীকমিটি গঠন হলো । সুনামগঞ্জের তৎকালীন সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী নেতা মাহমুদ আলী ন্যাপে যোগ দেওয়ায় স্থানীয় রাজনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তার অনুসারীদের অনেকেই তখন ‘গনতন্ত্রী দল’ ছেড়ে ন্যাপে যোগ দেন। আওয়ামীলীগ থেকে পদত্যাগ করে সুনামগঞ্জের আরেক প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুস সামাদ ও বহিস্কৃত নেতা অলি আহাদ ও ন্যাপে যোগ দিলেন। তাদের দুই জনকে প্রাদেশিক ন্যাপের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মনোনিত করা হল। চার বছরের মাথায় মাহমুদ আলী ও আবদুস সামাদ ন্যাপ থেকে ছিটকে পড়লেন। ১৯৬৪ ফেব্রুয়ারীর ২৮ ও ২৯ তারিখের ন্যাপের সম্মেলনে মাহমুদ আলীকে বাদ দিয়ে সাধারন সম্পাদক করা হয় হাজী দানেশকে। সে সময় মাহমুদ আলীর সাথে আবদুস সামাদ ও ন্যাপ ছেড়ে চলে যান। যোগদেন ‘এনডিএফ’-এ । এবারও তাদের অনুসারী স্থানীয় অনেক নেতা ন্যাপ ছেড়ে ‘এনডিএফ-এ চলে এলেন। আবদুর রইছ ও দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী তখন স্থানীয়‘এনডিএফ-নেতা। (আওয়ামীলীগ, ন্যাপ, কাউন্সিল মুসলীমলীগ,নেজামে ইসলাম,ও জামায়াতে ইসলাম এই পাচটি দল মিলে ১৯৬২ সালের ৪ঠা অক্টোবর গঠিত হয় ‘এনডিএফ’ জোট। National Democratic Front বা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সংক্ষেপে NDF)
( মরহুম এম এ রইছ এমপি-এ স্ত্রী ও সন্তান)
সুনামগঞ্জ ও ‘এনডিএফ’ –
মাহমুদ আলী ও আবদুস সামাদ ন্যাপ ছাড়ার এক সপ্তাহ পর ১৯৬৪ সালের ৭-৮ মার্চ অনুষ্টিত হয় ‘এনডিএফ’ এর সম্মেলন। সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হলেন যথাক্রমে নুরুল আমিন ও মাহমুদ আলী। আবদুস সামাদ হলেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক ‘এনডিএফ’-এর সভাপতি । ‘এনডিএফ ‘-এর কেন্দ্রীয় নেতা মাহমুদ আলী ও আবদুস সামাদের নেতৃত্বে তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমা তথা সারা সিলেট জেলায় ‘এনডিএফ’ এর জয়জয়কার। জনাব আবদুর রইছ তখন তরুন অ্যাডভোকেট । ‘এনডিএফ’- এর রাজনীতিতে জড়িত। আমার ফুফাতো বড় বোন মিনু আপার বিয়ে হয় রইছ সাহেবের গ্রামের বাড়ী জগন্নাথপুরের বনগাঁও। ছোটবেলা কয়েকবার যাওয়া হয়েছে বনগাঁও। মিনু আপার স্বামী রইছ সাহেবের আত্মীয়। উনাকে পূর্ব থেকে চিনতাম। মাঝেমধ্যে সুনামগঞ্জের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু মিনিষ্টার বাড়ী আসতেন। তেমন কথাবার্তা হতোনা। উনাকে দেখতাম। রইছ সাহেব ও দেওয়ান সাহেব যখন এনডিএফের নেতৃত্বে তখন আমি ছাত্রলীগের একটিভ কর্মি। ‘৬৯ সালের গণ-অভূত্থানের পর এনডিএফ ছেড়ে উনারা সুনামগঞ্জ আওয়ামীলীগের হাল ধরলেন। দেওয়ান সাহেবের ছেলে দেওয়ান মুসাদ্দেক রেজা চৌধুরী সহপাঠী ও খেলার সাথী। মুসাদ্দেকের বাসায় যেতেযেতে সাংগঠনিক ভাবে এক মতের হওয়ার উনারে দু’জনের সাথে আমার রাজনৈতিক ঘনিষ্টতা বাড়ে।
বঙ্গবন্ধু ও এনডিএফ-
এনডিএফ নামক জোটের প্রতি শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর আস্থা ছিল না। জোট থেকে তিনি বের হতে চাইলেন কিন্তু অপর নেতা হোসেন সোহরাওয়ার্দী রাজি ছিলেন না। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী মৃত্যু বরণ করেন। তার মৃত্যুর পর জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগকে পুনরিজ্জীবিত করতে চাইলেন। তার প্রচেষ্টায় ১৯৬৪ সালের ২৫শে জানুয়ারী প্রাদেশিক আওয়ামীলীগকে পুনরিজ্জীবিত করা হয়। মার্চের ৬ ও ৭ তারিখ অনুষ্টিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সম্মেলনে মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশকে সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুকে সাধারন সম্পাদক করে দলের কার্যনির্বাহী কমিটি পুনর্বিন্যাস করা হয় এবং আওয়ামীলীগের নতুন যাত্রা শুরু হয়।
পিডিএম জোট ও ছয়দফা –
ছয়দফা আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশে আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক ভাবে যখন শক্তিশালী হচ্ছিল তখন দলকে ভাঙ্গতে ও ছয়দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে আওয়ামীলীগের ৮ দফা পন্থি তৎকালীন সভাপতি পাঞ্জাবের নবাব্জাদা নসরুল্লাহ খান ও সুনামগঞ্জের মাহমুদ আলী, জাকির হোসেন, মোনায়েম খান, আবদুস সবুর খান, মোহম্মদ আলী গংরা মিলে ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল পিডিএম(পাকিস্থান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট) নামে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জোটের জন্মদেন। নবতম এই জোটে যোগদেয় এনডিএফ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামি, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামীলীগ ও নেজামে ইসলামী। পিডিএম-এ যোগ দেয়া না দেয়া নিয়ে আওয়ামীলীগে ভাঙন দেখা দেয়। আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও রাজশাহীর মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাংশ পিডিএম-এ যোগ দেয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আমেনা বেগমের নেতৃত্বে ছয় দফা –পন্থি গ্রুপটি জোটে যোগ দিতে অস্বীকার করে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। ‘পিডিএম’ জোটের সভাপতি হন নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও সাধারন সম্পাদক মাহমুদ আলী। ১৯ আগষ্ট পিডিএম-এ যোগদানকারী ছয়দফা বিরোধীদের আওয়ামীলীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদেরে ধোঁকা দেবার জন্য পশ্চিমা শাসকের চক্রান্তে এই জোট গঠিত হলেও শেষ পর্যন্ত এই অপশক্তি সফল হতে পারেনি। মূলতঃ এর পর থেকেই মাহমুদ আলীর নেতৃত্বাধীন এনডিএফ থেকে সুনামগঞ্জ তথা সিলেট জেলার নেতা কর্মীরা দলেদলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগে যোগদিতে থাকেন।
গণ-আন্দোলন-
১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয় সরকার বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে যা তুঙ্গে উঠে এবং মধ্য জানুয়ারিতে রূপ নেয় গণ-আন্দোলনে । বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলেন। গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারের মুখে টিকতে না পেরে শেষাবধি ২৫ মার্চ পাকিস্তানের ‘লৌহ মানব’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সারা দেশে নতুন করে জারি হয় সামরিক শাসন, তবে অচিরে দেশে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা চালু করার দাবি স্বীকৃত হয়।
সুনামগঞ্জ রাজনীতির মেরুকরণ-
১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে মাহমুদ আলী যখন নিখিল এনডিএফ এর সাধারন সম্পাদক তখন আবদুস সামাদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্থান এনডিএফ এর সাধারন সম্পাদক। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর এনডিএফ নেতা আবদুস সামাদ আওয়ামীলীগে যোগদেন ও সিলেট জেলা আওয়ামীলীগ দলের সভাপতি মনোনীত হন। আবদুস সামাদ আওয়ামীলীগে যোগদানের ফলে সুনামগঞ্জের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়। সুনামগঞ্জ মহকুমা এনডিএফ এর সভাপতি মাহমুদ আলীর ফুফাতো ভাই দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী ও সাধারন সম্পাদক আবদুর রইছ অ্যাডভোকেট সহ সুনামগঞ্জ এনডিএফ-এর বহু নেতাকর্মী আওয়ামীলীগে যোগদেন। পরবর্তীতে উনারা দু’জন সুনামগঞ্জ মহকুমা আওয়ামীলীগেরও সভাপতি/সম্পাদক নির্বাচিত হন। সারা দেশের মতো সুনামগঞ্জে তখন আওয়ামীলীগের নব জাগরণ শুরু হয়।
রইছ সাহেব সুনামগঞ্জ মহকুমা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক হওয়ার পর আমি প্রথমবার জগন্নাথপুর গেলাম। তাও রইছ সাহেবের সফর সঙ্গি হয়ে। মতিউর রহমান নামে জগন্নাথপুরের সিও(সার্কেল অফিসার রেভিনিউ) স্কুলে পড়ুয়া কোন এক মেয়েকে ইভটিজিং করায় এলাকার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখাদেয়। এক সময় তা ব্যাপক সহিংতায় রূপনেয়। ছাত্রদের উপর পুলিশী হামলা হলে বেশ কিছু ছাত্র মারাত্মক আহত হয়। ছাত্রদের উপর সহিংসতার মামলা দায়ের হয়। কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার কার হয়। সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদ তালেব আহমদ ও আমাকে ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে জগন্নাথপুর নিয়ে যাওয়া হলো । রইছ সাহেবের বিচক্ষণতায় সে দিনের সেই অস্থতিশীল পরিবেশ মোটামুটি স্থিতিশীল হল।
ইয়াহিয়ার সামরিক আইন –
১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারী ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন। পরে প্রকাশ্য রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে নতুন উদ্যোমে সুনামগঞ্জ আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু হয়। মার্চ মাসে পাকিস্থানের সাধারন নির্বাচনকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু সুনামগঞ্জ সফরে আসেন। এর আগে দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরীকে সভাপতি ও আবদুর রইছ অ্যাডভোকেটকে সাধারন সম্পাদক করে সুনামগঞ্জ মহকুমা আওয়ামীলীগের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন হয়। কমিটির আরো কয়েক জনের নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে সহ-সভাপতি ছিলেন আবদুল হেকিম চৌধুরী, আবদুজ জহুর ও আকমল আলী মোক্তার। সাংগঠনিক সম্পাদক- অ্যাডভোকেট খলিলুর রহমান চৌধুরী। প্রচার সম্পাদক- আছদ্দর আলী চৌধুরী মোক্তার। দফতর সম্পাদক- সৈয়দ দেলওয়ার হোসেন। কৃষি সম্পাদক- হারিছ উদ্দিন আহমদ। সমাজ কল্যান সম্পাদক- অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও মহিলা সম্পাদিকা- মোসাম্মত আয়শা বারী প্রমুখ।
১৯৭০ সালের নির্বাচন-
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। সমুদ্র উপকুলবর্তী এলাকায় ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কতিপয় আসনে ডিসেম্বরে নির্বাচন স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে ৭১ সালের জানুয়ারিতে এসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি এবং তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসল লাভ করে। এই নির্বাচনে সুনামগঞ্জ মহকুমায় জাতীয় পরিষদে ৩টি ও প্রাদেশিক পরিষদে ৫টি আসন ছিল। আব্দুর রইছ সাহেবের আসন ছিল সিলেট-৩ (পিই-২২২) জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ। এই আসন থেকে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী হিসাবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান ও নৌকা প্রতীকে নিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। এ আসনে সর্বমোট প্রদত্ত ভোট ছিল-৪৭,২৩৫। আবদুর রইছ ২১,৩৬৪ ভোট পেয়ে এমপিএ নির্বাচিত হন। তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, আজিজুর রহমান (কনভেনশন মুসলিমলীগ) প্রাপ্ত ভোট-২,০৪২। আবদুল হক( হাজারভি জমিয়ত) প্রাপ্ত ভোট-১২,৮৯৯। ফারুক রশিদ চৌধুরী (স্বতন্ত্র) প্রাপ্ত ভোট-৬,০৯৭। সৈয়দ হান্নান (ন্যাপ ওয়ালী) প্রাপ্ত ভোট-২,৭৯৯ এবং আঞ্জব আলী (পিডিপি) প্রাপ্ত ভোট-৭৮০।
স্বাধীনতা সংগ্রাম-
নির্বাচনের পরের ঘটনা সবার জানা। বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত। ২৫শে মার্চের কাল রাত । পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নৃশংস আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞ । প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার মানুষের গর্জে উঠা । ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ । স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা । গ্রেপ্তার । সবই ইতিহাস । শুরু হল স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে গঠিত হল ‘স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ জনাব আবদুর রইছ সাহেব কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হলেন। মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকের গুরু দায়িত্ব ও তিনি পালন করেন।
২৬ শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনী দ্বারা অবরোধ্য হল সুনামগঞ্জ শহর । আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিদের গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে চলে বাসায় বাসায় অভিযান। রইছ সাহেবের বাসা আক্রান্ত হলো। নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবার কেন্দ্রের নির্দেশ ছিল। শহর ছেড়ে তিনি নিজ এলাকায় চলে যান। পরিবার পরিজনকে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে ভারতের স্বীমান্ত পাড়িদিয়ে আশ্রয় নেন মেঘালয়ের বালাট শরনার্থী শিবিরে। রইছ সাহেব মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ সুনামগঞ্জের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি বালাটে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করে তাদেরকে ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠাতেন। এ ছাড়া রিলিফ বণ্টন তদারকি। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ। ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করা প্রভৃতিতে জড়িত ছিলেন । যুদ্ধের নয় মাস আমি ভারতের মেঘালয়ের শিলং ছিলাম। মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসাবে সক্রিয় ছিলাম। কয়েকবার বালাট গেলেও রইছ সাহেবের সাথে নানা সীমাবদ্ধতার কারনে দেখা করতে পারিনি।
নয় মাস যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হল । ভারত থেকে সবাই ফিরে এলেন । শুরু হল দেশ পুনঃগঠন কাজ। সুনামগঞ্জের পুনঃগঠন, প্রশাসন সচল রাখা, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা, ফিরে আসা শরণার্থীদের পুর্নঃবাসনের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি যাবতীয় কাজকর্মে জনাব আবদূর রইছ সাহেব উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হল। রইছ সাহেব গণপরিষদের সদস্য গণ্য হলেন । ১৯৭২ সালে গণপরিষদে বাংলাদেশের নূতন সংবিধান গৃহীত হয়। জনাব আবদুর রইছ ছিলেন সংবিধানের একজন স্বাক্ষর দাতা। নূতন সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সনে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে তিনি জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে এমপি (জাতীয় সংসদ সদস্য) নির্বাচিত হন।
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে কাউন্সিলের মাধ্যমে আমি সুনামগঞ্জ জেলার প্রথম ছাত্রীগের সভাপতি নির্বাচিত হলাম। তখন ছাত্রনেতাদের আলাদা একটা সম্মান ছিলো। আওয়ামীলীগের প্রতিটি সাধারন সভায় পদাধিকার বলে ছাত্রনেতাদেরে বিশেষ অতিথি হিসাবে দাওয়াত দেওয়া হতো। বক্তব্য দেবার সুযোগ দেয়া হতো। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় নেতার প্রোগ্রাম বা আগমন হলে ছাত্রলীগ সভাপতি/সম্পাদককে ব্যক্তিগত ভাবে স্থানীয় প্রশাসন থেকে চিঠি এবং কেন্দ্র থেকে টেলিগ্রাম করে জানানো হতো । ছাত্রলীগের প্রতিনিধি নিয়ে আলোচনা করা হতো । রইছ সাহেব, জহুর সাহেব এমন কি কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সামাদ আজাদ সহ অপরাপর কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রীরা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। স্থানীয় সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রে গেলে সকলে মূল্যায়ন করতেন। ছাত্রলীগের স্থানীয় সকল প্রোগ্রামের স্পন্সর ছিলেন মূলতঃ আওয়ামীলীগ নেতারা । রইছ সাহেব, জহুর সাহেবদের মতো অন্যরাও কোন বাক্যব্যয় না করে আর্থিক সযোগীতা করতেন।
রইছ সাহেব খুব মানবিক একজন মানুষ ছিলেন। ‘৭০ সালের নির্বাচনে উনার এলাকার হতদরিদ্র এক সাপোর্টার অসাবধানতা বশতঃ ব্যাজ লাগানোর পিন মুখের ভেতর রাখায় গিলে ফেলে । ইনফেকশন হয়ে বিরাট আকার ধারন করে । এই ব্যক্তির চিকিৎসা সহ পরিবার পরিজনের সমস্থ ব্যয়ভার দীর্ঘ দিন উনাকে চালিয়ে যেতে দেখেছি।
(সুনামগঞ্জে শেখ হাসিনার জনসভায় মরহুম এম এ রইছ এমপি)
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড –
১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ও আন্তর্জাতীক চক্রান্তে বিপথগামী কিছু সেনা কর্তৃক স্বপরিবারে নিহত হলেন। বঙ্গবন্ধু নির্মম হত্যাকান্ডের পর দেশের সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়। গ্রেপ্তার হলেন আবদুর রইছ সাহেব। প্রথমে উনাকে কুমিল্লা কান্টমেন্টে ও পরে সিলেট জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে বেশ কিছুদিন ডিটেনশনে থেকে মুক্তি পান।
রইছ সাহেবের মুক্তির কিছু দিন পর কাদের বাহীনির সদস্যের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আমাকে গ্রেফতার করা হল। দীর্ঘ দিন সিলেট কারাগারে কাটিয়ে সেখান থেকে মুক্তি পাই। সিলেট কারাগারে সুনামগঞ্জ আওয়ামীলীগ নেতা রইছ সাহেব, খলিলুর রহমান, আপ্তাব উদ্দিন আহমদ, রওনা প্রসাদ রায়(দিরাই), দুই ভাই জালাল উদ্দিন ও আমিন উদ্দিন, (তাহিরপুর)। সাদেক আলী (জামালগঞ্জ) আব্দুল আজিজ ( তাহিরপুর) আবদুল হক তালুকদার গেদু মিয়া (তাহিরপুর), আবদুল বারী, আব্দুজ জহুর এমপি ও মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক এখলাসুর রহমান ছাড়াও আরো অনেকে ছিলেন। আমার সাথে তাদের অনেকের দেখা হয়, আবার অনেকে আমি কারাবন্দি হবার আগে মুক্তি পেয়ে বাইরে চলে যান।
রইছ সাহেব বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের নীতি আদর্শের প্রতি সর্বদা অবিচল ও অনুগত ছিলেন। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের দুর্দিনে সুনামগঞ্জে দলকে সচল রাখতে রইছ সাহেব প্রমুখরা কঠোর পরিশ্রম করেছেন। সে সময় আওয়ামীলীগের কিংবা ছাত্রলীগের কোন স্থায়ী দফতর ছিল না। রইছ সাহের বাসা ছিল একমাত্র ভরসা । ‘৭৫ সালের পর শুধু নয়। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে রইছ সাহেব, দেওয়ান সাহেব কিংবা খলিলুর রহমান সাহেবের বাসা থেকেই দলের কার্যক্রম চালানো হতো । রইছ সাহেবের স্ত্রী রফিকা রইছ নিজেও ছিলেন রাজনীতি সচেতন। তিনি ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। সুনামগঞ্জ মহিলা সমিতিসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কোন দিন উনাকে মুখ কালা করতে দেখিনি। তিনি ছিলেন খুব আমায়িক ও আপ্যায়ন প্রিয় । শত ব্যস্থতার মাঝে নিজে তদারকি করে দলীয় কর্মী সমর্থকদের আপ্যায়ন করাতেন। আমাদেরকে খুব স্নেহ করতেন। দেখা হলে সব সময় হাসিমুখে ভালো মন্দের খবর নিতেন । তিনিও আর বেঁচে নেই।
পেশা জীবন ও সামাজিকতা-
রইছ সাহেব স্নাতক পাশ করে কিছুদিন সিলেট মীরাবাজারের মডেল হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা কালে স্কুলের ভেতরে মেসে থাকতেন। পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ কোর্টে আইনপেশা শুরু করেন। ২৭ বছর বয়স থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পেশায় জড়িত ছিলেন । রইছ সাহেব ছিলেন একজন আদর্শবান রাজনীতিবিদ । উনার ভিতরে কোন ধরনের গর্ববোধ বা অহমিকা বোধ ছিল না। সামাজিক মানুষ হিসাবে তার সহজ সরল মেলামেশা ছিলো সাধারণ মানুষের সঙ্গে। যে কোন সামাজিক অনুষ্টান পূজা কিংবা ঈদে সবার সাথে দেখা করার চেষ্টা করতেন। হিন্দু, মুসলিম, গরীব, ধনী যে কারোর ছেলে বা মেয়ের বিয়ের দাওয়াত রক্ষা করতেন। বেশীর ভাগ সময় উপহার দিয়ে চলে আসতেন। খাওয়া দাওয়াটা উনার কাছে মুখ্যম ছিলেনা। উপস্থিতি জানান দেয়া ও বর বধূকে আর্শিরবাদ করাটা উদ্দেশ্য থাকতো। যে কারো মৃত্যু সংবাদে উপস্থিত হয়ে সমবেদনা জানাতে ভুলতেন না।
রাজনীতিক জীবন-
জনাব রইছ সাহেব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন। আমৃত্যু সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী ও প্রেসিডেন্ট হিসাবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। সুনামগঞ্জ জেলা বারেরও সভাপতি এমন কি শ্রমিক নেতাও ছিলেন। পাকিস্থান আমলে রিক্সা শ্রমিক দের সংগঠন ‘সুনামগঞ্জ রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন’ –এর সহ-সভাপতি ও রাজনীতির প্রথম জীবনে এনডিএফ জোটের সাধারন সম্পাদক ছিলেন।
পরিবার ও মৃত্যু-
বঙ্গবন্ধু ও তার সতীর্থ আবদুর রইছ এর মতো ক্ষণজন্মা নেতার এই বাংলায় জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো কি না সন্দেহ থেকে যায়। এই সব সোনার মানুষেরা আগামী প্রজন্মকে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন। আবদূর রইছ ও তাঁর সতীর্থদের অবদানের মূল্যায়ন করা আমাদের কর্তব্য। দীর্ঘ বছর পরে হলেও তাকে নিয়ে ‘স্মরন গ্রন্থ’ প্রকাশিত হওয়ায় জাতি কিছুটা হলেও দায়মুক্ত হল।
মরহুম আবদুর রইছ সাহেব মৃত্যু কালে স্ত্রী রফিকা চৌধুরী, ৫ পুত্র এবং ১ কন্যা রেখে যান। ইতিমধ্যে তার স্ত্রী জান্নাতবাসী হয়েছেন। উনার ছেলে মেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত এবং স্বস্ব ক্ষেত্রে সুনামের সাথে অবদান রাখছেন। এক ছেলে অ্যাডভোকেট খায়রুল কবীর রুমেন এবং কনিষ্ট সন্তান ব্যারিষ্টার এনামুল কবীর ইমন বাবার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসাবে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগ রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এই মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখকঃ নুরুজ্জামান চৌধুরী শাহী-আমেরিকা প্রবাসী। সাবেক সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি। সাবেক সভাপতি নিউইয়র্ক আওয়ামীলীগ । সাবেক সহ-সভাপতি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ।