রতন ঢাকা-সুনামগঞ্জ-নেত্রকোণায় ১৩ বাড়ির মালিক
কাউসার চৌধুরী: সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন রাজধানী ঢাকা, সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, নেত্রকোণা ও মোহনগঞ্জে ১৩টি বাড়ির মালিক। এর মধ্যে ধর্মপাশায় নিজ গ্রামে ১০ কোটি টাকায় ‘স্বর্ণ মহল’ নামে নির্মাণ করছেন বিলাসবহুল বাড়ি। রয়েছে দামি ব্রান্ডের ৫টি গাড়ি। কেবল নিজ নামেই নয়, প্রথম স্ত্রী মাহমুদা হোসেন লতাসহ স্বজনদের নামে পাহাড়সম সম্পদ গড়ে তুলেছেন। সরকার দলীয় এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, ক্যাসিনো কান্ডে সম্পৃক্ততা, ভূমি দখল, লুটপাট, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচারসহ নানান অভিযোগ উঠেছে। মাত্র এক দশকেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এই সংসদ সদস্যের সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। দুদক ৫ সদস্যের তদন্ত টিম ইতোমধ্যে অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সংসদ সদস্য রতনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশে চিঠি দিয়েছে দুদক। দুদক প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক ও তদন্ত টিমের প্রধান সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ক্যাসিনোসহ নানা অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। উনার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।’ তবে সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন দাবি করেছেন, ‘এরকম কিছুর সাথে আমি জড়িত নই। আমি মিডিয়ার শিকার হয়েছি।’ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মাসের শুরুতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী সংসদ সদস্য রতনের নানান অনিয়ম- দুর্নীতির চিত্র দলের ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে তুলে ধরেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিকট অভিযোগটি দেয়া হয়। এছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট চিত্র তুলে ধরেও অভিযোগ দেয়া হয় বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তার বিরুদ্ধে দলের নেতাকর্মীদেরও অভিযোগের শেষ নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকে দেয়া অভিযোগে বলা হয়, সুনামগঞ্জ -১ আসনের যাদুকাটা নদী থেকে বালু ও পাথর উত্তোলন করা নৌকা থেকে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা টোল হিসেবে আদায় করা হয়। এর থেকে দিনে অন্তত ৫০ লাখ টাকা আদায় করেন তিনি। ২০০৯ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সংসদ সদস্য রতন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই অর্থ আদায় করে যাচ্ছেন। এর ভাগ বিভিন্ন দপ্তরেও পৌঁছানো হয়।
সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে জেলা পুলিশ লাইন্সের বিপরীতে ৭ কোটি টাকার বাড়ি কিনেন। বিশাল আয়তনের প্রাসাদোপম বাড়িটি দেখলে যে কেউ আকৃষ্ট হবে। ধর্মপাশায় নিজ গ্রামে ১০ কোটি টাকায় নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। ধর্মপাশা উপজেলা সদরে তার আরও ৭টি বাড়ি রয়েছে। মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরেও রয়েছে দুটি বাড়ি। নেত্রকোণা জেলা শহরেও ১টি বাড়ি রয়েছে। ঢাকার আশুলিয়ায় গার্মেন্টস, গুলশানে কয়েকটি ফ্ল্যাট এর মালিক সংসদ সদস্য রতন। রয়েছে ৫টি অত্যাধুনিক দামি ব্রান্ডের গাড়ি। দেশের আলোচিত ঠিকাদার ক্যাসিনো কান্ডে গ্রেফতার জি. কে. শামীমের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তার। এম.পি হওয়ার আগে তিনি তেমন সম্পদের মালিক না হলেও এখন পাহাড়সম সম্পদের মালিক বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠা সংসদ সদস্য রতন ধর্মপাশার নওধার গ্রামের বাসিন্দা। তার পিতার নাম মৃত আব্দুর রশিদ। এস.এস.সি পাসের পর তিনি সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটএ ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৯৩ সালে ডিপ্লোমা-ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (পাওয়ার) টেকনোলজি পরীক্ষায় ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর জগন্নাথপুরে বিটিসিএল এ যোগ দেন। জগন্নাথপুরে কিছুদিন কর্মজীবনের পর সিলেটে আসেন। সিলেটে নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে তিনি চলে যান রাজধানী ঢাকায়। আর্থিক লেনদেনের কারণে মাত্র এক লাখ টাকার জন্যে তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়। ২০০৮ সালের হলফনামায় তিনি মামলার তথ্য উল্লেখ করে লিখেন, এন আই এ্যাক্টের মামলা নং-৫৯০/২০০৭। সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন ছিল। এরপর তিনি ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় ব্যবসার সুবাদে বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সাথে পরিচয় ঘটে। এক পর্যায়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করেন। অথচ এর আগে তিনি কখনো দলের পদে ছিলেন না। সংসদ সদস্য হওয়ার পর ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে তার সহোদর যতন মিয়ার নামে ৫০০ একর জমি কেনা হয়েছে। তার নিজ নামেও কেনা হয়েছে ৬০ একর মূল্যবান জমি। মা-বাবার নামে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্যে নেত্রকোণায় জমি কিনেছেন বলেও সূত্র জানায়। অবৈধ ভিওআইপির ব্যবসার সাথে তার সম্পৃক্ততা নিয়ে ইতোপূর্বে একাধিকবার সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বি.এন.পি’র কেন্দ্রীয় সদস্যও -যিনি চলচ্চিত্র অভিনেতা এমন একজনের সাথে ভিওআইপি ব্যবসার পার্টনার তিনি- এমন খবরও চাউর রয়েছে। নির্বাচন কমিশনে নিজের স্বাক্ষর করা হলফনামায় তিনি ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর লিখেন, তার স্ত্রী মাহমুদা হোসেন লতা ৪০ তোলা স্বর্ণের মালিক। রয়েছে ৩৫ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ টাকার জমি। তবে স্ত্রীর কোনো আয় নেই। নিজের মোট আয় ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ টাকা। মোট সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৮০ লাখ ৭৮ হাজার ৩২২ টাকা। ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর দেয়া হলফনামার চিত্র পুরো উল্টো। ৫ বছরের ব্যবধানে নিজ নামে সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি স্ত্রী লতার পরিচয় হয় ব্যবসায়ী। হলফনামায় স্ত্রী লতাকে পায়েল টেক্স লিমিটেড এর পরিচালক বলা হয়। লতার মোট আয় ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। মোট সম্পদ ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তিনি ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা আয়করও দেন। হলফনামায় সংসদ সদস্য রতনের মোট আয় উল্লেখ করা হয়, ২০ লাখ ৩০ হাজার ২৬৪ টাকা, সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ২৬ লাখ ৬৬ হাজার ৯০৮ টাকা। তিনি ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮২৩ টাকা আয়কর দেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেয়া হলফনামায় তিনি ৫২৩ দশমিক ২৭ একর কৃষি জমি, ৮ দশমিক ২৬ একর পরিমাণের অকৃষি জমি, একটি এ্যাপার্টমেন্ট এবং নিজের ও অংশীদারীত্বের ৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকার কথা উল্লেখ করেন বলে জানা গেছে। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়টি প্রকাশের পর কেবল সুনামগঞ্জই নয় বৃহত্তর সিলেটে সংসদ সদস্য রতনকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। নানা কারণে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ-১ সংসদীয় এলাকা। পাথর-বালুমহাল ও কয়লার জন্যে তাহিরপুর-জামালগঞ্জের পরিচিতি দেশ জুড়ে। এজন্যে এই এলাকায় টাকা লেনদেনও হয় ব্যাপক। বৃহৎ জলমহালসহ টাঙ্গুয়ার হাওরও এই সংসদীয় এলাকায়। জলমহালের নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েও তিনি বিপুল পরিমাণের অর্থ কামিয়েছেন। বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনো কান্ডে সংসদ সদস্য রতনের নাম আসায় নড়েচড়ে বসে দুদক। দুদক প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি টিমকে সংসদ সদস্য রতনের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। গত কয়েক দিন ধরে অনুসন্ধান টিমটি তাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে, সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। ক্যাসিনো কান্ডে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তার বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত চিঠি পুলিশের বিশেষ শাখার (এস.বি) ইমিগ্রেশনে পাঠানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রধান ও দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন এই চিঠিটি প্রেরণ করেন। চিঠিতে বলা হয়- মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে দেশে মানি লন্ডারিংসহ বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধানে বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। বিশ্বস্ত সূত্রে দুদক জেনেছে, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ওই সাংসদ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই তিনি যাতে দেশ ছেড়ে যেতে না পারেন, সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। রতনের ২য় স্ত্রী তানভী ঝুমুর গত ১০ মাস ধরে বিদ্যালয়ে না এসে বেতন ঠিকই তুলে নিচ্ছেন এমন সংবাদেও তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তাহিরপুরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তানভী ঝুমুরকে বিয়ে করেন এ সাংসদ। এটি তার ২য় বিয়ে। বিয়ের পর স্ত্রী ঝুমুরকে ডেপুটেশনে তাহিরপুর থেকে সুনামগঞ্জ সদরের তেঘরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। এক দিনের ছুটি নিয়ে গত ১০ মাস ধরে তিনি বিদ্যালয়ে যান না। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি থেকে তিনি বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকলেও বেতন ঠিকই উত্তোলন করছেন।
ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সুনামগঞ্জ জেলার সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এসকল অভিযোগ, দুদকের অনুসন্ধান ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে বলেন, ‘দুদক কিছু করলে অবশ্যই আমাকে নোটিশ দিবে। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় যা আসছে তা আমার জানা নেই। আমি মিডিয়ার শিকার হয়ে যাচ্ছি। কিছু করার নাই। মিডিয়ার শিকার। এ ধরনের কোনো ঘটনা আমার জানা নেই। আমাকে কেউ এ ধরনের ঘটনার তথ্যও দেয়নি। অভিযোগ একশটা দিতে পারে। অভিযোগ দিয়ে কেউ রিসিভ করেও আনতে পারে। আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীও ক্যাসিনো চিনে না। জি. কে. শামীমকে আমি চিনিও না। দেশে পত্রিকার কোনো হিসাব আছেনি। পত্রিকায় লিখবে কিতা। আমার নিউজতো লোকে পড়বে তাই এসব লিখছে।’দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, তদন্তে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পরই মোয়াজ্জেম হোসেনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আমাদের অনুসন্ধান টিম অনুসন্ধান শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া গেছে। আরো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বলে তিনি জানান।