একের পর এক গুম বা নিখোঁজের ঘটনায় উদ্বেগের মধ্যেই ফিরে আসছেন কেউ কেউ। কিন্তু ফেরার পর অপহরণের নেপথ্যের কাহিনি জানা যাচ্ছে না। এমন প্রেক্ষাপটে প্রায় ৪ মাস নিখোঁজ থাকা কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এএমএম আমিনুর রহমানকে গ্রেপ্তার দেখাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তারের পর গতকাল তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। পুলিশের দাবি, হঠাৎ করে তার মোবাইল ফোন সচল পাওয়া যায়। প্রযুক্তির সহায়তায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এর আগেও রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার দেখানোর নজির রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। পরবর্তী তদন্তে বরাবর উপেক্ষিতই থেকে গেছে নিখোঁজ থাকাকালে তাদের অবস্থানের বিষয়ে। কারা তাদের অপহরণ করেছিল, কেন করেছিল- এসব প্রশ্নের জবাব মিলছে না। পুলিশের সাবেক আইজিপি, মানবাধিকারকর্মী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার দেখানো হলে তদন্ত কর্তৃপক্ষকে তার নিখোঁজ থাকার বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। তা না হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে জনগণের এক ধরনের অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। সব মিলিয়ে নিখোঁজের ইতিবৃত্ত জানতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপ বাড়ছে।
আমিনুর রহমান নিখোঁজ থাকার ৪ মাস পর তাকে মামলায় গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূরুল হুদা বলেন, এসব মামলার তদন্ত যখন শেষ হবে, তখন কোর্টে এ ব্যাপারে প্রশ্ন আসতে পারে ডিফেন্সের পক্ষ থেকে। তখন তদন্ত কর্তৃপক্ষকে এর জবাব দিতে হবে। যা বলা আছে তার উল্টোটা করলে তো আর আইনসিদ্ধ হয় না। আমিনুরকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরের ডিসি (বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি) শেখ নাজমুল আলম বলেন, আমরা শুক্রবার রাতে গুলশান প্রগতি সরণির সুবাস্তু টাওয়ারের সামনে থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছি। তাকে গুলশান থানার বোমা হামলার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তারের ৩-৪ ঘণ্টা আগে তার মোবাইল ফোন খোলা পেয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে অবস্থান শনাক্ত করা হয়। গত ৪ মাস আমিনুর কোথায় ছিলেন? এমন প্রশ্নে শেখ নাজমুল আলম বলেন, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি এ বিষয়ে কিছু বলেননি।
এদিকে গুলশানের ওই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমিনুরের বিরুদ্ধে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে গতকাল বিকালে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে তোলা হয়। আবেদনের শুনানি শেষে ৪ দিন হেফাজতের নির্দেশ দেন মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস। আদালতে তাকে আইনজীবীর সঙ্গে কোনো কথা বলতে দেওয়া হয়নি। ফলে জানা যায়নি ৪ মাস তিনি কোথায় ছিলেন? কারা তাকে অপহরণ করেছিল? নাকি তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন। এসব প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি। এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর ফিরে আসেন অপহৃত সাংবাদিক উৎপল দাস। কারা তাকে অপহরণ করেছিল এই রহস্য গতকাল পর্যন্ত মেলেনি। আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুর রব জানান, পরিবার থেকে বলেছে- গত ২৭ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই আমিনুর রহমানকে আটক করে। গতকাল আদালতে আনার পর একজন আইনজীবী হিসেবে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি আমাকে। অল্প কিছু কথার মধ্যে বুঝলাম, এতদিন তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতেই ছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিকটিমোলজি অ্যান্ড রেসটোরেটিভ জাস্টিস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, গুম বা নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা বা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার যে স্বাধীনতা, সেখানে শূন্যতা বা ঘাটতি তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়েছে। নিখোঁজ হওয়ার পর গ্রেপ্তার দেখানোর ফলে যে গ্যাপ তৈরি হয়, তাতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বাড়ে। রাষ্ট্রের সঙ্গে বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে জনগণের অবিশ্বাস বা সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়। তিনি বলেন, ফিরে আসা ব্যক্তি তার ক্ষতি হবে ভেবে নীরব থাকছেন। কিন্তু সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব থাকলে চলবে না। কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এটি খুঁজে বের করতে হবে এবং বন্ধ করতে হবে। নয়তো এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাবে এবং স্বার্থান্বেষী মহল এর সুযোগ নেবে।
গত ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর নয়াপল্টনের বাসা থেকে সাভারে নিজ বাড়িতে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন আমিনুর রহমান। তার নিখোঁজের পর থেকে এ বিষয়ে সরকারকে সন্দেহ করে আসছিলেন কল্যাণ পার্টির নেতারা। আমিনুর রহমান নিখোঁজ হওয়ার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুম-খুনের জন্য সরকারকে দায়ী করে বলেছিলেন- সন্দেহ করা হচ্ছে তাকেও (আমিনুর) একই পরিণতি বহন করতে হয়েছে, তিনি গুম হয়েছেন।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন কল্যাণ পার্টি ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক। ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শাজাহান খানের নেতৃত্বে গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে বোমা হামলার মামলায় এই পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গত ১০ অক্টোবর দুপুরে মতিঝিলের অফিস থেকে বের হওয়ার পর থেকে নিখোঁজ হন সাংবাদিক উৎপল দাস। গত মঙ্গলবার তাকে একটি মাইক্রোবাসে করে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি সিএনজি ফিলিংস্টেশনে রেখে যাওয়া হয়। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসান গত ৭ নভেম্বর বিকাল থেকে নিখোঁজ ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে বিমানবন্দর এলাকায় ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি বাসায় ফেরেন। নিখোঁজের পর এ পর্যন্ত ফিরে আসা প্রায় সবাই একই ধরনের বর্ণনা দিচ্ছেন। শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজার ও সাংবাদিক উৎপল দাস ফিরে আসার পর জানান, টাকার জন্য তাদের অপহরণ করা হয়েছিল। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সচেষ্ট বলেই নিখোঁজদের উদ্ধার করা যাচ্ছে।
নিখোঁজের পর ফিরে আসা ব্যক্তিদের সম্পর্কে মানবাধিকারকর্মী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নূর খান লিটন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যে তিনজন ফিরে এসেছেন, তারা যে বক্তব্যই দিন না কেন, তাদের বক্তব্যের মধ্যে কিন্তু বেশ এলোমেলো একটা অবস্থা রয়েছে। তা থেকে তদন্ত শুরু হলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। গত চার মাসে ঢাকায় রাজনীতিক, কূটনীতিক, শিক্ষক ও ব্যবসায়ী মিলে ডজনখানেক মানুষ নিখোঁজ হন। সর্বশেষ ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিদেশফেরত মেয়েকে আনতে ধানম-ির বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে বের হয়ে নিখোঁজ হন সাবেক কূটনীতিক এম মারুফ জামান। গতকাল পর্যন্ত তিনি ফেরেননি। সাম্প্রতিক সময়ে নিখোঁজদের মধ্যে উৎপল দাসের আগে পরিবারের কাছে ফেরেন ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়। তিনি আড়াই মাস ‘নিখোঁজ’ ছিলেন। গত ২৩ আগস্ট পল্টন থেকে নিখোঁজ হন আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা শামীম আহমেদ। অপহরণের পাঁচ দিন পর দুর্বৃত্তরা তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় মতিঝিল থানা এলাকায় ফেলে যায়। তাকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত কেউ এখনো ধরা পড়েনি। ফলে কারা তাকে অপহরণ করল তা অজানাই রয়ে গেছে।
গত ২৭ আগস্ট দিনেদুপুরে গুলশান থেকে অপহরণ করা হয় ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়কে। ১৬ নভেম্বর তাকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। কারা তাকে অপহরণ করেছিল, কেন করেছিল তার কারণ গতকাল পর্যন্ত জানা যায়নি। অপহৃত হওয়ার পর যারা ফিরে এসেছেন তাদের অধিকাংশই মুক্তিপণ দেওয়া ছাড়াই মুক্তি পেয়েছেন। ফিরে আসার পর তাদের মুখ থেকে প্রায় একই রকম বক্তব্য বেরিয়ে এসেছে। আর সেটি হলো- তাদের বন্দি অবস্থায় নিয়মিত খাবার সরবরাহ করা হতো। আর মুক্তিপণের জন্য তাদের তেমন একটা নির্যাতন করা হয়নি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৫২ জন গুম-অপহরণের শিকার হয়েছেন। সূত্র: আমাদের সময়
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn