রাজধানীতে নারীদের রমরমা প্রতারণা
ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত ৪০ বছর বয়সী ডিভোর্সি পাত্রীর জন্য সৎ, নামাজি ও বয়স্ক পাত্র চাই। পাত্রী ঢাকায় দুটি সোনার দোকান এবং নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে তিনটি কারখানার মালিক। প্রয়োজনে পাত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। প্রকৃত আগ্রহীরা সরাসরি নিচের মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেন।’ পত্রিকায় পাত্র-পাত্রী চাই- শিরোনামে এমন বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে ওই মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে মধুর কণ্ঠে কথা বলেন এক নারী।
কয়েকদিনের কথোপকথনের পর নারী দাবি করেন, তিনি প্রেমে মজেছেন। তার সঙ্গেই বাকি জীবন কাটাতে চান। এরপর দেখা করার কথা বলে ডেকে নিয়ে সেই ব্যক্তিকে আটকে নির্যাতন করা হয়। কৌশলে জিম্মি করে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এমন প্রতারণায় জড়িত বিথী ও শাওন নামের দুই নারীসহ ছয়জনের একটি চক্রকে শনাক্তের পর ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দারা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এ সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ ধরণের প্রেমের ফাঁদে ফেলে অন্তত ৫ জনের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাঈনুল ইসলাম বলেন, এই চক্রের ফাঁদে পড়ে অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন। এরই মধ্যে তিন প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা এরকম সাতটি ঘটনার কথা স্বীকার করেছে। এসব ঘটনার অন্তত তিনটি মামলা তদন্ত করেছে ডিবি। চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, চক্রটি নানাভাবে লোকজনকে ফাঁদে ফেলে। কখনও অচেনা নম্বরে কল করে গল্প জুড়ে দেয় চক্রের নারী সদস্য। অপরপ্রান্তের ব্যক্তিকে আগ্রহী করা গেলে দু-তিনদিন পর প্রেমের নাটক সাজিয়ে তাকে ডেকে নেওয়া হয়। আবার লোকজনকে কাজের কথা বলে মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে অপহরণ করা হয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, স্বেচ্ছায় যাওয়ার পর বা জোর ধরে করে ধরে নেওয়ার পর তাদের একটি কক্ষে আটকে মারধর করা হয়। সেখানে তাদের বিবস্ত্র করে চক্রের নারী সদস্যের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় ছবি তোলা হয়। এরপর সাংবাদিক ও পুলিশ সেজে চক্রের কয়েক সদস্য সেখানে উপস্থিত হয়।
এরপর সাংবাদিক পরিচয়দানকারীরা বলেন, এসব ছবি পত্রিকায় ছাপা হবে। সঙ্গে থাকবে ‘অপকর্মের’খবর। ওই ব্যক্তির পরিবারে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হবে। পুলিশ পরিচয়দানকারী বলে, অসামাজিক কার্যকলাপের দায়ে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হবে। এ সময় চক্রের অপর কোনো সদস্য বিষয়টি ‘মিটমাট করার উদ্যোগ নেয়। আটকে রাখা ব্যক্তিকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, তিনি টাকা দিলে পুলিশ-সাংবাদিককে ম্যানেজ করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আটক ব্যক্তির আয়সীমা বুঝে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্ধেক বা তারও কমে রফা হয়। সরাসরি বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে চক্রের সদস্যরা টাকা ভাগ করে নেয়।
প্রতারণার একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই ডিএমএ মজিদ বলেন, গত বছরের মে মাসে পটুয়াখালীর কলাপাড়া থানার কুয়াকাটার এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে অপরিচিত দুটি মোবাইল ফোন নম্বর থেকে কথা বলেন এক নারী। তিনি নিজেকে পটুয়াখালীর লোক বলে পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তির সাহায্য চান ও দেখা করার কথা বলেন। এরপর ২৮ মে সকালে তিনি ঢাকায় আসেন। সেদিন দুপুরে ওই নারীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথে স্বামীবাগ নতুন রাস্তায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থামিয়ে তাকে তুলে নেয় চারজন। এরপর স্বামীবাগের ৯১/১ নম্বর ভবনের ষষ্ঠ তলায় তাকে আটকে রাখা হয়। তাকে মারধর করে ও নারী সংক্রান্ত ঘটনায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নগদ টাকা ও চেকসহ তিন লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ টাকার মালপত্র হাতিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। পরদিন বিকেলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গেন্ডারিয়া থানায় দায়ের মামলাটি পরে ডিবি তদন্ত করে।
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, চক্রের ছয় সদস্যের মধ্যে সালমা আক্তার বিথী, আব্দুল মালেক হাওলাদার কবির ও গাজী আবু জাফর মামুনকে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে প্রতারণার নানা কৌশল। আজাহার, মোস্তফা ও শাওন নামে চক্রের আরও তিন সদস্যকে খুঁজছে পুলিশ।