রাজনীতিতে নির্বাচনী হাওয়া
রাজনীতিতে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ‘ভিশন-২০৩০’র দেয়াকে আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সদিচ্ছা হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। বিগত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করা বিএনপির এ ভিশন নির্বাচনী হাওয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এরপর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সারাদেশ থেকে দলীয় নেতাদের নিয়ে বর্ধিত সভা করে আগামী নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক দিক-নির্দেশনাও দিয়েছে। দেশের প্রধান এই দুই রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বর্তমান সংসদের সরকার সমর্থিত বিরোধীদল জাতীয় পার্টিও আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই ৫৮টি রাজনৈতিক নিয়ে বিশালাকার জোট গঠন করেছে। সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) জাতির সামনে তুলে ধরেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের তৎপরতায় কার্যত সারাদেশে নির্বাচনী হাওয়াকেই জোরালো করেছে।
সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার পরিকল্পনা করলেও নিজেদের আগাম নির্বাচনেরও প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছে ইসি। ইসির একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় থাকলেও ইসি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে চায়। গত মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা খসড়া রোডম্যাপ ঘোষণা করেন।
এদিকে, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্যে ইসি ঘোষিত ‘রোডম্যাপ’ বিষয়ে আওয়ামী লীগ পজিটিভ বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
গতকাল বুধবার সকালে কমলাপুর বাস ডিপোতে আসন্ন রমজানের ঈদে বিআরটিসির সেবার মান বৃদ্ধি বিষয়ক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ প্রতিক্রিয়া জানান।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপের কথা শুনেছি। আমাদের প্রতিক্রিয়া পজিটিভ। নির্বাচন নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, নির্বাচন যথাসময়ে সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে।
বিগত ১০মে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে বিএনপি তাদের আগামীর কর্মপরিকল্পনা ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণা করেছে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, সুশীল সমাজ ও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার দলের রোডম্যাপ জাতির কাছে তুলে ধরেন। বিএনপির এ ভিশন-২০৩০ উপস্থাপনের পর থেকেই এ নিয়ে দেশে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। অনেকে একে সাধুবাদ জানাচ্ছেন আবার অনেকে এর সমালোচনাও করছেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একে তাদের দেয়া ‘ভিশন-২০২১ অথবা ভিশন ২০৪১’ এর নকল ভার্শন হিসেবেও দাবি করছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও একই সুরে কথা বললেও এক পর্যায়ে জাতির কাছে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরায় বিএনপিকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন তিনি।
অপরদিকে, গত ২০ মে প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন গণভবনে দলের বিশেষ বর্ধিত সভা আহ্বান করে আওয়ামী লীগ। সভায় যোগ দেন সারাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাসহ কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমন্ডলীর সব সদস্যগণ। সেই বৈঠকে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূল নেতাদের আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী নির্বাচনে নেতাকর্মীদের কি কি করণীয়, তা সম্পর্কে বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা দেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ওই বর্ধিত সভা থেকে আওয়ামী লীগের আগামী নির্বাচনের অগ্রযাত্রা শুরু হল বলেও ঘোষণা দেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী বলেন, বিএনপির ভিশন-২০৩০, আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভার মাধ্যমে নেতাদের দিক-নির্দেশনা, জাতীয় পার্টির বিশাল সাইজের জোট গঠন এবং সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ সব কিছুই প্রমাণ করে দেশ একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ দিয়েছে তা ভাল। তাদের পরিকল্পনায় যে ডায়লগ সিস্টেম তারা রেখেছে-এটা যদি নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য হয় সেটা আরও ভাল। ইসির সব বিষয়ে কর্মকরিকল্পনা থাকা উচিত। মূল কথা হচ্ছে- দেশের নির্বাচনব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে, মানুষের মধ্যে যে আস্থাহীনতা, সে ব্যাপারে ইসি যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেয় তা অবশ্যই ভাল। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে যে প্রশ্নগুলো আছে, ইসির উদ্যোগ যদি তার সমাধানের লক্ষ্যে হয়, তা হলে তো ভালো।
তিনি আরও বলেন, আমরা (বিএনপি) যখন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সুশাসনের জন্য অগ্রসর হচ্ছি তখন আমাদের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে পুলিশী তল্লাশী সে প্রচেষ্টাকে বাধা দেয়া বা আমাদের নির্বাচনের বাইরে রাখারই ষড়যন্ত্র কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। এর পেছনে ক্ষমতাসীনদের বড় কোনো উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। আর এটা কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক নয়, তা সব মহলকেই মনে রাখতে হবে।
সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা জেনারেল রুহুল আলম চৌধুরী জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে জোট সম্পর্কে বলেন, এটা নিয়ে সবাই জানে। কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে এতটুকু বলতে পারি যে-বিএনপিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার যে ষড়যন্ত্র আছে সেটা যদি কার্যকর হয়, তাহলে এরশাদের অধীনে জোটকে বিরোধীদলের রাখার একটি প্রক্রিয়া। আর এটা যতটা না এরশাদের সফলতা তার চেয়ে এটা শেখ হাসিনার সাফল্য হিসেবেই দেশবাসী দেখবে।
এদিকে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্যকে সামনে রেখে ৫৮টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট’ নামের বিশাল একটি জোট গঠন করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গত ৭ মে রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে এ জোটের ঘোষণা দেন তিনি। এরশাদের এ জোটে ২টি নিবন্ধিত দল ও ২টি জোটসহ মোট ৪টি শরীক দল যোগ দিয়েছে। ঘোষিত জোট নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেবে উল্লেখ করে এরশাদ বলেন, ফলাফল যাই হোক না কেন জোট নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেবে।
এদিকে, রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী চলতি বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। এতে ভোট গ্রহণের জন্য ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের কথা নেই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক একটি সরকার আছে। সংবিধানিক ধারাবাহিকতা আছে। রাষ্ট্রের সব কাঠামোগুলো সচল আছে। জনমানুষের মধ্যে কোনো সংশয় দ্বিধা নেই। সব কিছু ঠিকঠাক চলছে। সে কারণে নির্বাচন কমিশন (ইসি) তাদের দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ দিতে পারে। আগে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ছিল না। সে কারণে ইসির মধ্যেও সব সময় দ্বিধা-দ্ব›দ্ব কাজ করত। কিন্তু এখন সেসব নেতিবাচক দিকগুলো না থাকায় তারা রোডম্যাপ নিতে পারে। বিষয়গুলোতো অবশ্যই পজেটিভ।
আওয়ামী লীগের তরুণ এ নেতা বলেন, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার কারণে, নির্বাচনের বাইরে অন্য কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ না থাকায় মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে নির্বাচনই ক্ষমতা পরিবর্তনের মাধ্যম। নির্বাচনের মধ্যদিয়েই সরকার গঠন করবে রাজনৈতিক দল। কোনো জ্বালাও-পোড়াও আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে কেউ ক্ষমতায় যেতে পারবে না। সে কারণে বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী না হয়েও ধার করা ফর্মূলা হলেও ভিশন-২০৩০ দিতে পেরেছে। যদিও তা লোক দেখানো। আর এরশাদও ৫৮ দল নিয়ে বিশাল নির্বাচনী জোট গঠন করেছেন। ইসিও নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ ঘোষনা করেছে। এতে আমরা বলতেই পারি দেশে একটি নির্বাচনী হাওয়া জোরে-শোরে বইছে। যে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে আগামীতে আবার গণতান্ত্রিক সরকার গঠন হবে।
বিএনপি সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, দেশ, দেশের গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ আগামীতে আমরা কিভাবে দেশকে উন্নয়নের লক্ষে নিয়ে যেতে চাই সে বিষয়ে ভিশন-২০৩০তে আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পরিস্কার দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু এ ভিশন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় প্রমাণ হয় তারা এটা নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। যা আজকেও আওয়ামী লীগের বন্ধু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদও বলেছেন।
তিনি বলেন, আন্দোললের পাশাপাশি আমাদের নির্বাচনেরও প্রস্তুতি আছে। কারণ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ যেকোনো ষড়যন্ত্র করতে পারে। সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আমরা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জনগণের দাবি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করব।
দুলু বলেন, ভিশন-২০৩০ মধ্যদিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের বিএনপির সদিচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও বিএনপির নেতাকর্মীরা সজাগ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ ঘোষণা, আমাদের ভিশন ঘোষণা, আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দিক-নির্দেশনা ও এরশাদের বিশাল জোট গঠনের মধ্যদিয়ে এটা ইঙ্গিত করে দেশে একটি নির্বাচনী হাওয়া বইছে। কিন্তু সেটা কতটা কার্যকরী হবে ভবিষ্যতই তা বলে দেবে।