ইমরান আলী; গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার একটি স্টল ঘিরে দর্শনার্থীদের ভিড়। অনেকের ধারণা- হয়তো কোনো বিশেষ পণ্যে বড় ছাড় চলছে। কিংবা ভিন্ন কোনো ঘটনা। কিন্তু না। কাছে গিয়ে দেখা গেল একটি চায়ের স্টল। আর সে স্টলের সামনে লাইন ধরে টোকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে চাপ্রেমীরা। স্টলে লাইটিং করা বড় ব্যানার। লেখা- রাজা চায়ের আড্ডা, বিখ্যাত রাজা চা। চা বানাচ্ছেন যে স্টাফরা তারাও বেশ ব্যস্ত। কথা বলারও সুযোগ নেই।
ব্যানারে যার ছবি তিনি অর্থাৎ ‘রাজা মামা’ স্টলের সামনে দ্রুত গতিতে হাঁটছেন। দর্শনার্থীরা তার সঙ্গে সেলফি তুলছেন হাসিমুখে। কেউ বা সেলফি তোলার অপেক্ষায়। দর্শনার্থী জানালেন, রাজা চায়ের গল্প তিনি অনেক শুনেছেন। আজ নিজে পরখ করতে এসেছেন। বললেন, ভেবেছিলাম সাধারণ চা। কিন্তু না। একেবারেই অসাধারণ স্বাদ। এই দর্শনার্থী চা পেয়েছেন প্রায় বিশ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পর। আমাদের দেখে রাজা মামা এগিয়ে এলেন। তিনি মূলত: ক্রেতাদের জিজ্ঞাসা করছেন কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি-না চায়ে। বা স্বাদ ঠিক আছে কি-না। মোটা গোঁফের এই রাজা মামার আসল নাম আজহার উদ্দিন। চল্লিশোর্ধ আজহার উদ্দিনের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার নওধার গ্রামে। বাবা আলীম উদ্দিন।
মানবজমিনকে তিনি জানালেন তার খ্যাতির কথা। বললেন, ছোটবেলা থেকে নানা সংগ্রাম করে আজ এই পর্যায়ে আসা। এক সময় ফেরি করে টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করেছেন নিজের ভ্যানে। কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসেছিলেন। মানুষের বাসা বাড়িতে কাজ করেছেন। কখনো বা তাকে রাত কাটাতে হয়েছে পাবলিক টয়লেটের ছাদে। থাকার জায়গা মেলেনি। মেলেনি তিনবেলা খাবার। অভাবে কাবু আজহার উদ্দিন টিকতে না পেরে জমি বিক্রি করে বিদেশ পাড়ি জমান। দুবাইতে রাতদিন কাজ করেও সচ্ছলতা ফেরাতে পারেননি। কাজ করেছেন রেস্টুরেন্টে। কিছুদিন পর সিদ্ধান্ত নেন দেশে ব্যতিক্রমী চায়ের স্টল দেয়ার।
২০১৮ সনে দেশে ফিরেন । শুরু করেন চা বিক্রি। শুরুতে অনেকেই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছেন। বলেছেন, এই ব্যতিক্রম চা কে খাবে? বললেন, এক সময় কত মানুষের কাছে কাজের জন্য অনুরোধ করেছি। পাইনি। আর এখন আমার এই চা বিক্রিতে কাজ করেন ৭২ জন। আট হাজার থেকে ২৮ হাজার টাকা পর্যন্ত সম্মানীতে কর্মী কাজ করেন আমার সঙ্গে। সারা দেশে ১৮ টি শাখা রয়েছে। আজহার উদ্দিন কথাও বলেন বেশ গুছিয়ে, চমৎকারভাবে। কিন্তু কেন তার নাম রাজা মামা। এই চায়ের জনপ্রিয়তার রহস্যই বা কী? বললেন, মানুষ ভালোবেসে রাজা মামা ডাকে। কারণ আমার এই চা দামে বেশি হলেও স্বাদে অনন্য, ভিন্নরকম। শুরুতে অনেকে উপহাস করলেও এখন সবাই গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ তো বলেন, এটা রাজা-বাদশাদের চা। তাই হয়তো তারা আমাকে রাজা বলে ডাকতেই পছন্দ করেন। স্টলের সামনে দেখা গেল দেশি-বিদেশি পত্রিকার কাটিং ফ্রেমে ঝুলানো। নানা দেশের দর্শনার্থীরা তার স্টলে চা খেয়েছেন সেসব ছবি। তাকে নিয়ে করা সব পত্রিকার রিপোর্ট ঝুলছে স্টলের সামনে। দর্শনার্থীরা চা পানের আগে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন তাতে।
আজহার উদ্দিন জানালেন, তার চায়ে কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, পেস্তাবাদাম, বিভিন্ন মসলা, গরুর দুধ ও গুঁড়া দুধ মেশানো হয়। তা বালুর তাপে গরম করা হয়। তিনি ব্যয়বহুল জাফরানও ব্যবহার করেন। যার প্রতি কেজি দাম ৮-১০ লাখ টাকা। এ কারণেই চা একটু ব্যতিক্রম। পঞ্চাশ টাকা কাপ চায়ের স্বাদ নিতে স্টলে রোজ এমন ভিড় হয়। এর বাইরেও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চা বিক্রি করেন তিনি। বললেন, আমি সার্থক। ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে সব জেলায় স্টলের শাখা খোলার। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় সবার নজর কেড়েছে রাজা মামার এই রাজা চা।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৯১ বার