রাষ্ট্রপতি জয় করেন, ছাগল না মরায় সচিব ভাঙা মনে আঘাত করেন!
পীর হাবিবুর রহমান।।
অবশেষে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের আরেকটি বড় হাওর ‘শনির হাওরে’র ফসলও গতকাল তলিয়ে গেল। সরকারি হিসাবে অকাল বৃষ্টি ও বন্যায় যেখানে বলা হয়েছিল শতকরা ৮২ ভাগ ফসলহানি ঘটেছে, সেখানে এখন বলা যায় ষোলআনা ফসলই তলিয়ে গেছে। শুধু সুনামগঞ্জ জেলাতেই ২ হাজার কোটি টাকার ওপর ফসলহানি ঘটেছে। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জসহ ভাটির হাওর অঞ্চলের একফসলী বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকের ঘরে ঘরে আর্তনাদের তপ্ত দীর্ঘশ্বাসে শুধু বাতাসই ভারি হচ্ছে না, মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডটিও ভেঙে গেছে।
একদিকে হাওর রক্ষা বাঁধের সীমাহীন দুর্নীতি, সময়ের মধ্যে কাজ না করতে পারা, নদীর নাব্যতা কমে আসা, পাহাড়ের বৃক্ষনিধন ঘটে যাওয়া, সবমিলিয়ে প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেয়ালি আচরণে আজ হাওর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ পাড়ে মানুষের বুকভাঙা হাহাকার ও কান্না। এই সময়ে যেখানে সড়ক থেকে গ্রামের উঠোন ও হাওর পাড়ে ধানকাটা এবং ধান মাড়াইয়ের মহোৎসবে কৃষাণ কৃষাণীদের ব্যস্ত সময় পার করার কথা, নতুন ধান মাড়াইয়ের মউ মউ ঘ্রাণে মানুষের চিত্ত প্রফুল্ল হওয়ার কথা, নবান্নের উৎসবে, বাউল ও মরমী গানের তীর্থস্থান সুনামগঞ্জের সন্ধ্যা গানে গানে পার হওয়ার কথা; সেখানে কেবলই মানুষের অসহায়ত্বের দীর্ঘশ্বাস ও চাহনি।
প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মুগ্ধতা হারিয়ে গেছে সকল হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। ধান পঁচে গিয়ে পানি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। পাথর, মাছ, ধান সুনামগঞ্জের প্রাণ- এই স্লোগান নির্বাসিত হয়েছে। পঁচে যাওয়া ধান নাকি ইউরেনিয়ামের নিঃসরণ যে কারণেই হোক, হাওরজুড়ে মাছ মরে পানিতে ভাসছে। মাছ খাওয়ার সুযোগটাও হাওর অঞ্চরের মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। এই ধান, এই মাছ শুধু সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণার মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি জোগায়নি, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাই আনেনি, দেশের মানুষের এবং প্রবাসীদের চাহিদাও পূরণ করেছে। ধান, মাছ হারিয়ে মানুষ এখন বুকে পাথর বেঁধে, পাথরের মতো চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
সুনামগঞ্জের ২৪ লাখ মানুষের মধ্যে ১৪ লাখ মানুষই কৃষি নির্ভর জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাদের মেরুদণ্ড একদম ভেঙে গেছে। হাওর অঞ্চলের রাজনীতির রাজপুত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ছাত্র জীবন থেকেই গণমূখী রাজনীতিতে মানব কল্যাণের জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থেকে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে টানা ৮ বার ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত হয়ে উঠে এসেছেন। ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। গণমুখী চরিত্রের এই বরেণ্য রাজনীতিবিদকে বঙ্গভবনের চার দেয়াল আটকে রাখতে পারে না।
সময় পেলেই হাওরের সন্তান হাওরে ছুটে যান। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণার ফসল হারা মানুষের কাছে এবারো ছুটে গেছেন। কথা বলেছেন সব স্তরের মানুষের সঙ্গে। যাবার আগে বলোছিলেন, তার সফরসঙ্গী হতে। কিন্তু দিল্লী সফর থাকায় যেতে পারিনি। ব্যথিত চিত্তে তিনি বলেছিলেন, এবারের মতো ফসলহানি অতীতে কখনো ঘটেনি। ফসলহানির দৃশ্য অবলোকন করে তিনি বলেছেন, তার এলাকায় তিনিই সবচে প্রবীণ মানুষ। কিন্তু অতীতে কখনো কাঁচা ধান হওয়ার আগেই ফসল এভাবে তলিয়ে যাওয়ার হৃদয়বিদারক দৃশ্য এর আগে কখনো দেখেননি।
সংবিধান ও আইন তার হাত পা বেঁধে দিলেও হাওরপাড়ের কৃষকের কান্না তার হৃদয়কে এতটাই স্পর্শ করেছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। তিনি সুনামগঞ্জে সবার সঙ্গে মত বিনিময় করে স্বভাবসুলভ রসিকতায় দারুণ ইঙ্গিতবহ কথা বলেছেন। বলেছেন, যেখানে সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সেখানে দুর্নীতি হয় কি করে? তিনি হাওর অঞ্চলের মানুষকে সাহস, সহানুভূতি ও সমবেদনা দিয়ে জয় করতে পেরেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্তোষজনক পদক্ষেপ নিয়েছেন মানুষকে খাবার দিতে। ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীর বিক্রম) সেখানে ছুটে গেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কথা বলেছেন।
দিল্লী থেকে ফেরার পর শুক্রবার রাতেই সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়া ও অদূর ভবিষ্যতে বিপর্যয় প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। ফসলহারা মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাই নয়; বাঁধ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ অর্থ আর ছাড় দেয়া হবে না। আগামীতে বাঁধের জন্য জেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নদীর নাব্যতা বাড়াতে ড্রেজিংয়ের চিন্তাভাবনা করছেন।
ফসলহারা লাখো লাখো মানুষের দিকে তাকিয়ে সুনামগঞ্জ সদর আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ হাজার হাজার জনতার সমাবেশে সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট ও পৌর মেয়র আইয়ুব বখত জগলুলও সংবাদ সম্মেলনে অভিন্ন দাবি জানান। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিক্ষুব্ধ মানুষের কণ্ঠেও দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি ওঠে।
রাষ্ট্রপতির সফর, প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেণ ফসলহারা কৃষকের কান্না মুছে হৃদয় জয় করতে পারলেও তাদের ভাঙা হৃদয়কে আরো বেশি সজোরে আঘাত করে বসেছেন ত্রাণ সচিব শাহ কামাল। সুনামগঞ্জে ত্রাণমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও সুধীজনদের সামনে নিষ্ঠুরভাবে বলেছেন, আইনে রয়েছে-অর্ধেক মানুষ মারা গেলেই কেবল একটি এলাকাকে দুর্গত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এখানে মানুষ মরা দূরে থাক, একটি গরু-ছাগলও যেখানে মরেনি; সেখানে দুর্গত এলাকা ঘোষণা হয় কি করে? তিনি বলেন, যারা দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি করছে তাদের জ্ঞান নেই। বৈঠকে সুনামগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সসদ্য দ্বিমত পোষণ করলেও গোটা জেলাই নয়, বিস্তৃীর্ণ হাওর অঞ্চলের মানুষকেও বিক্ষুব্ধ করেছে। অনেকে বলছেন, ত্রাণ সচিব শাহ কামাল জ্ঞান নেই, বললেও তিনি সাধারণ জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। কোথায় কোন পরিবেশে কি বলতে হয়, কি বলতে হয় না, পরিবেশ পরিস্থিতিতে সঙ্গতি রেখে যে কথা বলতে হয়, তাও তিনি জানেন না। যতদূর জানা যায়, সরকার খাবার দানসহ খোলা বাজারে কমমূল্যে চাল দিলেও এই দুর্যোগ ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাটিয়ে উঠা অনেক কষ্টের।
অন্যদিকে, জানা যায় সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগে বিদ্যমান বিভক্তি ক্ষতে দাঁড়িয়ে একপক্ষ চাইছেন ঠিকাদারদের শায়েস্তা করতে, অন্যপক্ষ চাইছেন জনপ্রতিনিধিরা প্রকল্পের মাধ্যমে যে কাজগুলো করিয়েছিলেন তাদেরকে ধরতে। এই প্রতিযোগিতা-পাল্টা প্রতিযোগিতার আইনগত ফাঁক গলে দুর্নীতিবাজরা না আবার বেরিয়ে যায়। সবচে বড় বিষয় ত্রাণ সচিব শাহ কামালের মন্তব্য কাটা ঘাঁ-য়ে মরিচ ছিটানোর মতো। তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ দাম্ভিক বক্তব্য মানুষের মধ্যে হতাশারই জন্ম দেয়নি, ক্ষোভেরও সঞ্চার ঘটিয়েছে। প্রকৃতির দুর্যোগময় আঘাত যেকোনো সময় আসতে পারে। সেই আঘাতে ক্ষত বিক্ষত মানুষেরা গভীর বেদনাবোধ থেকে সরকারের কাছে দাবি জানাতেও পারে, কিন্তু একটি রাজনৈতিক সরকারের সচিব এইভাবে মানুষকে আঘাত করে বক্তব্য দেয়ার শক্তি পান কোথা থেকে? একটি ছাগল মরে নি বলে তিনি দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিকে প্রত্যাখান করবেন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সেটি গ্রহণ করে না।
একসময় সিএসপি আমলারা ঔপনেবেসিক মনোভাবাপন্ন ছিলেন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বা রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের অভ্যন্তরে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলেও গণমূখী ছিলেন না। কেউ কেউ ঘামে ভেজা শরীরের সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাত মিলালে ধুয়ে নিতেন অথবা টিস্যু পেপারে মুছে নিতেন। কিন্তু স্বাধীন দেশের বর্তমান প্রশাসন অনেক গণমূখী। সরকারের অনেক সচিব রয়েছেন সততায়, দক্ষতায় জনপ্রিয়ই নন, গণবান্ধবও। কিন্তু ত্রাণ সচিব শাহ কামালের অনেক কিছুই ওপেন সিক্রেট, প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ তিনি রাজনৈতিক সরকারের দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে ফসলহারা, রিক্ত, নিঃস্ব মানুষের আবেগ অনুভূতিতে আঘাত করলেন। মানুষ এই আঘাতে অসম্মানিতই হয়নি, ক্ষুব্ধও হয়েছে। ছাত্ররাজনীতির সেই সুবর্ণ সময় থাকলে কিংবা সুনামগঞ্জ শহরে মরহুম আলফাত মোক্তারের মতো আওয়ামী লীগ নেতা বেঁচে থাকলে শাহ কামাল বুঝতেন কি গণআন্দোলন গড়ে উঠে। তিনি এখন পর্যন্ত তার বক্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেননি। এর জবাব একদিন তাকে দিতেই হবে। সরকারের ওপর মহলকেও তার আচরণ আমলে নিতে হবে। এটা মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক