লক্কর-ঝক্কর বাসে বাড়ি ফিরল ক্ষুদে নারী ফুটবলাররা
এই হারে লজ্জা নেই, গ্লানি নেই। কিন্তু নবজাগরণের সূত্রপাত করা ক্ষুদে নারী ফুটবলারদের কদর মোটেও বুঝতে পারেনি ঠাকুরগাঁওবাসী। তাই তাদের ঢাকা থেকে ৫৫০ কি. মি. পথ পাড়ি দিয়ে ট্রেন, লোকাল বাস ও ভ্যানযোগে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে ফিরতে হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সোমবার সময় তখন সকাল ৭টা ১০ মিনিট। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ রেলস্টেশনে একটি শার্টল ট্রেন থামল। ট্রেন থেকে অন্য যাত্রীর মতো ক্লান্ত শরীরে একঝাঁক কিশোরী নামতে শুরু করল। তারা সকলেই ঠাকুরগাঁও রাণীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গি অজোঁপাড়াগায়ের নারী ফুটবলার। যারা প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় নারী ফুটবলের ফাইনালে উঠে রানার্সআপ হয়েছে।
ট্রেন থেকে নেমে পরে পায়ে হেঁটে বাসস্টেশনে গিয়ে একটি লোকাল বাসে করে রাণীশংকৈল উপজেলায় পৌঁছায় তারা। প্রথমবারের মতো চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণ করে রানার্সআপ ট্রফি অর্জন করার পরেও স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিরা নারী ফুটবলারদের খোঁজ নিতেও আসেনি তখন। বরং অবহেলা হয়েছে তাদের সঙ্গে-এমনটাই মনে করছেন রাঙ্গাটুঙ্গির নারী ফুটবলাররা। খেলোয়ারদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য ক্রীড়া সংস্থা বা প্রশাসনের কেউ না থাকলেও এ সময় কয়েকজন পথচারী ফুল দিয়ে বরণ করে নেয় তাদের। পরে তারা ভ্যানযোগে নিজ নিজ বাড়িতে রওনা দেয়। ৫৫০ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে এই ক্ষুদে নারী ফুটবলারদের ট্রেন, লোকাল বাস ও ভ্যানযোগে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে আসায় ক্ষুদ্ধ স্থানীয়রা ও অভিভাবকরা। এই অবহেলা মেয়েদের আগ্রহ কতটুকু বাড়াবে তা জনমতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
নারী ফুটবলার আশামনি, কল্পনা, মুনিরা, সাগরিকা, শিল্পী, শ্যামলীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানায়, প্রথমবারের মতো আমরা জাতীয় পর্যায়ে চূড়ান্ত খেলায় অংশ গ্রহণ করে আমরা খুবই আনন্দিত। কষ্ট করে ট্রেনে ও বাসে করে বাড়ি ফিরে মনে করেছিলাম সবাই আমাদেরকে রিসিভ করবে। কিন্তু কেউ আমাদের আনতেও আসলো না। খেলায় হেরে গিয়ে কষ্ট পায়নি, এলাকার মানুষের অবহেলা বেশি কষ্ট দিয়েছে। তারা আরো বলেন, ফুটবল ফেডারেশন ও সরকার যদি আমাদের ভালো ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে আমরা একদিন জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বে ফুটবলের গৌরব অর্জন করতে পারব নিশ্চয়ই। রাঙ্গাটুঙ্গি ফুটবল একাডেমির কর্ণধার অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম জানান, জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত খেলায় রাঙ্গাটুঙ্গির মেয়েরা রার্নাসআপ হয়ে গৌরব অর্জন করেছে। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ক্ষুদে ফুটবলারদের ট্রেন ও বাসে করে ঘরে ফিরতে হয়েছে অবশেষে। এই দারিদ্র পরিবারের নারী ফুটবলারদের খবর দেশব্যাপি নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। কিন্তু দু:খের বিষয় এলাকার মানুষই তা জানে না। তিনি বলেন, আমি মনে করি রাঙ্গাটুঙ্গির মেয়েরা কমপক্ষে ৭জন ফুটবলার মেধা ও যোগ্যতা দিয়েই জাতীয় মহিলা ফুটবল টিমে জায়গা করে নিবে।
ঠাকুরগাঁও জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (ডিএফএ) সভাপতি মিজানুর রহমান জানান, শুনেছি ঠাকুরগাঁও জেলা অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত খেলায় আমাদের মেয়েরা রার্নাসআপ হয়ে গৌরব অর্জন করেছে। কিন্তু তাদের বাড়ি ফেরা বিষয়ে আমি অবগত নই। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল ও রানীংশকৈল উপজেলা নিবার্হী অফিসার নাহিদ হাসান জানান, প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েরা ঠাকুরগাঁওকে দেশব্যাপী চিনিয়ে দিয়েছে। খেলতে যাওয়ার আগে থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা করেছে প্রশাসন। এই ক্ষুদে ফুটবলারদের ঠাকুরগাঁওয়ে বিশাল আয়োজন করে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জেলা ক্রীড়া সংস্থা। ট্রেনে, লোকাল বাসে ও ভ্যানে করে ঠাকুরগাঁও রাঙ্গাটুঙ্গির মেয়েরা ঘরে ফেরার কারণ জানতে চাইলে ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, নারী ফুটবলাররা কিভাবে আসবে তা আমাদের অবগত করেনি তাদের প্রতিনিধি। অবগত করলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত।
প্রসঙ্গ, শুক্রবার জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় নারী ফুটবল চূড়ান্ত পর্বে ময়মনসিংহের কলসিন্দুর নারী ফুটবলাদের কাছে ৩-০ গোলে হেরে রানার্সআপ ট্রফি অর্জন করেছে ঠাকুরগাঁও রাঙ্গাটুঙ্গির মেয়েরা। তৃতীয়বারের মতো হ্যাটট্রিক শিরোপা ধরে রাখলো ময়মনসিংহের নারী ফুটবলাররা। উপজেলার দুর্গম প্রত্যন্ত পল্লীর এ মেয়ে ফুটবলাররাই দেশের ফুটবলে আশার আলো হয়ে উঠেছেন। তাদের নজরকাড়া পারফরম্যান্সে বেজায় খুশি তাদের বাবা-মা। আনন্দে উদ্বেল স্থানীয় এলাকাবাসীও।