রাজীব বাসিত:

শান্ত চেহারা। চোখে কালো ফ্রেমের মোটা চশমা। কাঁচা পাকা চুল। ঘাড় পর্যন্ত ব্যাক ব্রাশ করা। গায়ে সফেদ পায়জামা পাঞ্জাবী। সাইকেলে শহরের রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে যেতো। ‘হাসন পছন্দ’’ নিজের দেয়া তার নাম।আসল নাম চাপিয়ে এ নামে তার পরিচিতি। যার কথা বলছি, বহুবিদ প্রতিভার অধিকারী সেই জন। নাম মুহাম্মদ আব্দুল হাই। আমাদের ভাই বোনের কাছে তার পরিচয় লখনশ্রী ভাইসাব। শহরের ‘লক্ষনশ্রী’ মহল্লাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘লখনশ্রী’। ‘লখনশ্রী’র ভাইসাবের জন্ম আরপিন নগর তালুকদার বাড়ি। আরপিন নগর, বড়পাড়া, তেঘরিয়া সহ শহরের দক্ষিন পশ্চিম এলাকা সবার কাছে তখন লখনশ্রী নামেই সমধিক পরিচিত। ।

মুহাম্মদ আব্দুল হাই ছিলেন আমাদের পরিবারের সব বড় বোন অর্থাৎ খালাতো বোনের জীবন সঙ্গী। আমার মা ও খালা দুইজনের নিজেদের পরিবারের মধ্য বিয়ে সাদী হয়। তাই আব্বা আম্মার দুই দিক দিয়ে আব্দুল হাই সাহেব ছিলেন তাদের পরিবারের বড় জামাই। আমি সবার ছোট থাকায় বড় কুটুম্ব হিসাবে আমার তেমন কিছু মনে নেই। তবে ভাই বোনদের কাছে উনার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আদর্শিক কর্মকান্ডের অনেক গল্প শুনেছি। বিশেষ করে আমার মেজো বোন ইমদাদুন খানের সাথে উনার সখ্যতা ছিল বেশী। আপার কাছ থেকে উনার গল্প শুনতে শুনতে প্রায় মুখস্থ হয়েগেছে। এখনো কোন আলোকিত মানুষের কিছু দেখলে সাথে সাথে আপা উনার কথা স্মরণ করেন।

উনার কাছে আমার খালাতো বোনের বিয়ে দেয়ার ঘটনা নিয়েও একটা মজার ঘটনা আছে। আমার খালু ছয়ফুল ইসলাম তালুকদার আবার আমার মামাও হোন। মায়ের চাচাতো ভাই। তিনি ছিলেন তখন আমাদের আত্নীয় স্বজন সবার কর্তা ব্যক্তি। উনার বড় মেয়েকে বিয়ে দিবেন। অনেক জায়গা থেকে প্রস্তাব আসে। এর মধ্য আব্দুল হাই সাহেবের পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। শিক্ষা দীক্ষা বংশ মর্যাদা শুনে মামা আগ্রহী হোন। কিন্তু রাজনীতি করেন। জেল খেটেছেন শুনে পরিবারে অনেকে ভিতরে ভিতরে রাজী না হলেও মামাকে বলার সাহস পান না।

জামাই দেখার পালা। বাড়িতে না গিয়ে মামা আগে বাইরে কোথাও থেকে দেখতে চান। রাজনৈতিক সমাবেশ। শোনা গেল আব্দুল হাই বক্তৃতা দেবেন। মামা সেই সমাবেশে গিয়ে জামাই দেখার সীদ্ধান্ত নিলেন। মামা সমাবেশস্থলে গিয়ে হবু জামাই’র বক্তৃতা খুব মন দিয়ে শোনলেন। শুনে আমাদের বাড়ি এসে আম্মা আব্বাকে বলেন, ‘এই ছেলের সাথেই মেয়ে’র বিয়ে দিবো। হাজার হাজার মানুষের সামনে যে ছেলে এতো সুন্দর করে বক্তৃতা দিতে পারে তাকেই তিনি জামাই বানাবেন। তখন আপা আমাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতেন। আব্দুল হাই সাহেবের ভাষন এক সময় উনাকে আমাদের বোন জামাই বানিয়ে দিলো।  শশুর বাড়ি হিসাবে আমাদের ষোলঘর তালুকদার বাড়িতেই রাত ভোর যখন তখন উনার যাতায়াত ছিলো। আমার আব্বা আম্মাও উনার নিজের মেয়ের জামাইদের চেয়ে বেশী আদর করতেন।

আব্দুল হাই সাহেব শিক্ষকতা। সাংবাদিকতা করেছেন। নিজস্ব মালিকানায় উনার মায়ের নামে মুর্শেদী প্রেস ছিল। রাজনীতি করতে গিয়ে পেশা ব্যবসায় বাণিজ্যর দিকে মন দিতে পারেননি। অসম্ভব জনদরদী থাকায় নিজের পরিবারের চেয়ে দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্যই মন বেশী কাঁদতো। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসারন করতেন। টাকা পয়সা যা আয় করতেন সব রাজনীতির পিছনে খরচ করে ফেলতেন। শুনেছি বন্যা-খরা-দুর্ভিক্ষে যে নোঙরখানা খোলা হতো অনেক সময় বেশীর ভাগ ব্যায় ভার একাই তিনি বহন করতেন। এইজন্য অনেকবার উনাকে আর্থিক দুঃখ কষ্টে পড়তে হয়েছে। উনার স্ত্রীর গহনা পর্যন্ত কয়েক বার বন্ধক রেখেছেন। সংসারের প্রতি উদাসীনতা দেখে আপা প্রায়ই রাগ অভিমান করে আমাদের বাড়ি চলে আসতেন। মামাকে না জানিয়েই আম্মা আব্বা আবার আপাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। আসলে পৃথিবীতে জিনিয়াস হয়ে যারা জন্মেছেন তারা সব সময়ই একটু নিজের ব্যাপারে বেখায়েলীই থাকেন। আইনস্টাইন এতো জ্ঞানী হয়েও নিজের বাড়ির দরজার নাম্বার ভুলে যেতেন।

আমার বুঝার বয়স হবার পর ১৯৮০ সালের পরে উনাকে আমি কয়েক বার আমাদের বাড়িতে দেখেছি। মাঝেমাঝে আপার বাড়ী বেড়াতে গেলেও উনার সাথে কখনো দেখা হতোনা। শুধু গল্পই শুনতাম । মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগ থেকে কেন জানি তিনি নিজেকে আস্তেআস্তে রাজনীতি সহ যাবতীয় কিছু থেকে ঘুটিয়ে নেন। অভিমান কিনা জানিনা তবে স্বেচ্ছায় নির্বাসন বলা যায়।

 ৮২ সালের শেষের দিকে আমার সাথে দেখা। জুবিলী স্কুলের সামনে কোচিং শেষে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে হরলাল রায়ের ইয়া মোটা বই। ছাত্র সখা। আমি তখন ক্লাশ ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাস্তায় আমাকে দেখে সাইকেল থামিয়ে তুই না তুমি করে বলেন মনে নেই। বইটা আমার চেয়ে বড়। এতো বড় বই নিয়ে হাঁটতে পারি কিনা? রসিকতাই করেছিলেন। আমাদের বাড়িতে অনেক বছর যাওয়া আসা নেই। তারপরও আমাকে সহজে চিনে ফেলেন। সব মহৎ মানুষের এই এক গুন কাউকে একবার দেখলে সহজে তাঁরা ভুলেন না। অনেক ছোট হলেও আমাকে সহজে ভুলেননি। জিজ্ঞেস করলেন, উনার নাতনী কেমন আছেন? আমার ভাবী উনার সম্পর্কে নাতনী। উনার বোনের মেয়ের মেয়েকে বিয়ে করায় আমার বড়ভাই বড় কুটুম্ব থেকে তখন নাতিন জামাই হয়ে গেছেন। সম্পর্কটা অদল বদল হয়ে যায়।

যাইহোক আমাকে বলেন, সাইকেলে উঠতে। আমি বইটা পিছনে সাইকেলের ক্যারিয়ারে রেখে সামনে শিকের মধ্যে বসি। উনি খুব ধীরে ধীরে সাইকেল চালাতে চালাতে আমার কিছু পরীক্ষা নেন। সন্ধি বিচ্ছেদ, এক কথায় প্রকাশ, ট্রান্সলেশন ইত্যাদি। বাসায় পৌছে সাইকেলটা রেখে ভাবীকে নাতিন ডাকতে ডাকতে ভিতরে যান। কিছুক্ষন বসে চা খেয়ে চলে আসেন।

মারা যাবার আগে বছর দুই সময়ে উনার সাথে শহরের এখানে সেখানে দেখা সাক্ষাৎ হয়ে যেতো। আমার বয়স তখন এগারো বারো হবে। আগে উনার সাথে কদাচিৎ দেখা  হলেও উনার স্মৃতি তেমন মনে ছিলো না। আত্নীয় স্বজন সবার কাছ থেকে বেশ কিছু বছর উনি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলেন। উনি তেমন আসা যাওয়া না করলেও আপার আসা যাওয়া থেমে থাকেনি। আপার সাথে সম বয়সী ভাগ্নাভাগ্নি অনুপা আর গালিব আসতো। ওদের সাথে ছুটাছুটি দৌড়াদৌড়ি করতাম বলে ওদের কথা মনে আছে।

‘৮২ সালের দিকে উনার একমাত্র ছেলে গালিব মাত্র ১৪ বছর বয়সে কিডনী রোগে ভুগে মারা যায়। পুত্র শোক তিনি বেশিদিন সইতে পারেননি। গালিব মারা যাবার ঠিক এক বছরের মাথায় তিনিও চলে যান। ৮৩ সালের এপ্রিলের এক দুপুরে আমাদের বাসায় খবর এলো হার্ট এটাক করে তিনি মারা গেছেন। খরব পেয়ে কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিলো না। বাসার কেউ তা মানতে রাজি না। সবাই সাথেসাথে ছুটে গেলেন উনার বাড়িতে। আম্মার সাথে আমিও গেলাম। উনাকে রাখা হয়েছে ঘরের সামনের রুমে। যে রুমটাতে বই ভর্তি কয়েকটি আলমারী। এই প্রথম আমি মনে হয় উনার ঘরে ডুকলাম। সফেদ কাপড়ে আচ্ছায়িত তার প্রাণহীন শরীর। খালি চোখে দেখে তার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছিলাম না। তার সংগ্রহে এতোএতো বই এর পাহাড় দেখে তেমনি তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অসংখ্য মূল্যবান বই এর সমাহার। এই বই নাকি ছিলো তার প্রাণ। ঘরে অসহায় ভাবে পড়ে আছে একটা ইজি চেয়ার। এখানে তিনি বসতেন। অলস সময় পাড় করতেন। বই পড়তেন। মনে হচ্ছে তিনি ঘুমাচ্ছেন। কিশোর বয়সে দেখা একজন আপন মানূষের মৃত চেহারা  আমার চোখে এখনো ভাসে।

যতো বড় হচ্ছি ততো বেশী উনাকে আবিস্কার করেছি। তিনি ছিলেন একাধারে ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, নাট্যকার, শিক্ষাবিদ, সমাজ সেবক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও লেখক  ইত্যাদি। তাকে অনেকে বিশেষণে বিশেষিত করা যায়। নিজের লিখা বই প্রকাশিত হয়েছে এবং তিনি প্রচুর কবিতা ও গান লিখে গেছেন। মনে আছে ক্লাশ সিক্সে পড়ার সময় আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলাম। স্যার আমাকে ও আমার কিছু সহপাঠিকে দ্বায়িত্ব দিলেন রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে সাহিত্য পত্রিকা ‘দেয়ালিকা’ বাহির করার। বাসায় ‘দেয়ালিকার’কাজ চলছিলো। মরহুম বড় ভাই এডভোকেট আব্দুর রউফ এর নজরে আসলো। কি হচ্ছে? জানতে চাইলেন। দেয়ালিকা প্রকাশের প্রস্ততুতির কথা বললাম। সাহিত্য চর্চা চলছে দেখে তিনি বলেন, ‘আব্দুল হাই ভাইসাবও অনেক গল্প কবিতা লিখে গেছেন। শেষে আউলা হয়ে মারাগেছেন।‘ তার ভাষায় কিছুটা তাচ্ছিল্যের ভাব লক্ষ্য করলাম।

এর মাত্র একমাস আগে আব্দুল হাই ভাই সাহেবের মৃত্যু হয়। মারা যাবার আগে উনি নাকি বেশ উদাসিন হয়ে গিয়েছিলেন। বলতে গেলে সংসার ত্যাগী। বৈরাগী। ভাইয়ের কথায় সাহিত্য চর্চায় আমি কিছুটা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ি। আমার মনের অবস্থা উনি বুঝতে পারেন। তাৎক্ষনা অবশ্য কথা পালটিয়ে বলেন, যাই করো লেখাপড়া ঠিক রেখে করো। আব্দুল হাই আউলা হয়ে মারা গেছেন কেন বলেছিলেন এই কথার অর্থ তখন আমি বুঝিনি। এখন মনে হয় কথাটা তিনি ক্ষোভে এবং দুঃখ থেকে হয়তো তা বলেছেন। জ্ঞানী গুনী একজন মানুষ সমাজের কাছে হয়তো মূল্যহীন রয়েগেছেন বলে। আজও উনার যথার্থ মুল্যায়ন হয়নি। আমি এখন নিজেও কিছু লিখালিখি করি। একটা কবিতার বই বের হয়েছে। গল্পের বই কিছুদিনের মধ্যে বের করার প্রস্ততুতি নিচ্ছি। কিছু লিখতে গেলে মনের অজান্তে সেদিনের বড় ভাই’র কথার সুত্র ধরে আব্দুল হাই সাহেবের কথা এবং উনার বাসার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীটা চোখের সামনে ভেসে উঠে।

তিনি একাধারে সুনামগঞ্জ প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, সুনামগন্জ আর্ট কাউন্সিল (শিল্পকলা) প্রতিষ্টাতা সম্পাদক সহ সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের খণ্ডকালীন বাংলার অধ্যাপক ও শহরের এইচ এমপি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সহ মরমী কবি হাছন বাজার ভাবশীষ্য হিসাবে হাছন মেলা আয়োজন করে গেছেন। হাছন রাজার গান এবং হাছন রাজাকে প্রতিষ্টিত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে যখন বিভিন্ন জেলা,মহকুমা ,থানায় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় তখন মুহাম্মদ আব্দুল হাই ছিলেন সুনামগঞ্জ মহকুমা শাখার সদস্য সচিব ও দেওয়ান ওবায়দুর রেজা আহবায়ক। পরবর্তীতে এই দুইজন আবার পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদন্ধিতা করেন। নির্বাচনে তিনি জয়ী হতে পারেননি। আব্দুল হাই সাহেব আওয়ামীলীগ থেকে প্রার্থী হলেও উনার দলের কিছু মানুষ বিস্বাসঘাতকতা করে। এই পৌরসভার নির্বাচনে আমার বড় ভাই আব্দুর রউফ এক নাম্বার ওয়ার্ডে মাছ প্রতীক নিয়ে বিপুল ভোটে প্রথমবার কমিশনার নির্বাচিত হন। এখনকার এক দুই তিন ওয়ার্ড মিলে ছিলো তখন এক নম্বর ওয়ার্ড। একদিকে ভাই’র বিজয় অন্যদিকে বোন জামাই’র পরাজয় দু’টোর মিশ্রণে আমাদের বাড়িতে নাকি পরিবেশটা তখন ছিল থমথমে।

আমার মেঝো আপার কাছ থেকে শুনেছি যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথেসাথে অর্থাৎ আমার জন্মের আগে আমাদের পরিবার ,আব্দুল হাই সাহেব ও উনার ভাই’র পরিবার সহ সবাই উনার শ্বশুর বাড়ি অর্থাৎ আমার মামার বাড়ি খামার গাও তালুকদার বাড়িতে দুই মাসের মতো ছিলেন। আমার মামার বাড়ির পাশেই ছিলো খ্রিস্টান মিশনারী। বাড়িতে বসে রেডিওতে যুদ্ধের খবর জানা যেতোনা তাই সেখান গিয়ে তিনি সারাদিন রেডিও ওয়ার্লেস ইত্যাদিতে মুক্তিযুদ্ধের খবর রাখতেন এবং বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিতেন। অন্যান্য নেতা কর্মীদের সাথে গোপনে যোগাযোগ ছিল। উনার দুই ভাতিজা জমশেদ চৌধুরী, আজিজ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন।

যখন শোনা যায় মামার বাড়ির পাশাপাশি গ্রামগুলিতে পাকিস্তানি সেনারা চলে এসেছে তখন আব্দুল হাই সাহেব বালাটে চলে যান যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়া হতো। পাকিস্তান সেনাদের আতংকে মামার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া পরিবার গুলি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যার যার সুবিধামতো জায়গায় সরে গিয়ে জীবন রক্ষা করেন।

উনার ভাতিজা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মারুফ চৌধুরী একবার ফেসবুক স্টেটাসে লিখেন এবং আমাকে নিজেও ফোনে বলেন যে বঙ্গবন্ধুকে যখন ৭৩ সালে সুনামগঞ্জ আমন্ত্রণ জানানো হয় তখন একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। তখন কমিটির সভাপতি ছিলেন অক্ষয় কুমার দাস ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মুহাম্মদ আব্দুল হাই। আর ঐ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন শুধু বঙ্গবন্ধু, আব্দুস সামাদ আজাদ , বাবু অক্ষয় কুমার দাস। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মুহাম্মদ আবদুল হাই। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার জন্য এই দুই তিন জন ছাড়া আর কাউকে স্টেজে উঠতে দেয়া হয়নি তবে অন্যান্য বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ নেতা ও ছাত্র নেতারা স্টেজের পাশাপাশিই ছিলেন। তখন ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন আব্দুল হাই সাহেবের ভাগিনা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নুরুজ্জামান শাহী। বঙ্গবন্ধুকে ফুলের মালা পড়িয়ে স্বাগত জানান ছাত্রলীগ নেত্রী কামরুন নেছা উনার সাথে আরো কিছু সাথী নিয়ে। এই সাথীদের মধ্য আমার বোন ইমদাদুন খানকেও আব্দুল হাই সাহেব সুযোগ করে দেন।

মুহাম্মদ আব্দুল হাই ১৯৫৬ থেকে ৭২ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ মহকুমা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী ছিলেন। ১৯৫৬ এর আগে দফতর সম্পাদক ছিলেন। দুঃখ লাগে যখন দেখা যায় এখন উনার নাম পর্যন্ত কেউ উচ্চারণ করতে চায় না। গত কয়েক বছর আগে অবশ্য পুরাতন শিল্প কলা একাডেমির মিলনাতয়নের নাম উনার নামে অনুমোদন হয়। এখন কোন রকমে একটা ছোট খাট সাইনবোর্ড শুধু ঝুলছে। এই শহরের কিছু মানুষ এমন কি উনার নিজের আত্নীয় স্বজনরাই কিছু ভুল মানুষের ইতিহাস নিয়ে ব্যস্ত। এরকম আলোকিত ত্যাগী মানুষগুলি অন্ধকার মানুষ দ্বারা আজ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু ভুল মানুষের ইতিহাস জেনে হয়তো বড় হবে। এই জন্য এখন থেকেই এর প্রতিকার দরকার। এর জন্য ধন্যবাদ দিতে হয় মুহাম্মদ আব্দুল হাই সাহেবের ভাগিনা ইংল্যান্ড প্রবাসী ইমানুজ্জামান মহীকে যিনি আমার কাছে একটি লিখা আহবান করেন। তিনি উনার নামে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত করতে যাচ্ছেন। মুহাম্মদ আব্দুল হাইয়ের মতো মানুষের জন্য কিছু লিখা আমার জন্য সৌভাগ্যর বিষয়। এই গ্রন্থে উনার সম্বন্ধে বিভিন্ন লেখকের লিখা থেকে হয়তো জানা অজানা আরো অনেক তথ্য জানা যাবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সমাজ ও দেশের প্রতি তার অবদান কিছুটা খোলাসা হবে।

লেখক – আব্দুল বাছিত রাজীব-একাউন্ট্যান্ট, কবি ও লেখক, নিউক্যাসেল, ইংল্যান্ড।

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn