ফাইল ছবি

শুভ্র দেব–মদ, ইয়াবা, নারী, ডিজে পার্টি। রাতভর ফ্যান্টাসি। ইভটিজিং। বেপরোয়া রেসিং। চাঁদাবাজি, খুন-খারাবি। প্রতিপক্ষকে হুমকি। কিসে না জড়াচ্ছে উঠতি এক শ্রেণির তরুণ ও কিশোররা? এভাবেই বিপথগামী হচ্ছে তারা। শুধু তাই নয়, ইন্টারনেটে আসক্তি, পর্নো মুভি কিশোরদের বিপথগামী করছে।

ঘরে ঘরে এখন এমন আসক্তি ছড়িয়ে পড়ছে। কিশোর-তরুণেরা নিজেদের প্রভাব দেখাতে গিয়ে বেপরোয়া আচরণ করছে। আধিপত্য বিস্তারে গড়ে তুলছে কিশোর গ্যাং। একের পর এক ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। আর তাদের মদত দিচ্ছে এলাকাভিত্তিক কথিত নেতারা। বেপরোয়া তরুণ-কিশোরদের লাগামহীন জীবন নিয়ে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, সমাজ, প্রশাসন সবাই উদ্বিগ্ন। তাদের নেই সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনূভতি। তথ্য প্রযুক্তির নেতিবাচক আসক্তিতে ডুবে তারা প্রতিনিয়ত শিখছে নানা অপরাধ। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে। হত্যা ধর্ষণের মতো ঘটনায় এখন সবার আগে নাম উঠে আসে কিশোর-যুবকদের। সমাজ, অপরাধ বিশ্লেষক ও মনোবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সন্তানদের উপর অভিভাবকদের নজরদারি নেই। সন্তানরা কি চায়, তাদের কথা ও চাওয়াগুলো অভিভাকরা মনযোগ দিয়ে শুনছেন না। তারা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, তাদের ইন্টারনেট আসক্তি কতটুকু বেড়েছে এসব ব্যাপারে খেয়াল নেই। পরিবারের সঙ্গে সন্তানদের বড় ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া বেড়ে ওঠার সঠিক পরিবেশ, খেলাধুলার সুযোগ না পাওয়ায় তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে বিপথে পা বাড়াচ্ছে। 

সম্প্রতি ঢাকার কলাবাগানে একটি ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর তার বন্ধু কর্র্তৃক ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশ আনুশকার বন্ধু ফারদিন ইফতেকার দিহানকে গ্রেপ্তার করে। দিহান এখন কারাগারে। ঘটনার দিন সকালে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা বলে আনুশকা ডলফিন গলির দিহানের বাসায় যায়। পরে সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়ে আনুশকা। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার পরপরই সামনে চলে আসে দিহানের বেপরোয়া জীবনের কাহিনী। দিহান বন্ধুদের নিয়ে রাতভর আড্ডা দিতো। নেশায় ডুবে থাকতো। একাধিক ঘনিষ্ট বান্ধবী ছিল। বেপরোয়া ড্রাইভিং, মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতো। এই ঘটনার পরপরই ২৮শে জানুয়ারি ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে তার দুই বন্ধু আরাফাত ও রায়হান উবারের গাড়িতে করে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল নেহা ও আরো এক বন্ধু। ওই রেস্টুরেন্টে তারা সবাই একসঙ্গে মদ পান করে। অতিরিক্ত মদ পান করায় অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই শিক্ষার্থী। পরদিন ওই শিক্ষার্থী মৃত্যুবরণ করেন। পুলিশ জানিয়েছে, আগে থেকেই এ রকম একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছিলেন নিহত শিক্ষার্থী ও তার বন্ধুরা। বাইরে থেকে মদ সংগ্রহ করে তারা ওই অনুষ্ঠানে মদ পান করেছিল। বিষাক্ত মদ পান করায় নিহত শিক্ষার্থী ও তার বন্ধু আরাফাত মারা যান।

হাতিরঝিলে আসা দর্শনার্থী নারী-পুরুষকে উত্যক্ত, হয়রানি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে হাতিরঝিল থানা পুলিশ ৮ দিনে ৩৪৩ কিশোরকে আটক করেছে। এদের মধ্যে ২৬৯ কিশোরকে তাদের অভিভাবকের জিম্মায় দেয়া হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে উঠে এসেছে ঢাকার মোহাম্মদপুর, উত্তরা, ধানমণ্ডি, মিরপুরসহ আরো কিছু এলাকা কিশোর অপরাধীদের অভয়ারণ্য। এসব এলাকাসহ পুরো ঢাকায় নামে-বেনামে প্রায় অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। প্রতিটি গ্যাংয়ে ১৫ থেকে ২০ জনের উপরে সদস্য রয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিজাত ঘরের সন্তানরা এসব গ্যাংয়ের সদস্য। খুন-খারাবি, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, জমি দখলে সহযোগিতা, হুমকি-ধমকি, ধর্ষণ, ইভটিজিং, আধিপত্য বিস্তারে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সবকিছুতেই তাদের অংশগ্রহণ রয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন, নানা সুপারিশ, গ্রেপ্তার, ধরপাকড় দিয়েও এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ঘটাচ্ছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, ছেলে-মেয়েরা কোনো আইসোলেশনে থেকে বড় হয় না। তারা সমাজের মধ্যে থেকেই বড় হয়। সমাজের মধ্যে কি এলিমেন্ট আছে যা একটি সন্তানকে এ রকম করে বড় হতে সাহায্য করে? স্কুল একটি বড় বিষয়। স্কুলে বাচ্চাদের জন্য কী কী সুযোগ সুবিধা আছে। বাবা-মা সন্তানদের কীভাবে কেয়ার নিচ্ছে। একটা বাচ্চার মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো কীভাবে গড়ে উঠছে সেটা তার নিজের ওপর নির্ভর করলেও তার চারপাশের পরিবেশও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মা সন্তানের কীভাবে খেয়াল রাখছে, স্কুলের পরিবেশ কেমন, তার বেড়ে ওঠার চারপাশের পরিবেশ কী রকম সেটি খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, কিছু কিছু বাবা-মা অঢেল টাকার মালিক। তারা তাদের বাচ্চাদেরও চাহিদামতো টাকা দেয়। তবে তার বাচ্চারা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে সেগুলো খেয়াল রাখে না। আর এই নিয়ন্ত্রহীন চলাফেরা বাচ্চাদের বিপদগামী করে। বাচ্চারা কোথায় যাচ্ছে সেটা জানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি তাদের চাহিদার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, জানতে হবে।

সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মানবজমিনকে বলেন, প্রত্যকটা বয়সের একটা ধর্ম আছে। তরুণরা যা কিছু করছে এটাও তাদের বয়সের ধর্ম। তবে যেসব কিশোর-তরুণরা বিকৃত রুচির, তাদের বেড়ে ওঠা সুন্দর হয়নি। যার যার বেড়ে ওঠার সঙ্গে তার আচার-আচরণ প্রতিফলিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সন্তানদের সুপারভাইজ করার মতো কেউ নাই। হয় বাবা-মা দু’জনেই চাকরি করে। না হয় মা ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মায়ের ভালো যোগাযোগ নেই। তিনি বলেন, আমাদের সন্তানেরা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে কী না, তার পকেট খরচ বাড়ছে কী না। সন্তানরা প্রায়ই সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে খেয়াল রাখতে হবে সে রাতে কী করে। তিনি বলেন, কিশোর-তরুণদের এসব কারণ হচ্ছে তাদের খেলার মাঠ নাই, বেড়ে ওঠার মতো ভালো পরিবেশ পাচ্ছে না। তারা ঠিকমতো সামাজিক সুরক্ষা পাচ্ছে না। যখন বাইরে খেলার কথা তখন সেই সুযোগ না পেয়ে তারা মোবাইল অথবা কম্পিউটারে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেটে কী দেখছে, কী জানতেছে সেটা আমরা জানিনা। এজন্য তাদের মানসিকতা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। তাই অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের গন্তব্য জানিয়ে দেয়া। যেন তারা যাই করুক তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যখন তাদের কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারে না তখন নানা ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। এসব ঘাটতি থেকেই কিশোর-তরুণরা অপরাধী হয়ে ওঠে। নিজ দেশের সংস্কৃতি, সামাজিক কাঠামো, শিষ্টাচার একটা মানুষকে সঠিক জায়গায় রাখে, মানুষ হিসাবে গড়ে তোলে। কিন্তু এগুলো চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে একটি শূন্যতা বা দুরত্ব আছে। মূলত প্রযুক্তির একটা নেতিবাচক প্রভাবের কারণেই এই দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কিশোর-তরুণদের প্রযুক্তির নেতিবাচক বিষয়ের ওপর আসক্তি অনেক বেড়ে গেছে। অথচ সামাজিক ও পারিবারিক যে শিক্ষা পাওয়ার দরকার ছিল তারা সেটি পাচ্ছে না। বেশিরভাগ পরিবারই সন্তানদের সেই শিক্ষা দিচ্ছে না, অনেক পরিবারই দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। একটা সন্তান যখন বড় হয়ে অপরাধী হয়ে ওঠে তখন এই উপলব্ধিটা তার পরিবারকেই করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, কিশোর-তরুণরা অপরাধী হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা কাদের সঙ্গে মেলামেশা ও সময় পার করছে। তার বন্ধুবান্ধব কারা। কারণ মানুষ বন্ধুর মতাদর্শে খুব তাড়াতাড়ি প্রভাবিত হয়। এছাড়া রাষ্ট্র ও সমাজের ভূমিকা থাকতে হবে। রাষ্ট্রকে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। তাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষার কথা শুনতে হবে। সেগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষকদেরও নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা নিতে হবে। আর কেউ অপরাধ করলে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।-মানবব্জমিন

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn