শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অশুভ ছায়ামুক্ত হচ্ছে ছাত্রলীগ
অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, দেশজুড়ে সংঘর্ষের ঘটনায় বার বার গণমাধ্যমের শিরোনামে আসছে ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনটির বর্তমান দশা দেখে অনেকেই বলছেন, ‘পুরনো চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ছে ছাত্রলীগে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে বইছে সুবাতাস, তখন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের এমন আচরণ ভাবিয়ে তুলেছে হাইকমান্ডকে। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিনের পুরনো বলয় ভেঙে নতুন ধারায় চলতে শুরু করেছে ছাত্রলীগ। সে কারণে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই ছাত্রলীগের প্রভাবশালী এক সভাপতির শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অশুভ ছায়া থেকে মুক্ত করতে ছাত্রলীগে কাজ শুরু হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সবার উপস্থিতিতে সংগঠনের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনকে তোপের মুখে পড়তে হয়। সোহাগ ও জাকিরের জীবনাচরণ এবং তাদের খরচের অর্থের উৎস নিয়ে বৈঠকে প্রশ্ন তোলেন সংগঠনের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। শুধু তা-ই নয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্মেলন আয়োজনের দাবিও তোলেন কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। চলতি মাসের ২৬ তারিখের পর শেষ হচ্ছে সাইফুর রহমান সোহাগ ও এসএম জাকির হোসাইনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিটির মেয়াদ। কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় অংশ নির্ধারিত সময়ে সম্মেলনের পক্ষে। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সম্মেলনের পক্ষে নয় আওয়ামী লীগের অপর একটি বড় অংশ। তবে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি আগামী নির্বাচনে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়েও দ্বিধা রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে।
ছাত্রলীগের বর্তমান এবং সাবেক শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রক বলে এক দশক ধরে পরিচিত বর্তমান ও সাবেক ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘পুরনো চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ছে দিন দিন। ছাত্রলীগের কিছু সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নেতাদের নেতৃত্বে নতুন মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে ছাত্রলীগে। এ প্রভাব পড়ছে সংগঠনে। ইতোমধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক এক শীর্ষ নেতা, যিনি সংগঠনটির মূল নিয়ন্ত্রক বলে পরিচিত ছিলেন, তার সঙ্গে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির নেতাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আগের মতো ছাত্রলীগের সঙ্গে নিবিড় সখ্য নেই ওই নেতার।
নেতাদের ভাষ্যমতে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা কেবল কাগজে-কলমেই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সংগঠনের নিউক্লিয়াস ছিলেন সাবেক ওই শীর্ষ নেতাসহ আরও কিছু সাবেক নেতা। কিন্তু অতিসম্প্রতি ওই শীর্ষ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ কমায় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে। অবশ্য ওই শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, তিনি নিজে থেকেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিষয় থেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন; চেষ্টা করছেন ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট বিষয় থেকে দূরে সরে যেতে। এ কারণে পুরনো বলয়ের বদলে নতুন মেরুকরণের আলামতও দেখা যাচ্ছে ছাত্রলীগে। ফলে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা বাড়তে শুরু করেছে সোহাগ-জাকিরের। এ কারণে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংঘর্ষ-হানাহানির ঘটনাও ঘটছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, সামগ্রিকভাবে ছাত্রলীগে শৃঙ্খলাবোধ ফিরিয়ে আনা জরুরি। এ জন্য ছাত্রলীগের নেতৃত্বের গুণগত মানের দিকে খেয়াল করা উচিত বলে আমি মনে করি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের জন্য খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে সংগঠনটির দেখাশোনা এবং তাকে ছাত্রলীগ বিষয়ে পরামর্শ দেন আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ছাত্রলীগের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতা আলাপকালে বলেন, ছাত্রলীগ এখন প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কারো নির্দেশনা মানে না। একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই ছাত্রলীগের অভিভাবক, যে কারণে অনেকেই নাখোশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে অসন্তোষের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে একের পর এক বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটাচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গত মঙ্গল ও বুধবার চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে অস্ত্রবাজি, সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে জড়ানো দুই পক্ষই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। তবে চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি নেই এবং এই ঘটনা ছাত্রলীগের কেউ ঘটায়নি বলে আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে দাবি করেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ।
গত বুধবার চট্টগ্রামের পাশাপাশি সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসেও ছাত্রলীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষ, কলেজের জানালা দরজা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এই কলেজেও ছাত্রলীগের কোনো কার্যক্রম নেই বলে দাবি করেন সভাপতি সোহাগ।
এ ছাড়া ৬ মাসে সারা দেশে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শুধু চট্টগ্রামেই গত দেড় বছরে কমপক্ষে ২৫ বার মারামারি করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে নিহত হয়েছেন তিনজন, আহত হন প্রায় ৬০ জন। ছাত্রসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজের বদলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিতে ছাত্রলীগের অনেক নেতা জড়িয়ে পড়ায় এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘লাঠিয়াল’ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বলেন, ছাত্রলীগ একটা বড় সংগঠন। আমাদের ১০১টা ইউনিট সারা দেশে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কিছু জায়গায় টুকটাক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু যেখানেই সংঘর্ষ ঘটছে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, কোনো ঘটনায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকি না। তাই দু-একটি ছোটখাটো ঘটনার জন্য ছাত্রলীগের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ছে এটা বলা সমীচীন নয়। অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রেখেছি। এ কারণে আমাদের বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকেই অনেক অভিযোগ করেছেন, সবার বাকস্বাধীনতা অবাধ রেখেছি আমরা।