শত বাধা পেরিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সিলেটের রুকসানা
সিলেট :: আবারও মুয়ে থাই বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট অর্জন করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুকসানা। সুইডিশ সুজানা স্যালমিজার্ভিকে পরাস্ত করেন তিনি। এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে তাকে বিশ্বের সেরা ১০ নারী বক্সারকে পরাস্ত করতে হয়। এর আগেও চার বছর নিজের দখলে রেখেছেন ব্রিটিশ কিক বক্সিং ও মুয়ে থাই চ্যাম্পিয়নের সম্মান। অথচ পরিবার রক্ষণশীল হওয়ায় লুকিয়ে বক্সিং অনুশীলন করতে হয়েছিল তাকে।
তাকে দেখে বোঝার জো নেই হাতে কী পরিমাণ শক্তি! হ্যাংলা-পাতলা গড়নের রুকসানা বেগম এখন সমগ্র বিশ্বের এক আলোচিত নারী ক্রীড়াবিদ। শক্তিশালী এই নারী বক্সারের জন্ম লন্ডনের সেভেন কিংস এলাকায়। লন্ডনে জন্ম নিলেও রুকসানার দাদার বাড়ি বাংলাদেশের সিলেট জেলার বালাগঞ্জে। বাবা আওলাদ আলী এবং মা মিনারা বেগম দম্পতির তিন ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে রুকসানা দ্বিতীয়। ২০০৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিনস্টার থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন রুকসানা। ১৬ বছর বয়সে রুকসানা সর্বশেষ বাংলাদেশে আসেন।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রুকসানা পর পর চার বছর নিজের দখলে রেখেছেন ব্রিটিশ কিক বক্সিং ও মুয়ে থাই চ্যাম্পিয়নের সম্মান। চলতি বছরের এপ্রিলেও পঞ্চমবারের মতো মুয়ে থাই বিশ্বচ্যাম্পিয়নের সম্মান অর্জন করেন রুকসানা। এই প্রতিযোগিতায় সুইডেনের সুজানা স্যালমিজার্ভিকে পরাজিত করতে হয়েছিল তাকে। এর আগে রুকসানাকে ধাপে ধাপে বিশ্বের সেরা ১০ নারী বক্সারকে পরাস্ত করতে হয়। কিক বক্সিং কঠোর শারীরিক কসরতনির্ভর একটি খেলা। এই খেলায় পর পর পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন রুকসানা।
বক্সার হয়ে ওঠা :: অনেকটা হুট করেই রুকসানার বক্সার হয়ে ওঠা। তখন তার বয়স সতেরো কী আঠারো। ব্রিটেনের একটি ব্যায়ামাগারে ভর্তি হন রুকসানা। শরীরচর্চা করতে গিয়ে শখের বশে শুরু করেন বক্সিং প্রশিক্ষণ। লন্ডনের বেথনাল গ্রিন এলাকার সেই ব্যায়ামাগারে সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, খ্যাতনামা প্রশিক্ষক বিল জাডের কাছে থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী মুয়ে থাই শেখার সুযোগ পান রুকসানা। শখের বশে যে খেলা শুরু করলেন, সেটিই হয়ে উঠল তার ধ্যান-জ্ঞান।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রুকসানা বলেন, ‘প্রথমদিকে বক্সিং শেখার বিষয়টি গোপন রেখেছিলাম। ২০০৬ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার পর বিষয়টি পরিবারকে জানাই। প্রথমে কিন্তু পরিবার থেকে একদমই সমর্থন পাইনি। পুরুষ অথবা নারীর বিপক্ষে স্বল্প বসনে ঘরের মেয়ে বক্সার কোটে খেলবেন তা কিছুতেই মা-বাবা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তারা এমন খেলার প্রতি আগ্রহের কথা শুনে খুশি হতে পারেননি।’
তবুও লড়াই চালিয়ে গেলেন তিনি। এরপর আস্তে আস্তে বিষয়টিতে বাবা-মা অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। রুকসানার ভাষায়, ‘ফাইটে যাওয়ার আগে মা বুকে জড়িয়ে দোয়া করেন, যাতে আমার কোনো ক্ষতি না হয়। ’ তবে রুকসানা কখনো নিজের ‘ফাইট দেখাতে বাবা-মা-কে নিয়ে যান না। এর কারণ হিসেবে বললেন, ‘মারামারির ওই মুহূর্তগুলো বাবা-মা সহ্য করতে পারবেন না। তারা ভয় পাবেন।’
কঠোর অনুশীলন :: বক্সিংয়ে সাফল্যের জন্য শারীরিক সক্ষমতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একজন সফল বক্সার হিসেবে রুকসানাকেও কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে শরীরচর্চা করতে হয়। শরীরের ওজন ধরে রাখতে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। রুকসানা চেষ্টা করেন শরীরের ওজন ৪৮ থেকে ৫০ কেজির মধ্যে ধরে রাখতে। এ জন্য শুধু নিয়ম মাফিক খাওয়া-দাওয়াই নয়; চলে ঘামঝরা নানা কসরত। সপ্তাহে ছয় দিন ২ ঘণ্টা করে চলে ব্যায়াম। শরীরচর্চার অংশ হিসেবেই পরিমিত বিশ্রামের প্রয়োজন হয় তার।
প্রথম সাফল্য :: ২০০৯ সালে রুকসানার প্রথম সাফল্য আসে। ব্রিটেন জাতীয় দলের হয়ে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড অ্যামেচার কিক বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় স্থান অর্জন করে আলোচনায় আসেন তিনি। তখন থেকেই স্বপ্নের পরিধি কেবল বাড়তে থাকে। ২০১১ সালে রুকসানা লাটভিয়ায় আয়োজিত ইউরোপিয়ান ক্লাব কাপে সোনা জেতেন। একই বছর তিনি পান মুসলিম ওম্যান ইন স্পোর্টস ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড। পরের বছর রুকসানা নির্বাচিত হন ‘এশিয়ান অ্যাচিভার স্পোর্টস পার্সোনালিটি অব দ্য ইয়ার’।
লন্ডন অলিম্পিকের মশাল হাতেও ছুটেছেন তিনি। ফাইট ফর পিস দাতব্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছেন রুকসানা। জড়িয়ে আছেন আরও নানা সামাজিক কাজের সঙ্গে। গেল বছরের মতো এ বছরের এপ্রিলেও মুয়ে থাই খেলায় নামলেন। রীতিমতো তার চোখে-মুখে যেন আগুন ঝরছিল। প্রতিপক্ষ ছিলেন সুইডিশ চ্যাম্পিয়ন সুজানা স্যালমিজার্ভি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছিল। উচ্চমাত্রার বক্সিং খেলায় পাঁচ রাউন্ডের প্রতিটিতে হারিয়ে মুয়ে থাই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন খেতাব অর্জন করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বক্সিংকন্যা রুকসানা বেগম।