শীতের টাঙ্গুয়ার হাওর
সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলা৷ সেখানকার টাঙ্গুয়ার হাওর দেশি ও পরিযায়ী পাখির অন্যতম বড় অভয়ারণ্য৷ জায়গাটিতে সবচেয়ে বেশি পাখি দেখা যায় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে৷ঢাকা থেকে দুই দিন হাতে নিয়ে বের হলেই দেখে আসা যায় জায়গাটি৷ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার বিশাল জায়গা জুড়ে টাঙ্গুয়ারহাওর৷ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এ হাওর পরিযায়ী পাখি আর মাছের অভয়ারণ্য৷ বর্ষা মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরের পুরোটাই পানিতে তলিয়ে থাকে৷ শীত এলে পানি কমতে শুরু করে৷ ভরা শীতে হাওরের পানি তলানিতে ঠেকে৷ তখন হাওরের বড় একটা অংশই শুকিয়ে যায়৷
টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তৃতি ধর্মপাশা ও তাহিরপুরের দশটি মৌজা নিয়ে৷ ছোট-বড় ১২০ টি বিল নিয়ে এ হাওর৷ দুই উপজেলার ৪৬টি গ্রামসহ পুরো টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ২ লক্ষ ৮০ হাজার ২৩৬ হেক্টরই জলাভূমি৷
প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৩৪ প্রজাতির সরিসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাসস্থল এই টাঙ্গুয়ার হাওর৷ প্রতি বছর শুধু শীতকালেই পৃথিবীর বিভিন্ন শীত প্রধান দেশ থেকে আরো প্রায় ২০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখিরা এ হাওরকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয়৷ টাঙ্গুয়ার হাওরে আছে ১৪০ প্রজাতিরও বেশি স্বাদু পানির মাছ৷ এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রুই, কালি বাউশ, কাতল, আইড়, বোয়াল, গাং মাগুর, বাইম, তারা বাইম, গুলশা, গুতুম, টেংরা, তিতনা, গজার, গরিয়া, বেতি, কাকিয়া ইত্যাদি৷ টাঙ্গুয়ার হাওরের রুই ও কাল বাউশ মাছের স্বাদ অতুলনীয়৷
শীত মৌসুমে সবচেয়ে বেশি যে পরিযায়ী পাখিরা টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাপ পাখি, বড় পানকৌরি, ছোট ডুবুরি, বড় খোপা ডুবুরি, ধুপনি বক, বেগুনি বক, মেটে রাজহাঁস, চখাচখি, ছোট সরালি, বড় সরালি, লেনজা হাঁস, খুনতে হাঁস, পাটারি হাঁস, ফুলুরি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, সিঁথি হাঁস, পাতি হাঁস, বালি হাঁস, লাল ঝুটি ভুতি হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, পান্তা ঝিলি, মেটেবুক ঝিলি, জল মোরগ, লালবুক গুরগুরি, নেউ পিপি, কায়েম, দলপিপি, কুট, লাল ঢেঙ্গা, মেটেমাথা টিটি, তিলা লালপা, লালপা, সবুজপা, বিল বাটান, সোনালি বাটান, কালোমাথা গাঙচিল, খয়রামাথা গাঙচিল, কুরা, বড় চিত্রা ঈগল, তিলা নাগ ঈগল ইত্যাদি৷
টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রধান দুটি পাখির অভয়ারণ্য হলো লেউচ্ছামারা ও বেরবেড়িয়ার বিল৷ এছাড়াও যে বিলগুলোতে পাখিদের আনাগোনা বেশি থাকে সেগুলো হলো রৌয়ার বিল, গজারিয়ার বিল, আলমের ডোয়ার, সাংসার বিল, কৈখালি বিল, ছুনখোলা বিল, জিততলার গোপ, ফইল্লার বিল, রূপাভুই বিল, সত্তার বিল, মইষের গাতা, হাতির গাতা, বালোয়ার ডোবা, আমছারের বিল, কাউয়ার বিল, আনসারের বিল, খাজুরী বিল, আইন্নার বিল, নলকাঠির বিল ইত্যাদি৷ টাঙ্গুয়ার হাওরের ঠিক মাঝখানটায় সুন্দর বিল হাতিরগাতা৷ মূলত এ বিলের চারপাশেই রয়েছে হাওরের অন্য বিলগুলো৷ শীতে হাতিরগাতা এলাকার বেশিরভাগই শুকিয়ে যায়৷ জনশ্রুতি আছে ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা শীতে শুকিয়ে যাওয়া হাওরের মাঝখানের এই জায়গায় হাতি চড়াতে আসতেন বলেই এই নাম পেয়েছে জায়গাটি৷
দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় দেখা যাচ্ছে৷ গোলাবাড়ি টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রবেশ মুখের একটি জায়গা৷ এখানকার হিজল বন পর্যটকদের খুবই প্রিয়৷ পর্যটকদের জন্য একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারও আছে গোলাবাড়ির হিজল বনের পাশে৷ এখানে সাম্প্রতিক সময়ে একটি ছোট আকারের রিসোর্টও গড়ে উঠেছে৷ এছাড়া হাওরের কাছে পর্যটকদের রাত কাটানো আর কোনো জায়গা নেই বললেই চলে৷
টাঙ্গুয়ার হাওরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে অনন্য সুন্দর দুই নদী ‘জাদুকাটা’ আর ‘পাতলাই’৷ হাওর ভ্রমণে গেলে এই দুই নদী না দেখলে অনেক কিছুই মিস করবেন৷ এই দুটি নদীর পানি যেমন টলটলে, তেমনি এর দুই পাশের দৃশ্যও পাগল করার মতো৷ তাহিরপুরের আনোয়ারপুর থেকে জাদুকাটা নদী ধরে চলে যাওয়া যায় ভারত সীমান্তের কাছের বারেকের টিলায়৷ এ জায়গাটিও অনেক সুন্দর৷ আর জাদুকাটা তীরের বিশাল শিমুল বাগানও দেখার মতো জায়গা৷ মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এ বাগান ফুলে ফুলে ভরা থাকে৷ টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে যেতে প্রথমে আসতে হবে জেলা শহর সুনামগঞ্জে৷ রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জে যাওয়া যায় সড়ক পথে৷ এছাড়া বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে সিলেট গিয়ে সেখান থেকেও সহজেই যাওয়া যায় সুনামগঞ্জ৷ ঢাকার সায়দাবাদ বাস স্টেশন থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এনা পরিবহন, মামুন পরিবহনের বাস যায় সুনামগঞ্জ৷ সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যেতে হবে লেগুনা কিংবা অটো রিকশায়৷ এ পথে মোটরবাইকও যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করা হয়৷
তাহিরপুর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন রকম নৌকা ভাড়ায় পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে কিছু নৌকায় পর্যটকদের থাকা ও খাবার ব্যবস্থাও আছে৷ অনেকটা হাউস বোটের মতোই এসব নৌকা৷ এ নৌকাগুলো সাধারণত টাঙ্গুয়ার হাওরের মূল প্রবেশমুখ গোলাবাড়িতে নোঙ্গর করে৷ হাওরের ভেতরের পাখির অভয়ারণ্যে কোনো ইঞ্জিন চালিত নৌকা চালানোর অনুমতি নেই৷ ফলে সেখান থেকে হাওরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছোট নৌকা ভাড়া করতে হবে৷