শেখ কামালের কি বদনাম নিয়ে মরার কথা ছিল?
আগামী পর্ব আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের দিন ১৫ আগস্ট শোক দিবস। সেদিন সেদিনের কথা বলব। কদিন থেকেই যুবলীগ শেখ কামালকে নিয়ে আলোচনা করছে। শেখ কামাল যুবক ছিল, কখনো যুবলীগ করেনি। যুবলীগের জন্ম দিয়েছিলাম আমরা। জনাব শেখ ফজলুল হক মণি সভাপতি, আমরা কয়েকজন ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডিয়াম সদস্য। সেই যুবলীগ শেখ কামালকে নিয়ে আলোচনা করায় আনন্দিত হয়েছি। শেখ কামালও আর দশজন বাঙালির মতো ছিল। তার হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা সবই ছিল আমাদের মতো। কত আর হবে আমার থেকে দুই-আড়াই বছরের ছোট। ’৭২-এর ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন আমার হাত থেকে অস্ত্র নিতে টাঙ্গাইল গিয়েছিলেন সেখানে জামাল-রাসেল ছিল, কামাল ছিল না। ১৮ ডিসেম্বর ’৭১ পল্টনে প্রথম জনসভায় শেখ জামালকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা ছিলাম বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে লতায়-পাতায়, ছায়ায়-মায়ায় জড়িত।
রাজনৈতিক নানা টানাপোড়েন চললেও মানবিক দিক থেকে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আমার ছোট বোন রহিমা ’৬০-৬১ সালে পূর্বদেশে শিশু বিভাগ সম্পাদনা করতে ঢাকা এলে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী তাকে ধানমন্ডির ৩২-এর বাড়িতে রেখেছিলেন। এক-দুই দিন তিনি না যাওয়ায় ক্লাস এইট-নাইনে পড়া রহিমা খুবই চিন্তিত হলে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা রহিমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি জানো না লতিফ আর আসবে না। ও তো তোমাকে বিক্রি করে গেছে। ’
এ কথা শুনে রহিমার সে কী কান্না। তখন তিনি রহিমার মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করে বলেছিলেন, ‘তুমি কেঁদো না। তোমার কাজ তুমি কর। বিক্রি করে দিলে কী হবে, আমরা তোমাকে দিয়ে কোনো কাজ করাব না। তুমি লেখাপড়া কর। আমরা তোমাকে খুব আদর করব, ভালো স্কুলে পড়াব। ’ রহিমা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আমার মার জন্য যে মন পোড়ে। ’ ‘ঠিক আছে, তোমার যদি মায়ের জন্য অতই মন পোড়ে তোমার মাকে খবর দেব। তিনি এসে দেখে যাবেন। ’
ধানমন্ডি নিয়ে কত স্মৃতি, কত স্মৃতি দুই পরিবারের। কামালকে কখন প্রথম দেখেছি বলতে পারব না। তবে কামাল আলোচনায় আসে ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে। আগরতলা মামলার আগে থেকেই সে ছিল একজন নিবেদিত ছাত্রলীগ কর্মী। এখনকার মতো ছাত্রলীগ কর্মী ভাবলে কামালকে অসম্মান করা হবে।
আমরা যেমন নিরলস নিখাদ কর্মী ছিলাম, কামালও ছিল সেই রকম। সে সময় ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জলিল সাহেবের জন্য কেউ মিছিল করতে পারত না। একমাত্র কামালই শিরদাঁড়া সোজা করে প্রিন্সিপালের সামনে দিয়ে মিছিল বের করে আনত। এরপর ’৬৯-এর গণআন্দোলনে ঢাকা কলেজের ভূমিকা সে তো সূর্যের কাছাকাছি লটকে রাখার মতো গৌরবের। কত বড় বড় নেতা ঢাকা কলেজ থেকে বেরিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে, স্বাধীনতার পরও তাদের ভূমিকা অসাধারণ।
কামাল ছিল খুবই বিনয়ী, সংস্কৃতিমনা, অন্যের প্রতি নিবেদিত। এক ক্রীড়াবিদ এবং ক্রীড়া সংগঠক। কিন্তু এসবের কোনো মূল্যই সে পায়নি, শুধু দুর্নামই পেয়েছে। বোধহয় এমনই হয়। অনেক সময় ত্যাগী সৎ মানুষ অযথা নিন্দার শিকার হয়। আজকাল কত নেতার কত সন্তানের কত ক্ষমতা। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে হয়েও শেখ কামালের তেমন কোনো ক্ষমতা ছিল না। কোনো অফিসে যায়নি, ফোন করেনি।
এর পরও কত বদনাম। আবাহনী ক্লাব করে বদনামের ভাগী হয়েছিল। যখন যে কাজ করতে গেছে সেখানেই সুপরিকল্পিতভাবে তার নামে বদনাম করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগ আনা হয়েছিল তার নামে। কী তাজ্জব ব্যাপার! এ পর্যন্ত সাধারণ ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে কেউ টাকা নিয়েছে তেমনটাও খুব একটা শোনা যায় না আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা নেওয়া সে কি চাট্টিখানি কথা!
এখনো কাউকে সাত দিনের সময় দিয়ে ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে একটা ছিদ্রি পয়সাও নিতে পারবে না। পাঠক! ছিদ্রি পয়সা চিনবেন কিনা জানি না। আগেকার দিনে তামার ছিদ্রি পয়সা ছিল। মানে মাঝখানে গোল ফুটো। আজকাল ইংরেজির এত প্রচার-প্রসার। বাচ্চারা এখন বাংলা বলে না, তাদের মুখ দিয়ে ইংরেজির খই ফোটে। এর পরও আমরা বুঝি না, ও, Major Zia, do hereby declare the independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman! এতে কী করে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষক হন।
সবকিছু যে বঙ্গবন্ধুর জন্য বা তার নামে হয়েছে এটা বুঝতে চায় না। ঠিক তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট ভাঙার কোনো উপায় ছিল না। তা সবাই জানে। কিন্তু বদনাম করার জন্য, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য ওইভাবে কামালকে নিন্দিত করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর এখনকার মতো ছিলাম না। তখন লোকজন চিনত। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাই অস্তিত্ব ছিল। নেতানেত্রী-মন্ত্রীদের কিছু বললে তারা শুনতেন। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার ছয়-সাত জন ছাত্র এসেছিল। তাদের বৃত্তি চাই। বড় মুখ করে গিয়েছিলাম তখনকার শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীর কাছে। তিনি বলেছিলেন, ‘ভায়া! আমাদের আর কিছু করার নেই। সব কোটা শেষ হয়ে গেছে। এখন যা করার তোমার নেতা করতে পারেন। ’
সেখান থেকেই গিয়েছিলাম গণভবনে। ঘটনা খুলে বললে অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ডেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বছর ঘোরেনি, আমার এক কথায় কাদের অস্ত্র দিয়ে দিয়েছে। ও বিদেশিদের জন্য কয়েকটা স্কলারশিপ চেয়েছে। এটা না করা যায়? আল্লাহ নারাজ হবেন না? ওর কোনো কথা না করবেন না। দরকার হলে কোটা বাড়িয়ে বৃত্তি দিয়ে দিন। ’ বুকটা আনন্দে ভরে গিয়েছিল। সেদিনের সেই মর্যাদার কথা ভুলতে পারি না। তাই এখনো এর-ওর কাছে এটা-ওটা নিয়ে যাই। কেউ কেউ সে রকমই করে, আবার কেউ অবহেলাও করে।
শেখ কামাল হঠাৎ একদিন বাবর রোডে হাজির, ‘ভাই! একটা কাজ করে দিতে হবে। ’ কী কাজ? ‘না, তেমন কিছু না। আপনি ছাড়া হবে না। তাই আপনার কাছে এলাম। ’ কী বিপদ! বঙ্গবন্ধু ভাই, শেখ কামালও ভাই। যদিও পরে সম্পর্কের দ্বন্দ্ব অনেকটাই দূর হয়ে গিয়েছিল। ’৭৩-৭৪ এর পরে কখনো বঙ্গবন্ধুকে ভাই বলে ডাকিনি, চিন্তাও করিনি, প্রয়োজনও পড়েনি। স্বাধীনতার পর কামালকে প্রথম পেয়েছিলাম কলকাতার বসুশ্রী সিনেমা হলে। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি গড়ের মাঠে বিজয় মেলার আয়োজন করেছিল।
সেখানে ঢাকা থেকে আবদুল কদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব, শিল্পী আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ আরও অনেকেই গিয়েছিলেন। সে দলে কামালও ছিল। আমরা মেঘালয়, আসাম ঘুরে কলকাতা গিয়েছিলাম। উপমহাদেশের বিখ্যাত মরমি পল্লীগীতি গায়ক আবদুল আলীম ছিলেন আমার সঙ্গে। গীতিকার-সুরকার লোকমান হোসেন ফকির, উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী গোলাম ফারুক আরও অনেকে। বসুশ্রী হলে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়, যুবনেতা প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী, সুব্রত মুখার্জি, সোমেন মিত্র, সৌগত রায়সহ আরও অনেকে।
শেখ কামাল যখন বলছিল, ‘শুধু আপনার পক্ষেই সম্ভব। ’ আমি অবাক হয়েছিলাম শুধু প্রধানমন্ত্রীই নয়, জাতির পিতার বড় ছেলের কোনো কাজের জন্য আমার কাছে আসা। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী কাজ? ‘সোহরাব আঙ্কেলকে বলে দিতে হবে। ’ সোহরাব আঙ্কেল তখন পূর্ত ও ত্রাণমন্ত্রী। কী বলতে হবে? ‘না, তেমন কিছু না। মোহাম্মদপুরের পরিত্যক্ত ছোট্ট একটা প্রেস তার পরিচিত একজনকে বরাদ্দ দিতে হবে। ’ পরে জানলাম, ৩০ হাজার টাকায় আমার সুপারিশে পাঁচ-ছয় দিন আগে সেই প্রেস একজনকে বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমার সুপারিশে দেওয়া হয়েছে বলে কামাল বলার পরও সোহরাব ভাই এগোতে চাননি। মাগুরার সোহরাব হোসেন বড় ভালো মানুষ ছিলেন। মাগুরা বলতে সোহরাব ভাই আর আসাদ ভাই। এখন ভাইয়েরা নেই, এখন সব ভাতিজার কারবার। তারা কেউ চেনে, কেউ চেনে না। কামাল কিছু বললে না করা যায়?
আর না করার কোনো দরকারও ছিল না। পরদিন গিয়েছিলাম সোহরাব ভাইয়ের অফিসে। কাগজ তৈরিই ছিল শুধু আমার সম্মতি। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরাদ্দের কাগজ কামালের হাতে দিয়েছিলেন। ওই সময় বর্তমানের মস্ত ধনী সালমান এফ রহমানকে কামালের সঙ্গে সব সময় দেখতাম। আমার বাড়িতেও কয়েকবার এসেছেন। কী বিচিত্র ব্যাপার! সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে সব কেমন বদলে যায়।
আমার ছোট্ট বোন শুশু ইডেনে পড়ত। মাঝে মাঝেই কলেজ থেকে ফিরে মাকে বলত, ‘মা! শেখ কামালকে দেখলাম। কিন্তু আগে সালাম দিতে পারলাম না। ’ এ কথা অনেকবার অনেকের কাছে শুনেছি। কামালকে অনেকেই সালাম দিতে পারেনি। সে সব সময় আগে সালাম দিত। এটা তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। এত বিনয়ী একটা মানুষ কিনা নিন্দা নিয়ে এ পৃথিবী ত্যাগ করেছে। ১৫ আগস্ট তাকে যারা হত্যা করেছে তারা বড় নির্মমভাবে তার ওপর গুলি চালিয়েছে। বেহালায় সুর ফুটানো ছিল যার স্বভাব সে কেন এমন বেসুরা চলে গেল— আজও তার উত্তর খুঁজে পাই না।
অনেক দিন থেকে বিকল্প একটা জোটের কথা হচ্ছে। রাজনীতির ভারসাম্যের জন্য সেটা অবশ্যই দরকার। সেখানে কমবেশি আমার দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নামও আসে। কয়েক মাস আগে ড. কামাল হোসেন দেড়-দুই ঘণ্টা কথা বলেছেন। তারপর পতাকা উত্তোলক জনাব আ স ম আবদুর রবের ঘরে বিনা অনুমতিতে পুলিশ গিয়ে সভা শুরুর আগেই সংক্ষিপ্ত করার কথা বলায় প্রতিবাদে চলে এসেছিলাম। সেদিন আবার সাবেক রাষ্ট্রপতি দুলাভাই এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাড়িতে আলোচনা হয়েছে।
টাঙ্গাইলে ছিলাম বলে যেতে পারিনি। ঢাকায় থাকলে যেতাম। গেলে জি এম কাদেরের উপস্থিতি নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন তুলতাম। ইফতার পার্টিতে জি এম কাদেরকে দাওয়াত, জাতীয় পার্টিকে দাওয়াত সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগ ঠিক না, বিএনপি ঠিক না, মানুষের কাছে বিকল্প ঠিকানা তুলে ধরতে সরকারের একটি অংশ জাতীয় পার্টির গোলাম কাদের ঠিক, তাকে নিয়ে আলোচনা আমার কাছে কোনো নৈতিক ব্যাপার মনে হয় না।
বরং আমার মনে হয়, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার লোকজন নিয়ে মোশতাক যেভাবে সরকার গঠন করেছিল অনেকটা সে রকম। বঙ্গবন্ধুর সরকার খারাপ হলে তার সরকারে যারা ছিলেন তারাও সবাই খারাপ হওয়ার কথা। কিন্তু না। সবাই ভালো শুধু বঙ্গবন্ধু খারাপ এ কী করে হয়? জাতীয় পার্টির এরশাদ খারাপ, জি এম কাদের ভালো এতে আমার মন সায় দেয় না।
এ সরকার খারাপ হলে সরকারের সঙ্গে যারা আছে সবাই খারাপ। সরকারি দলের কাউকে আলাদা করে বিবেচনা করা যায় না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে অনেক লেখা লিখেছি। আমার মনে হয়েছে এই উপমহাদেশে কোনো স্বৈরাচার গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে এরশাদের অবস্থায় আসতে পারেনি। আইয়ুব-ইয়াহিয়া-জিয়া কেউ ক্ষমতা ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি বা ভোটে জয়লাভ করেননি।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই একমাত্র ব্যতিক্রম। তিনি কাপুরুষের মতো জেলের ভয় না পেলে আবার রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান হতেন— কারও পক্ষে ঠেকানো সম্ভব ছিল না। মানুষ দুই হাত বাড়িয়ে এরশাদকে বুকে তুলে নিতে আকুল হয়েছিল। কিন্তু এরশাদ সাড়া দেননি।
তিনি ভারত থেকে ফিরে বলেছেন, ‘আমাদের সরকার গঠনে ভারতের সমর্থন থাকবে। ’ ভারতের দালাল এ দেশের মানুষ মেনে নেবে? হাস্যকর! অনেকের মনে থাকার কথা ’৯০-এ এরশাদ যখন পদত্যাগ করেন সে সময় জনাব মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, ‘পদত্যাগের আগে আমাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের আলোচনা করা উচিত ছিল। ’ জবাবে এরশাদ বলেছিলেন, ‘পদত্যাগ করার ওই একটি কাজই কারও সঙ্গে আলোচনা করে বা অনুমতি নিয়ে করতে বা নিতে হয় না। নিজের বিবেক, বিবেচনা এবং মেরুদণ্ডের ওপর ভর করে করতে হয়। ’
বড় খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, বোধ-বিবেচনা-আত্মমর্যাদা সবই ভদ্রলোকের আছে। কিন্তু সেদিন দেখলাম সেই এরশাদই বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলে পদত্যাগ করব। ’ মানে তিনি যে বিশেষ দূত সেই পদত্যাগ করবেন। কী তামাশা! আমরা বিকল্প চাই দেশের জন্য দেশের কল্যাণের জন্য, শেখ হাসিনা ভালো না, অন্যজন ভালো এ কারণে নয় এবং সে কাজে ন্যায়নীতি থাকতে হবে। আমি জানি অন্যায় করে কোনো দিন ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
আগস্ট বাঙালি জাতির জন্য এক ভয়াবহ শোকের মাস। তবে তা ১৫ আগস্টের আগে নয়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট শুক্রবার সুবহে সাদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ঘাতকের হাতে সপরিবারে নিহত হন। ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি সফল করার প্রত্যয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুপ্রেমী লাখো আবালবৃদ্ধবনিতা-বীর মুক্তিযোদ্ধা সবাই ছিলাম উদ্বেল-মাতোয়ারা।
তখন আমাদের কারও মধ্যে শোকের লেশমাত্র ছিল না। কিন্তু ইদানীং পয়লা আগস্ট শোকের শুরু ১৫-এর পর সব শেষ, তারপর হাসি-তামাশা। কেমন যেন সবাই উল্টো রথের যাত্রী। অমন ভুল বা অন্যায় আমিও করেছি ৮-৯ আগস্ট থেকে টুঙ্গিপাড়ায় সপ্তাহব্যাপী শোক পালন করে। ১৬ তারিখ যখন টুঙ্গিপাড়া থেকে চলে আসতাম তখন বুকটা হু হু করত। পরে খেয়াল করেছি, আমরা তো ১৫ তারিখের আগে কাঙ্গাল ছিলাম না, কাঙ্গাল হয়েছি ১৫ আগস্ট।
এবার মনটা বিক্ষোভে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আছে। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। ৩২-এ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এক পাশে ছোট বোন রেহানা, অন্য পাশে বেগম মতিয়া চৌধুরীকে দেখে সারা দেহে জ্বালা ধরে গেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মালা দেওয়া বা শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় মতিয়া চৌধুরীর সেখানে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। ভদ্র মহিলাকে দয়াময় চোখ-মুখ-দাঁত খিঁচিয়ে বক্তৃতা করার দুর্লভ ক্ষমতা দিয়েছিলেন।
আজ বিএনপির বিরুদ্ধে বৃদ্ধ বয়সে চোখ-মুখ খিঁচিয়ে যখন বক্তৃতা করেন আওয়ামী ঘরানার অনেকের হয়তো ভালো লাগে। কিন্তু এই মহিলাই যখন তার যৌবনে এর চেয়ে অনেক বেশি হাত-পা ছুড়ে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে উচ্চারণের অযোগ্য ভাষায় বক্তৃতা করতেন, চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতেন, পায়ের জুতো বানাতেন, ফেরাউন-সীমার-চেঙ্গিস খাঁ বলতেন তখন আমাদের সহ্য হতো না। গত দেড়-দুই বছর জাতীয় আর্কাইভ ও অন্য পাঠাগারগুলো থেকে, দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে মতিয়া চৌধুরীর যতটা বক্তব্য পেয়েছি সংগ্রহ করেছি। একজন সাধারণ রাজনৈতিক নেতার দৈনিক পত্রিকায় কতটুকুই-বা থাকে। আর সে সময় আজকের মতো এত বড় ছিলেন না।
এর পরও তার যেসব কথাবার্তা পত্রিকায় দেখলাম খোঁজখবর না নিলে আমিও অন্ধকারেই থেকে যেতাম। জীবিত নেতাকে তিনি আর কী বলেছেন, মৃত বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন তার চেয়ে শতগুণ। তাই আর যাই হোক, মতিয়া চৌধুরী যখন বোনের পাশে দাঁড়ান বা থাকেন তখন ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়।
ইসলামের সব থেকে মর্মন্তুদ ঘটনা কারবালা। ফোরাতের পাড়ে কারবালায় মুয়াবিয়াপুত্র ইয়াজিদ ইমাম হোসাইনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। সীমার ইমাম হোসাইনের মাথা কেটে বর্শার ডগায় লটকে বাগদাদের পথে ছুটেছিল বিরাট পুরস্কার পাওয়ার আশায়। অন্যদিকে বিবি মায়মুনার ষড়যন্ত্রে বিবি জায়েদা ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিল। সেই জায়েদারূপী কাউকে যখন বোনদের পাশে দেখি, তখন বড় শঙ্কিত হই।
আমরা কোথায় চলেছি, আমাদের শেষ কোথায়? বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন তখন যেমন একটা গুমোট চলছিল, কেন যেন তেমন দেখছি। তাই বড় ভয় হয়। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বিমানমন্ত্রী। একসময় তার গাড়ি থেকে আমার রক্তের দামে কেনা পতাকা নামিয়ে ফেলতে চেয়েছিলাম। রাশেদ খান মেনন মুক্তিযুদ্ধ করেননি, মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থনও করেননি। তিনি চৈনিক।
একবার কলকাতা গিয়ে ফিরে এসেছিলেন। চৈনিক হলে যা করতে হয় তাই করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হিটলার-মুসোলিনি বলে গালাগাল করেছেন। কেন কীভাবে তারা পুরস্কার পেলেন বুঝতে পারলে সান্ত্বনা পেতাম। কিন্তু না বুঝে বড় অশান্তিতে আছি। এখন যারা সুবিধায় তাদের কেউ কেউ নিহত হওয়ার পরপর বঙ্গবন্ধুকে নমরুদ-ফেরাউন বলেছেন। জনাব হাসানুল হক ইনু বিএনপির নেত্রীকে গালাগাল করেন তাই মনে হয় আওয়ামী লীগের কাছে খুব প্রিয়।
অমন গালাগাল বঙ্গবন্ধুকেও করতেন। ভবিষ্যতে আমার বোনকেও যে করবেন না, তার গ্যারান্টি কোথায়? তাই যত অস্বস্তি। হানাদারদের হাতে মুক্তিযুদ্ধে যত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে, যত আওয়ামী লীগার নিহত হয়েছে তার দশ গুণ হাসানুল হক ইনুর গণবাহিনীর হাতে জীবন দিয়েছে। গণবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ড কর্নেল তাহের বঙ্গবন্ধুর লাশ কী করে কবর দেওয়া হলো, কেন বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া হলো না তার জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
অথচ আজ তার ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবাই আওয়ামী লীগ! হাসানুল হক ইনু একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। আছি কোথায়, কোথায় যাচ্ছি? শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আগে ছিলেন কমিউনিস্ট। ১০ দুয়ার ঘুরে গণফোরামের মাথা চিবিয়ে এখন হয়েছেন আওয়ামী লীগ। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছেন।
তার আশপাশে পিএ, সিএ, এপিএদের কেলেঙ্কারির কথা শুনে কানে তুলো দিতে ইচ্ছা করে। তিনি ভিডিও কনফারেন্স করে জিজ্ঞাসা করেন, কেউ ঘুষ-টুস নেয় নাকি। শিক্ষা অফিস ঘুষ ছাড়া চলে? সবাই হাঁ করে থাকে। কত প্রবীণ শিক্ষক-প্রফেসর-প্রিন্সিপাল শিক্ষা দফতর অথবা ডিজিতে গিয়ে কী যে নাজেহাল হন বলে শেষ করা যাবে না। জনাব নাহিদের জন্য বঙ্গবন্ধু-পাগল শেখ আবদুল ওয়াহিদকে কোরবানি দেওয়া হয়েছে। শোকে-দুঃখে অভিমানে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এত তাড়াতাড়ি তার মরার কথা ছিল না।
কেন যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর অনুরক্ত-ভক্তদের এভাবে কোরবানি দেন তার কোনো মানে খুঁজে পাই না। শোকের মাসে কত কথা মনে পড়ে। জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। কত স্বপ্ন ছিল দেশ ও দেশের মানুষের খেদমত করব। তেমন কিছুই হলো না। যেসব অত্যাচার লাঞ্ছনা-বঞ্চনার কারণে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম তার অনেক কিছুই বিদ্যমান।
বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি করে বিদ্যমান। কোনো ন্যায়বিচার নেই, মানুষের মর্যাদা নেই। ক্ষমতাবানরা এত বেশি অসহিষ্ণু যা কল্পনাও করা যায় না। বৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী কখনো-সখনো এমন বাজে কথা বলেন, যা ভাবতেও খারাপ লাগে। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে ‘আমরা চাকরি দিই, আমাদের ওপর পোদ্দারি। যতবার কোর্ট বাতিল করবে, আমরা ততবার পাস করব। ’ এটা কোনো সংসদীয় কথা? আজ গরিষ্ঠতা আছে তাই এত দম্ভ।
গরিষ্ঠতা না থাকলে কী হবে? এটা কোনো রুচিবান মানুষের কথা? উচ্চপদে বসে এত নীচু কথা; যা বলার মতো নয়। বিচারব্যবস্থা নিয়ে এত বেশি বাড়াবাড়ি ভালো না। সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘ওসব তার ব্যক্তিগত। ’ বাঃ, বাজে কথা হলে ব্যক্তিগত, বাকি সব সরকারি। দেশটা কেমন যেন ভাবলেশহীন বসবাসের অযোগ্য হতে চলেছে। যেখানে সেখানে মস্তানি। বগুড়ায় মতিন আর ঝড় তুফান। চকলেটের লোভ দেখিয়ে পাঁচ বছরের শিশু ধর্ষণ। কোথায় গিয়ে দাঁড়াব, কার কাছে বিচার দেব?
লেখক: রাজনীতিক