শেষ ইচ্ছার ব্যাপারে রহস্য রাখেননি দাদা ভাই
সালমা বেগম :
মাথায় ধবল চুল। মুখে লম্বা দাড়ি। ছবিটা আগের মতোই আছে। চার দশকে বাংলাদেশের রাজনীতির মানচিত্রে বদল হয়েছে অনেক। বন্ধু শত্রু হয়েছেন। শত্রু হয়েছেন বন্ধু। কিন্তু একটি চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনি সেই আগের মতোই আছেন। সিরাজুল আলম খান। রাজনীতির রহস্য-পুরুষ। ‘দাদাভাই’ নামেই যার পরিচয়। হয়তো রহস্য তিনি ভালোবাসেন। যে কারণে আজও কুয়াশার চাদরে ঢেকে রেখেছেন নিজেকে। তবে একটি ব্যাপারে রহস্য রাখেননি তিনি। কাছের মানুষের কাছে বলেছেন, নিজের জীবনের শেষ ইচ্ছার কথা।
২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮। মানবজমিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে লেখা হয়- ‘রাজনীতিতে তিনি এক রহস্যময় মানুষ। স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তার রয়েছে বিরাট অবদান। স্বাধীন বাংলাদেশে তার ভূমিকা দলের ভেতরে ও বাইরে বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দেয়। বলা হয়, দেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে তিনি কলকাঠি নাড়েন। ’৬৫ সালের পর তিনি আর কখনোই মঞ্চে উঠে বক্তৃতা করেননি। সর্বদা তার মুখে কুলুপ আঁটা। পত্রিকায় বিবৃতি-সাক্ষাৎকারও দেন না। তার নিজের চোখে দেখা কোনো রাজনৈতিক ঘটনা বা ব্যক্তিকে নিয়ে কোনো কথা বলেন না। কোনো দল সম্পর্কেও প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য নেই তার। এমনকি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথাও স্বীকার করেন না। এ কারণেই তাকে ঘিরে কুয়াশার বেড়াজাল। এই জালের বাইরে তিনি আসতে চান না। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কুমার। দিনের বেলা ভাত খান না। মুড়ি খান পিয়াজ-মরিচ মিশিয়ে। ঘুম থেকে উঠেন বেলা আড়াইটায়-তিনটায়। একঘণ্টা ব্যায়াম করেন। তারপর স্নান। মুড়ি-চা খেয়ে পত্রিকা পড়েন। রেকর্ড আছে, একনাগাড়ে ৬/৭ দিন তিনি মুড়ি খেয়ে, না ঘুমিয়ে কাটাতে পারেন।’
১৯ বছর পর এসে সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যাচ্ছে, তার জীবনে এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। আবার বহু কিছু বদলায়নি। যেমন এখনো তিনি আগের মতোই নীরব। সভা-সেমিনারে বক্তব্য রাখেন না। বিবৃতি-সাক্ষাৎকারও দেন না। মন্তব্য করেন না কোনো বিষয়েই। এখন রয়েছেন ঢাকাতেই। যদিও বছরে তিন-চার মাস দেশের বাইরে থাকেন। বর্তমানে ভুগছেন নানা রকম শারীরিক জটিলতায়। আগে দুইবার বাইপাস সার্জারি হয়েছে। এছাড়া স্পাইনাল কর্ডে সমস্যা এবং বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন উপসর্গে ভুগছেন তিনি। নিজেই নিজের দেখাশুনা করেন। ঘর-সংসার নেই, বাড়ি নেই। কলাবাগানে ভাড়া বাড়িতে একাই থাকেন। নিজের ব্যক্তিগত কোনো সম্পত্তি নেই। ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন এবং কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী মাঝেমধ্যে ওনার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। নিজের জীবনকে একটা রুটিনের মধ্যে বেঁধে রেখেছেন সিরাজুল আলম খান। আগের মতোই রাত জাগেন আর দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটান। তবে আগের মতো সেই টানা না খেয়ে অথবা মুড়ি খেয়ে কাটানো জীবন আর নেই। মাঝেমধ্যে রাত আটটা/নয়টার দিকে হাঁটতে বের হন।
সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই আড্ডায় মাতেন তার ঘনিষ্ঠজন, লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তার লেখা- ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শীর্ষক বইয়ে বারবার এসেছে সিরাজুল আলম খানের কথা। তো আড্ডায় আলাপচারিতায় সিরাজুল আলম খান কী রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, রাজনীতি নিয়ে মাঝেমধ্যে এখনো কথা হয়। তবে ওই ভাবে আলোচনা হয় না। উনার কাছ থেকে অনেক তথ্য নিয়েছি বই লেখার সময়। তবে কিছু কিছু প্রশ্ন আছে যেটা করলে উনি বলেন, এটার উত্তর দিলে আমাকে মেরে ফেলবে। ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকেই সিরাজুল আলম খান জাসদ থেকে সরে গিয়েছেন। বর্তমান রাজনীতি নিয়ে সিরাজুল আলম খান নিজের মতো করেই চিন্তা করেন। তবে ’৮০ সালের পর থেকেই একটা কথা বলেন, দেশে সামাজিক শক্তিগুলোকে স্পেস দিতে হবে। উনার ফর্মুলা হলো একটা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট থাকতে হবে। আপার হাউজে যদি শক্তিগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকে তাহলে তারা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। আর ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সারা দেশকে কয়েকটি স্টেটে ভাগ করতে হবে।
মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় সিরাজুল আলম খান প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ করার সময় প্রথম পরিচয় হয় সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে। আমরা সমবয়সী কিংবা বন্ধু ছিলাম না। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা হয়। কিছু কিছু লোককে ভালো লেগে যায়। আর সেভাবেই সিরাজুল আলমের প্রতি আমার ভালোলাগা বেড়ে যায়। তিনি ছিলেন বোহেমিয়ান ক্যারেক্টারের। বাড়িঘর নেই। এখানে সেখানে থাকতেন। হয়তো তিন/চার দিন না খেয়ে একসঙ্গে পাঁচ দিনের খাবার খেলেন। সিরাজুল আলম ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। ছয় দফা আন্দোলনের সময় যখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বেশিরভাগ নেতা জেলে ঐ সময় সংগঠনকে চালিয়ে নিয়েছেন সিরাজুল আলম খান। সেখানে তার অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে দুটি কথা বলবো। প্রথমত আমার তরুণ বয়সে উনার মাধ্যমে অনেক প্রভাবিত হয়েছি। আর যেটা বলবো, একটা সময় বিশেষ করে ’৬৯ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত এই সময়টায় উনি রাজনীতির একজন বড় অনুঘটক ছিলেন। এখন উনি কাজটা ভালো করেছেন না খারাপ করেছেন, ব্যর্থ হয়েছেন না সফল হয়েছেন সেটা ইতিহাস বিবেচনা করবে। উনি একটা ঝাঁকুনি দিতে পেরেছিলেন। তবে উনি সত্যিকার অর্থে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন নি। তারুণ্যের শক্তিকে উনি উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন। তাদেরকে একধরনের স্বপ্নও দেখাতে পেরেছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো রূপক অর্থ ছিল না। এবং এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি গড়ে ওঠার দরকার ছিল সেটাও হয়নি। আমি এটাতে উনাকে দায়ী করবো না। সিরাজুল আলমের একটা বিষয় ভালো লেগেছে সেটা উনি বলেছেন। উনার কথা আমার ভালো লেগেছে তাই আমি সেটাকে সমর্থন করেছি। উনি কাউকে জোর করেন নি এবং বাধ্যও করেন নি। আসলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা হচ্ছে, ’৭৫ সালের পর জাসদ কোমায় চলে গেছে। আর ৭ই নভেম্বরের পর জাসদ মারা গেছে।
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, গত মাসে আমি আর সুমন মাহমুদ যখন সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে দেখা করেছি উনি উনার শেষ ইচ্ছার কথা জানালেন। উনার জন্মস্থানে বেগমগঞ্জে মায়ের কবরের পাশে যেন উনাকে দাফন করা হয়। উনার কথা মনে হলে ফকির আলমগীরের ওই গানটার কথা মনে পড়ে, ‘ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম না’।
সিরাজুল আলম খানের জন্ম নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে, ১৯৪১ সালের ৬ই জানুয়ারি। তার বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন, গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। স্থানীয় স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করে চলে যান বাবার কর্মস্থল খুলনায়। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তারপর ঢাকা কলেজ থেকে ’৫৮ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। থাকতেন ফজলুল হক হলে। গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় ‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করার কারণে। প্রতিদিন রাত করে হলে ফিরতেন। ফলে হল থেকেও একবার বহিষ্কৃত হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় তার পক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়া সম্ভব হয়নি। কনভোকেশন মুভমেন্টের কারণে ’৬৩ সালের শেষদিকে গ্রেপ্তার হন। ’৭৬ সালে জিয়ার আমলে আবার গ্রেপ্তার এবং ’৭৯ সালে মুক্তি পান। ’৯২ সালে বিদেশ যাবার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ২৪শে মার্চ সিরাজুল আলম খানকে গ্রেপ্তার করা হলে ৪ মাস পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান।
’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় স্কুলের ছাত্র থাকাকালে তিনি প্রথম মিছিলে যান। পরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ’৬১ সালে ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদক হন। ’৬৩ সালে সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে বাঙালিদের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ’৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে নিউক্লিয়াস গড়ে উঠে তিনিই ছিলেন তার মূল উদ্যোক্তা। এই নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। তারপর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল আলম খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসলে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেয়। ফলে তার সিদ্ধান্ত ও তৎপরতায় গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল জাসদ।