শোকাবহ আগস্টের তাত্পর্য
আগস্ট মাস আসার সঙ্গে-সঙ্গেই বলতে গেলে এই মাসের প্রথম দিনটি থেকেই আমরা নতুন করে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ি। এমন একটি দুর্ঘটনার জন্য আমি নিশ্চয়ই প্রস্তুত ছিলাম না। তবু ঘটনাটি যখন ঘটেই গেল সেই ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের ভোরে বেতারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর শুনে বঙ্গবাসী একেবারে বিমূঢ় ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তবু তারা আশা করেছিল যে, বঙ্গবন্ধু সরকারের যারা সদস্য, কিংবা বঙ্গবন্ধুর পরম বিশ্বাসে ও আশ্বাসে সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা দায়িত্বে নিযুক্ত যারা, তারা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ পরিশোধ করার জন্য বেরিয়ে আসবে এবং দেশবাসীকেও এ কাজে শামিল করার জন্য ডাক দেবে, কিন্তু হায়, সেদিন সন্ধ্যা বেলাতেই টেলিভিশনের পর্দায় দেশবাসী দেখল বঙ্গবন্ধুর ঘাতকের কাছে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা আনুগত্যে শপথ নিচ্ছেন। এ দৃশ্য সবাইকে চরম হতাশায় নিমজ্জিত করল, কারো কাছে প্রত্যাশা করার মতো কিছুই আর রইল না। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর যারাই মোস্তাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন কিংবা নানাভাবে অবৈধ ঘাতক সরকারকে সহযোগিতা করতে বাধ্য হয়েছিলেন যারা, তাদের সবাইকে দেশবাসী অপরাধী সাব্যস্ত করেননি। আকস্মিক পরিস্থিতি যে তাদের একান্তই অসহায় করে দিয়েছিল—এ কথা অনুভব করার মতো সংবেদনশীলতা দেশবাসীর নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তারপরও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ নেতৃত্বের উপর ক্ষুব্ধ ও অভিমানে আহত হওয়াও তো জনগণের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। জনগণের সেই ক্ষোভ ও অভিমান দূর করার দায়িত্ব তো সেই নেতৃত্বেরই। ব্যর্থ হওয়া বা ভুল করা দোষের নয়, কিন্তু ব্যর্থতা ও ভুল স্বীকার না করাই মারাত্মক অপরাধ। আমাদের নেতৃত্ব সেই মারাত্মক অপরাধে অপরাধী—এমন কথা যদি জনগণ বলে, তবে তারা কি খুব ভুল বলবে? নেতৃত্বের কি উচিত ছিল না প্রথম সুযোগেই জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ও অক্ষমতার জন্য মাফ চাওয়া?
অজস্র ক্লিব, মতলববাজ ও ডিগবাজি বিশারদ নেতারও নাম উল্লেখ করা যায়। কিন্তু তা করতে গেলে ঠগ বাজতে গাঁ উজাড় হবে। নেতাদের ক্ষেত্রে যাই হোক সত্, নিষ্ঠ ও স্বদেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কর্মীর সংখ্যা নিশ্চয়ই অনেক; কিন্তু সেই কর্মী-জনতারা তো সেদিন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। গরিষ্ঠসংখ্যক নেতা সেদিন দিশা দেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন বলেই মৃত্যুঞ্জয়ী চীরঞ্জীব বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সর্বব্যাপী শূন্যতাই প্রকট হয়ে উঠেছিল। অথচ যতদিন বাংলার সব নদী প্রবহমান থাকবে ততদিনই বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন বলে মনীষী অন্নদা শংকর রায় একান্তভাবে যে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন সেই প্রত্যাশা তো মিথ্যা নয় নিশ্চয়ই। তবে এখানেও কিন্তু কথা আছে। মনে রাখা উচিত, বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে দিতে পারবে না নিশ্চয়ই। তবে ইতিহাস বিকৃতিকারকরা আগামী দিনেও তার নিন্দার নামে কলংক আরোপ করতে ছাড়বে না। ইতিহাস বিকৃতির সেই কলংক থেকে আমাদের মুক্ত থাকতেই হবে। শোককে শক্তিতে পরিণত করার কথা আমরা প্রায়শই বলে থাকি বটে, কিন্তু সেই শক্তি অর্জনে আমরা যথাযথভাবে প্রবৃত্ত হই না। এখন অবশ্যই সেরকম প্রবৃত্ত হতে হবে।