ঢাকা: উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে সংবিধানে আনীত ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানি মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের মত অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে প্রথম দিনের ন্যায় দ্বিতীয় দিনের শুনানির শুরুতে এবং শেষে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে আপিল বিভাগের তুমুল বাক্যবিনিময় হয়েছে। আপিল বিভাগের সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলের বাক-বিতণ্ডার কিছু বিষয় ব্রেকিংনিউজের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো। সকালে এ মামলার আপিল শুনানির শুরুতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি জাতীয় সংসদের হাতে নাকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকা উচিত তা নির্ধারণ হওয়া দরকার।’ তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনিতো আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত আছেন। এ বিষয়টি শুনানির জন্য তো সময় আছে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এ মামলার সঙ্গে বিচারকদের শৃঙ্খলার বিষয়টি জড়িত। এক্ষেত্রে কোনও শূণ্যতা থাকতে পারে না।’

এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপিল বিভাগে এখন বিচারপতির সংখ্যা ৭ জন। কিন্তু এ মামলা শুনছেন আপনারা ৫ জন। এভাবে বিচার চললে আমি অনাস্থা দিতে বাধ্য হবো। আপনারা বলেছেন যে শুনানিতে সব বিচারপতিই উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু আজকের শুনানিতে সেটি হয়নি। ৭ জনকে শুনতে বলায় ভুল কোথায়?’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি আদালতকে খাটো করে (আন্ডার মাইন্ড) দেখছেন।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তা করছি না। আমাদের আবেদন, হাইকোর্টের রায়ে কিছু সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কিছু মন্তব্য করা হয়েছে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বৈরি কিছু থাকলে সেটা আমরা দেখবো।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রায়ে অনেক কথা আছে।’

বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া তখন বলেন, ‘এখনওতো মামলা শুনলামই না।’

অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি শুনানি বিলম্ব করছেন।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমাদের আরেকটি আবেদন আছে। পৃথিবীর কোনও দেশের বিচার বিভাগ (হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে) এভাবে কথা বলতে পারে না। আমি অসহায়। এভাবে শুনানি অব্যাহত রাখলে ন্যায়বিচার হবে না। শুনানিতে অংশ নিতে আমাকে বাধ্য করবেন না।’

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি আদালতকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন যে আপনি নিজেই বিপদে পড়বেন।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? গতকাল বলেছেন যে সবাই শুনবেন। কিন্তু তাতো দেখছি না। আমরাতো আদালতকে সহযোগিতা করতে চাই।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায় উপস্থাপন করতে সমস্যা কোথায়? আপনি লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করুন।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনি বলেছিলেন যে, শুনানি ৭ বিচারপতিই শুনবেন। কিন্তু এখন তা শুনছেন না। আমিতো বলেছি, মে মাসেই শুনানি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে হলেতো আমি এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবো।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি পিড়াপিড়ি (ইনসিস্ট) করছেন কেন?’

এরপরও প্রধান বিচারপতি রায় উপস্থাপন করতে বললে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রায় উপস্থাপন করবো। তবে আমাকে সময় দিতে হবে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা আগে বলেছিলাম লিখিত যুক্তিতর্ক প্রস্তুত করে তা দাখিল করতে। আপনার দফতরে ১৫৫ জন আইন কর্মকর্তা আছেন। অতএব এটা প্রস্তুত করতে এতো সময় লাগবে কেন?’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছি। এই সময় দিলে আকাশ ভেঙে পড়বে না। আশা করছি এ সময়ের মধ্যে উনারা (বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) ফিরে আসবেন।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি হাইকোর্টে শুনানি করেছেন। আপনার সব মনে থাকার কথা।’

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচাপতি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, ‘আপনি আদালতের প্রধান আইন কর্মকর্তা। তাই মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলা ঠিক হয়নি।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি নিরুপায় হয়ে বলেছি। আপনারা যখন ৫ জন শুনবেন বলেছেন তখন এটা বলেছি।’

এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা পেপারবুক থেকে হাইকোর্টের রায় পড়া শুরু করেন। পরে দীর্ঘ সময় মুরাদ রেজা তার বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করেন।

এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান উপস্থিত ছিলেন। আজ ড. কামাল হোসেন, এমআই ফারুকী আছেন ‘

এ পর্যায়ে ড. কামাল হোসেন দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করেছি।’

এসময় ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ড. আবদুল ওয়াদুদ ভুইয়া অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে লিখিত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আশা করি বাকী যারা আছেন তারাও দাখিল করবেন।’

এরপর প্রধান বিচারপতি আগামী ১৪ মে রবিবার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করলে আপত্তি জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনারা ন্যায়বিচারের স্বার্থে অপরাপর সকল মামলায় সকল পক্ষের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। এ মামলায় সেটা করছেন না কেন? দুই সপ্তাহ সময় দেওয়ার আবেদন করছি।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখানে বিচারকদের শৃঙ্খলার বিষয়টি জড়িত। সুপ্রিম কোর্ট এই সংবিধানের অভিবাবক। আমাদেরকে একদিকে যেতে হবে।’

এরপর আদালত আগামী ২১ মে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত শুনানি মূলতবি করলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘করজোড়ে বলছি, সবাইকে নিয়ে শুনানি করুন।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে শুনতে হবে এমন শর্ত দেওয়া যায় না। একজন বিচারপতি অসুস্থ থাকতে পারেন। একজন বিদেশে থাকতে পারেন। একজনতো জুলাইয়ে অবসরে যাবেন। কেউ জুলাই পর্যন্ত অসুস্থ থাকতে পারেন। সব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই প্রধান বিচারপতিকে আদালত চালাতে হয়।’

এ সময় প্রধান বিচারপতি হাস্যরসাত্মক কণ্ঠে বলেন, ‘দ্বিধাবিভক্ত রায় হলে কি আপনি খুশি হবেন?’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমার খুশি অখুশি হওয়ার কিছু নাই। আমি নীরবই থাকবো।

তখন প্রধান বিচারপতি হাসতে হাসতে বলেন, ‘আপনি অনেক চালাক।’

সবশেষ এ মামলার যু্ক্তিতর্ক উপাস্থাপনের জন্য আগামী ২১ মে দিন ধার্য করে মামলার কার্যক্রম আজকের (মঙ্গলবার) জন্য সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এ সময় আপিল বিভাগের বিশাল কোর্টরুমে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, সাংবাদিক ও আগ্রহী দর্শনার্থীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn