সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল হতে পারে না। জাতীয় সংসদ ছাড়া এটা কার্যকর হওয়ার সুযোগ নেই। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের অনেকেই এমন মত দিয়েছেন। বৈঠকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন কয়েকজন মন্ত্রী। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তাঁরা বলেন, ওই পর্যবেক্ষণের অনেক বিষয় ‘অপ্রাসঙ্গিক ও আপত্তিকর’।

আদালত বিচার্য বিষয়ের বাইরে গেছেন—এমন মত দিয়ে তাঁরা বলেন, এসবের পেছনে কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে এসব কথা জানান। একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি ওই রায়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরতে মন্ত্রীদের পরামর্শ দেন।

সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনির্ধারিতভাবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে এক ঘণ্টারও বেশ সময় ধরে আলোচনা হয়। এতে অন্তত ১৫ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী অংশ নেন। বৈঠকে উপস্থিত আরেকজন মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রায়ের ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বিষয়গুলো বাদ দেওয়ার (এক্সপাঞ্জ) জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার আপিল বিভাগ এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। রায় অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরছে বলে আইনজ্ঞদের অনেকই মত দিচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এত দিনেও বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

বর্তমান সরকারের সময়ে বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে দিতে সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল। এই রায়ের পর্যবেক্ষণ ও বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, গণতন্ত্র, জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। এ নিয়ে সরকারে অস্বস্তি তৈরি হয়। গতকাল সরকারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আগামী বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিক্রিয়া জানাবেন। আইন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগ এ কথা জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় আরও জানায়, আইনমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ে এ বিষয়ে কথা বলবেন।

মন্ত্রিসভায় উপস্থিত একাধিক মন্ত্রী বলেন, গতকাল মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক শেষে অনির্ধারিত আলোচনায় প্রথমে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের কিছু বিষয় পড়ে শোনান। এরপরই এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেন, যদি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও সংসদ অপরিপক্ব (ইমম্যাচিউরড) হয় তাহলে এই সংসদের নির্বাচন করা রাষ্ট্রপতি কি প্রশ্নবিদ্ধ? আর যদি রাষ্ট্রপতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকেন তাহলে তাঁর নিয়োগ করা প্রধান বিচারপতি কি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকবেন?

আলোচনায় অংশ নেওয়া একাধিক মন্ত্রী বলেন, উচ্চ আদালত সিভিল সংসদের আইন মানছেন না। কিন্তু সামরিক শাসনের করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে ফিরে যেতে চাইছেন। ক্ষুব্ধ মন্ত্রীরা বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে কোনোভাবেই তাঁরা খর্ব হতে দেবেন না।

একাধিক মন্ত্রী বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন ‘শক্তি বা ফোর্স’ সক্রিয় আছে। রায়ের পর্যবেক্ষণের অনেক বিষয় এসব শক্তির জন্য ক্ষেত্র তৈরি করছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। এ ছাড়া সরকার সম্পর্কে কিছু আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে বলে তাঁরা মত দেন। মন্ত্রীদের কেউ কেউ মনে করছেন, রায় ও পর্যবেক্ষণে বেশ কিছু ত্রুটি রয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে কোনো কোনো মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অন্য মন্ত্রীদেরও রায় পড়ে রায়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরার পরামর্শ দেওয়া হয়।

মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য বলেন, তাঁরাও এ নিয়ে কথা বলবেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এসব বিষয় তুলে ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, পাকিস্তানকে অনুসরণ করে ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসনের সময় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করা হয়েছিল। পরে অনেক গণতান্ত্রিক দেশকে অনুসরণ করে ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হয়েছিল। সেটাকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছেন, যা দুঃখজনক। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের চেয়ে ৯৬ অনুচ্ছেদ বিচারকদের বেশি সুরক্ষা দেবে। এখানে বেশি ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।’

সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় আপিল বিভাগে বহাল রাখার রায় হয় গত ৩ জুলাই। ওই দিনও মন্ত্রিসভায় রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আলোচনা হয়েছিল। এরপর ৯ জুলাই জাতীয় সংসদেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছিল। রায় প্রকাশের এক মাস পর গত মঙ্গলবার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এখন আবার এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn