সকলের তরে সকলে আমরা–হাসান হামিদ
হাসান হামিদ-
‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/এ জীবন মন সকলই দাও/তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?/আপনার কথা ভুলিয়া যাও।/আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/ আসে নাই কেহ অবনী পরে/সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ –
কবি কামিনী রায়ের এ লাইনগুলো মনের অজান্তে কয়েকবার আওড়েছি আজ। আসলে বর্তমানে হাওর এলাকায় আমরা যে যতোটা পারি, সহযোগিতার হাত বাড়ানো দরকার। যতই বলা হোক সরকারি সহায়তা পর্যাপ্ত; বাস্তবে তা নয়। সরকারি বরাদ্দ ঠিকঠাক সবখানে যাচ্ছে না, সাধারণ মানুষ সবটা পাচ্ছে না, এটাই সত্যি। এখানে ত্রাণের অপ্রতুলতাও দায়ী। তবে মানবিক এ বিপর্যয়ে সরকারের পাশাপাশি সামর্থবানদের উচিত পাশে দাঁড়ানো।
আমার মনে হয়, হাওর এলাকার দুর্গত মানুষের পাশে এখন দাঁড়াতে হবে পুরো দেশের মানুষকে। বেসরকারি সংস্থাগুলোরও জরুরি ভিত্তিতে হাওর এলাকায় ত্রাণ কাজ পরিচালনা করা দরকার। দুর্গত এলাকায় উপযুক্ত পরিমাণে খাদ্য, জলপরিশোধনকারী ট্যাবলেট, পেটের পীড়ারোধের ওষুধ, খাবার স্যালাইন জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো দরকার। পাশাপাশি গবাদি পশুর খাদ্যের ব্যবস্থা করা দরকার। সরকার আর অন্যরা যতই বলুক, সব ঠিক আছে। আমি জানি, তা নেই। কারণ আমার গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ তবে বাড়ি ছাড়া হতো না। হাওরপাড়ের যে গ্রামে আমি বড় হয়েছি, সে গ্রামের মানুষ সহজে বাড়ি ছাড়ে না। শেষ বিন্দু পর্যন্ত আঁকড়ে থাকে এরা। এর আগে অনেক দুর্যোগে কেউ গ্রাম ছাড়েনি। কেউ না।
অপ্রতুল হলেও সরকার অর্থ ও খাদ্যশস্য বিতরণ শুরু করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ কিন্তু সরকারের সামনে রয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে, এসব ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ভার সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের হাতে পড়ে যেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বঞ্চিত না হয়। তাছাড়া এবার হাওর অঞ্চলে ত্রাণ কার্যক্রম অনেক দিন চালাতে হবে। কিন্তু সামনেই বর্ষাকাল। বর্ষায় হাওর অঞ্চলের মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে অকাল বন্যার কারণ সীমান্ত নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাস আর মেঘালয়ে অসময়ে অতিবৃষ্টি। এর পাশাপাশি সীমান্ত নদীর উৎসে রয়েছে ৫টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এই দুর্যোগে এসব বাঁধ কোন প্রভাব ফেলেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। তাছড়া নদীর নাব্যতা আগের মত নেই। তাই সামান্যতেই উপচে পানি ঢুকে পড়ে হাওরে। এবার অসময়ের অতিবৃষ্টি নদীগুলোর ওপর চাপ বাড়িয়েছে। হাওরের পাশের নদীগুলো খনন করে সুষ্ঠ পানি ব্যবস্থাপনা করা গেলে এ ধরনের দুর্যোগ অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব। আসল কথা হলো, পানি ধারণ করার ক্ষমতা বাড়াতে হাওরের নদ-নদী খনন করতে হবে। নদ-নদী, খাল-বিলের গভীরতা বৃদ্ধির বিষয়ে শুধু পরিকল্পনা নিলেই চলবে না, বাস্তবায়নে কঠোরতা অবলম্বন দরকার। ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরগুলোর গভীরতা বৃদ্ধির দায়িত্ব দিতে হবে পুকুরের মালিকদের। আর খাল-বিল, নদী-নালার গভীরতা বৃদ্ধির দায়িত্ব হবে সংশ্লিষ্ট দফতরের। এর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ড্রেজার সংগ্রহ দরকার হবে।
আবার, শুধু নদী ড্রেজিং করলেই সমস্যা সমাধান হবে না; দেশের খাল-বিলগুলো খননের কাজটি জরুরি। কারণ দেশে পানি আসে পানি যায়- এই গতানুগতিক ধারার পরিবর্তন দরকার। দেশের স্বার্থে খাল-বিল, নদী-নালার সার্ফেস ওয়াটারকে পরিকল্পিত ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া দরকার। তৈরি করতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী স্লুইস গেট, রাবার ডেম। আরো যে কাজটি করা প্রয়োজন তাহলো নদীর বাঁক কেটে সোজা করা। এতে পানির প্রবাহে বাধা হ্রাস পাবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমবে, নদীতে পানি থাকবে। তবেই দেশে মৎস্য সম্পদ বাড়বে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, জীব-জন্তুর মহামারীর প্রকোপ কমবে।
হাওরের কৃষক বাঁচাতে এখন সরকারি পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী কৃষিঋণ আর বীজধান বিতরণ দরকার। দরকার স্থানীয় মহাজনদের হাত থেকে দরিদ্রমানুষকে বাঁচানো। এনজিওগুলোরও এখন বাধ্যতামূলকভাবে ঋণ মওকুফ করতে হবে। আর যেসব দুর্নীতিবাজের কারণে আর ফাঁকিবাজের অবহেলায় হাওরবাসীর এই সীমাহীন দুর্ভোগ তাদের কথা ভুলে গেলেও চলবে না। দরকার এদের গাফিলতি ও দুর্নীতির কড়া শাস্তি। আর পুরো এলাকার পানিশোধনের ব্যবস্থা করা দরকার।
হাওর থেকে আসে এদেশের মাছের বাজারের একটা বড় অংশ। সেখানে মাছের বংশ তো ধ্বংস হয়ে গেছে। নতুন করে মাছ চাষ শুরু করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে জরুরিভিত্তিতে। দরকার সবক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে, সাংগঠনিক পর্যায়ে। ব্যক্তিগত ভোগবিলাস কিছুটা কমিয়ে আসুন আমরা সকলে ত্রাণ নিয়ে হাওরবাসীর পাশে দাঁড়াই; কেননা আগে হাওরের দুর্গত মানুষদের বাঁচাতে হবে। বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগে সবচেয়ে যেটা জরুরি সেটি হলো জাতীয় ঐক্য। এই জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে সকল দেশপ্রেমিক মানুষ এক হয়ে দাঁড়াতে হবে দুর্গত হাওরবাসীর পাশে।
এই দুর্যোগে শিশুদের পড়ালেখা যেন বন্ধ না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আমরা জেনেছি, হাওরপাড়ের বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় হাওর এলাকায় এবার ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর হার বাড়তে পারে। কৃষকের ঘরে খাবার নেই, সেই সঙ্গে রয়েছে তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ নিয়ে চিন্তা। এবার জেলার মাধ্যমিক ও উপরের শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পুরো বছরের বেতন মওকুফ করা দরকার। সেই সঙ্গে সবাইকে উপবৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। না হলে খাবারের অভাবে এসব শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা তাদের অন্যকাজে লাগিয়ে দেবে। যেটা খুব সাধারণ বিষয়।
কৃষক জাতির মেরুদণ্ড। কৃষক বাঁচলে দেশ বাচবে। যদিও কৃষকের কল্যাণে অনেক কথা শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কতটা হয় তা তো বিদ্যমান পরিস্থিতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। হাওরবাসীর প্রত্যাশা, সরকার দ্রুত এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে কান্না থামানোর জন্য আরো কার্যকর উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে। যে কোনো দুর্যোগেই মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়, আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে অগণিত মানুষ। আর অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসা একটি মহৎ কাজ। যে কোনো দুর্যোগ মুহূর্তে প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী সাহায্যের হাত প্রসারিত করা। মানুষ মানুষের জন্য- এই নীতি প্রয়োগের উৎকৃষ্ট সময় এখন। মানুষ মানুষের জন্যে। জীবন জীবনের জন্যে। একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু!
(লেখক- গবেষক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কর্মকর্তা)