সতীর্থ শেখ কামাল ও কিছু স্মৃতি
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক
ঢাকা কলেজে দেড়–দুইমাস ক্লাস করার পর কোন এক ছুটিতে আমি চট্টগ্রাম আসি। চট্টগ্রামে অবস্থান কালে প্রতিবারের মতো একদিন আমি ১২০ আন্দরকিল্লা আওয়ামী লীগ অফিসে যাই। আর সেখানে আমার সাথে মরহুম এম এ আজিজের সাথে দেখা হয়। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন কারণ তার সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমার কুশলাদি জানতে চাইলে আমি তাঁকে বলি ঢাকা কলেজ থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা। শুনে তিনি আমাকে ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে যেতে নিষেধ করেন। আমাকে উৎসাহিত করেন ঢাকা কলেজে ফিরে যেতে।
তিনি বললেন, ঢাকা কলেজে মুজিব ভাইয়ের ছেলে কামাল পড়ে, আমি একটি চিঠি লিখে দিচ্ছি তুমি এটা কামালকে দিও। ‘ সম্ভবত: এমএ আজিজ সাহেব কামালকে লিখলেন, ঢাকায় আমাদের একজন ভালো কর্মী যাচ্ছে, তুমি তাকে কাজে লাগাও। যা হোক ঢাকায় ফিরে এলাম এবং মনস্থির করলাম যে , ঢাকা কলেজেই পড়ব। প্রথম থেকেই অনুভব করলাম তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের উত্তাপ।
বিশেষ করে ৬ দফা আন্দোলনের ঢেউ ততদিনে পূর্ববাংলার টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত আছড়ে পড়েছে। আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের সাথে ছাত্র –জনতা একীভূত হয়ে গেছে। নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি আমাদের বাঁচার দাবী ৬ দফার আন্দোলনের ছোঁয়ায় আমি উজ্জ্বীবিত হই। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান এবং একই সাথে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা কলেজের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। যাই হোক, আমি কলেজে এসে শেখ কামালের সাথে দেখা করলাম। এম এ আজিজের চিঠিটা তাঁর হাতে দিলাম।
চিঠি পড়ে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাকেই আমাদের প্রয়োজন। ধীরে ধীরে শেখ কামালের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। জননেতা এম এ আজিজের চিঠি এবং সাংগঠনিক পরিচিতি সব মিলিয়ে শেখ কামালের সাথে আমার সম্পর্ক নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়ে ওঠে।
ছাত্রলীগের সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা, শেখ কামালের সাথে বন্ধুত্ব ও তার সাথে ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে দুপুরের খাবার খাওয়া, ক্লাস ছুটির পর বলাকা সিনেমা হলে ম্যাটিনী শো দেখতে যাওয়া, বলাকা ভবনে বানচিং চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট ও ঢাকা কলেজের সামনে চিটাগাং রেষ্টুরেন্টে খাওয়া, গল্প করা সহ নানা স্মৃতি আজো মনের কোণে ভীড় জমায়।
একদিন শেখ কামালের সাথে কলেজের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে আসন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) পদে প্রার্থী হতে বলেন শেখ কামাল। আমি দ্বিমত প্রকাশ করে বলি, এই পদে অন্য কাউকে প্রার্থী করলে ভাল হয়। আমি বরং সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করি কারণ রাজনীতিতে এই বিষয়টিই জরুরী। অমনি করিৎকর্মা কামাল পাল্টা প্রস্তাব করে বলেন, তাহলে তুমি ছাত্রলীগের কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নাও। ছাত্রলীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। আমি এতেও সম্মতি না জানিয়ে বলি, দায়িত্বটা তোমার হাতেই রা। কিন্তু সে বলল, আমি শেখ মুজিবের পোলা, আমিতো রয়েছিই। তুমিই ছাত্রলীগের কলেজ শাখার দায়িত্ব গ্রহণ কর। তারপর আর কোন কথা চলে না। আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ঢাকা কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার (১৯৬৭-৬৮) গ্রহণ করি। নির্বাচনের আগে শেখ কামালের সাথে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করি। ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে শেখ কামাল সহ আমরা কয়েকজন সংগঠক দিনরাত পরিশ্রম করতে থাকি। তারই ফলশ্রুতিতে, ১৯৬৬-৬৭ সালের মত ১৯৬৭ সালের ২৭ শে নভেম্বর অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ বিপুল ভোটাধিক্যে বিজয় লাভ করে।
ডায়েরীর পাতা থেকে সংগৃহীত:
২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ সাল শুক্রবার! কলেজ বন্ধ। তবুও সকালে বের হই। কামালের সাথে দেখা করতে গেলাম তাদের বাসায়। কিন্তু তার সাথে দেখা হল না। দেখা না পেয়ে মুক্তার ভাইয়ের বাসায় যাই। অনেক্ষণ আলাপ হল। তাকে বললাম ছাত্রলীগ ঢাকা কলেজ শাখার সাহিত্য সম্পাদক হবার জন্য। কিন্তু তিনি নিতে চাইলেন না। আমি তাকে অনুরোধ করলাম। আমাকে একখানা চিঠি দেন, চিঠি বললে ভুল হবে। বলি , কবিতা পত্র। পড়ে দেখলাম বেশ ভালই লিখেছে। সত্যই মুক্তার ভাইয়ের যথেষ্ট প্রতিভা আছে। চর্চা আর অনুশীলন করলে একদিন বেশ সুনাম অর্জন করতে পারবে।
৩রা ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮, পুজা উপলক্ষে কলেজ বন্ধ। কামালের বাসায় যাই। সেখানে আমাদের কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কর্মকর্তা ঠিক করলাম। কামাল আমাকে সাধারণ সম্পাদক হবার জন্য অনুরোধ করলো। কামাল কেমন ছেলে আমি বুঝলাম না। ইচ্ছা করলে সে সাধারণ সম্পাদক হতে পারতো। অথচ তা না করে আমাকেই দেবার প্রস্তাব করে বসলো তার উদার চেতনার জন্য সত্যিই শ্রদ্ধা হয়। কামালের বাসা থেকে কলেজ হোস্টেলে আসি। সেখান হতে আমরা দু‘জনেই পাকিস্তান কাউন্সিলে আসি। দুজন দুখানা ভর্তি ফরম্ নিলাম। তারপর মতিঝিল যাই। সেখান হতে আমি বাসায় চলে যাই। আজ ছাত্রলীগ ঢাকা কলেজ শাখার সম্মেলন ছিল। কিন্তু কলেজ বন্ধ থাকায় আর সম্ভব হল না। কিন্তু কর্মী সভায় ২১ ফেব্রুয়ারির স্মরনীকা প্রকাশের জন্য একটি কমিঠি গঠন করা হয়। মুক্তার আহম্মদকে সম্পাদক করে। রমনায় যাই….।
আজ শেখ কামালের ৬৮ তম জন্ম দিন।