সহসা মুক্তি মিলছে না খালেদা জিয়ার
আরাফাত মুন্না :: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে। এ মামলায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে চার মাসের জামিন পেলেও তার কারামুক্তিতে অন্তত আরও ছয় মামলায় জামিন নিতে হবে। এরই মধ্যে পাঁচ মামলায় হাই কোর্টে জামিনের আবেদন করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। তবে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরু হওয়ার আগে এসব আবেদন নিষ্পত্তি করে বিএনপি চেয়ারপারসনের কারামুক্তি অনিশ্চিত বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। তারা বলেন, এসব মামলায় হাই কোর্টে আদেশ যা-ই আসুক, চূড়ান্ত সুরাহার জন্য আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়াতে পারে। বলা চলে মামলার জালেই আটকে আছে খালেদা জিয়ার কারামুক্তি। এদিকে খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য হাই কোর্টে দাখিল করা পাঁচটি আবেদনের মধ্যে দুই দিনে কুমিল্লার একটি নাশকতার মামলায় আংশিক শুনানি শেষ হয়েছে। আজ আবার এই আবেদনের ওপর শুনানি হওয়ার কথা। এরপর নড়াইলের মানহানি মামলায় খালেদার জামিন আবেদনের শুনানি শুরু হতে পারে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা জানান, কুমিল্লায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা মামলায়ও জামিনের আবেদন করা হয়েছে হাই কোর্টে। আজ হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের কার্যতালিকায় এই আবেদনটিও রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রী করে জাতির মানহানি এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে জন্মদিন পালনের দুই মামলায় করা জামিন আবেদনের ওপর আগামী সোমবার হাই কোর্টে শুনানি হওয়ার কথা। সূত্র জানায়, আগামী ১ থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে রমজান ও পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটি থাকবে। অবকাশ শুরু হওয়ার আগে আর মাত্র ছয় কার্যদিবস নিয়মিত বিচারিক কার্য পরিচালনা হবে উচ্চ আদালতে।
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ৩৭টি মামলা। এর মধ্যে পাঁচটি দুর্নীতির এবং তিনটি মানহানির অভিযোগে করা মামলা। আর বাকি ২৯টি মামলা ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে বিভিন্ন সময়ে করা। ৩৭টি মামলার মধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১২টির কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত রয়েছে। আর তিনটি মামলা তদন্তাধীন। বাকি ২২টি মামলার বিচার চলছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ কে এম এহসানুর রহমান বলেন, বিচারাধীন ২২টি মামলার মধ্যে কুমিল্লায় নাশকতা ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের দুই মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আর কুমিল্লায় বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় কোনো আদেশ দেয়নি আদালত। এটি এখনো বিচারিক আদালতেই শুনানির জন্য ধার্য আছে। এ ছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে নড়াইলের মানহানি মামলায়ও। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার ঢাকার দুই মানহানির মামলায় খালেদা জিয়াকে জামিন না দিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল করার আদেশ দিয়েছে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত। ৫ জুলাইয়ের মধ্যে এ আদেশ কার্যকর করে আদালতকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হাজিরা পরোয়ানা জারি আছে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি মামলায়।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আপিল বিভাগ থেকে জামিন পেলেও আরও কয়েকটি মামলায় শ্যোন অ্যারেস্টের কারণে মুক্তি পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, সরকার তাকে (খালেদা জিয়া) কারাগার থেকে বের হতে দেবে না। একের পর এক মামলা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া হলেও তার বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় তিনি এখনই মুক্তি পাচ্ছেন না। মামলার নথি না দেখে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয় বলে জানান আইনমন্ত্রী। এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, কোনো আসামির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলে, যে কোনো একটি মামলায় কারাগারে গেলেও মুক্তি পেতে হলে অন্য মামলাগুলোতেও জামিন নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘যতটুকু শুনেছি, খালেদা জিয়াকে দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আরও তিনটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।’ তাই বিএনপি চেয়ারপারসনের কারামুক্তির জন্য এসব মামলায় অবশ্যই জামিন নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি। সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, এসব মামলায় হাই কোর্টে রায় যা-ই আসুক, সংক্ষুব্ধ পক্ষ নিশ্চয়ই আপিল বিভাগে যাবে। সে ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সুরাহা আপিল বিভাগেই হবে। চলতি বছর ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালত। এরপর হাই কোর্ট খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দিলেও আপিল বিভাগে গিয়ে আটকে গিয়েছিল সেই জামিন। পরে দুই পক্ষের আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বুধবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে হাই কোর্টের দেওয়া জামিন বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া ও দুদকের করা আপিল ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
পোকামাকড়ের কামড়ে অসুস্থ খালেদা জিয়া : বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, কারাগারে বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হয়েছে। জরাজীর্ণ ভবন দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকলে যা হয় এখন সেই রকমই বসবাসের অযোগ্য ও নানা অসুখ-বিসুখ আক্রমণের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে তার কারাগারের স্যাঁতসেঁতে কক্ষটি। অসংখ্য পোকামাকড়ে ভরা কক্ষটিতে বাস করা যেন নরকবাস। পোকামাকড়ের কামড়ে তিনি আরও বেশি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা এবং বামহাতটা অবিরাম ব্যথার কারণে শক্ত হয়ে ওঠেছে। দুই পায়ে ক্রমাগত ব্যথা হচ্ছে এবং সেগুলো ভারী হয়ে যাচ্ছে ও ফুলে ওঠছে। মাত্র কিছুদিন আগে চোখে অস্ত্রোপচার হওয়ার কারণে দুই চোখই সারাক্ষণ জ্বালাপোড়া করতে থাকে। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মলনে তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূইয়া, কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, সেলিমুজ্জামান সেলিম, তাইফুল ইসলাম টিপু, মুনির হোসেন, বেলাল আহমেদ, অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, তাঁতী দলের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে চারদিকে গভীর সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রকৃত বড় বড় মাদক ডিলারদের অন্তরালে রেখে সন্দেহভাজনদের হত্যা করা হচ্ছে কোন উদ্দেশ্যে? বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ করছেন। রিজভী আহমেদ আরও বলেন, বিচারবহির্ভূতভাবে নির্বিচারে বন্দুকযুদ্ধে মানুষ হত্যা করে পৃথিবীর কোথাও সামাজিক অপরাধ দমন করা যায়নি। তাছাড়া যতবড় অপরাধীই হোক তাকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার কোনো সুযোগ নেই। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সম্পর্কে রিজভী আহমেদ আরও বলেন, গত ৯ দিনে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৪৩ জন। নিহত ব্যক্তিদের মাদক ব্যবসায়ী বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিনি বলেন, রাষ্ট্র যদি নানা অপরাধের পৃষ্ঠপোষক হয়, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের যদি বৈধসত্তা না থাকে, তাহলে তাদের দ্বারা সৃষ্ট বে-আইনি কর্মকাণ্ড বিভত্স্যরূপে আত্মপ্রকাশ করবেই। সারা দেশে এই মাদকব্যবসা গড়ে উঠেছে সরকারি দলের প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায়। তাদেরকে আড়ালে রেখে এই বিচারবর্হিভূত হত্যার যাত্রাপথে ক্রমাগতভাবে সরকারবিরোধী লোকজনদের নির্মূলে ব্যস্ত থাকার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে তারা দেশকে রক্তাক্ত নির্বাচনের দিকে নিয়ে যায় কিনা সেটি নিয়েও এখন মানুষ ভাবছে। -বাংলাদেশ প্রতিদিনের সৌজন্যে