সামাদ আজাদের লুঙ্গিপরা আওয়ামী লীগঃ সুজাত মনসুর
মুশতাকের মন্ত্রী হব না।
আব্দুস সামাদ আজাদের সাথে পরিচয় সেই সত্তর দশকের শুরুতে, যা অটুট ছিল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। মধ্যখানে ছাত্রলীগ ছেড়ে আমি ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করলেও তিনি কখনো তার ব্যাখ্যা চাননি কিংবা রাগ করে দুরে ঠেলে দেননি। তিনি জানতেন কেন আমি সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ছেড়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলাম। এই কয়েক যুগের রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি। আমি দেখেছি দেশ-জাতি-দলের নেতাকর্মীদের প্রতি তাঁর দরদ-ভালবাসা। তাঁর সম্পর্কে লিখতে গেলেই অজস্র স্মৃতি এসে এমনভাবে ভর করে খেই হারিয়ে ফেলি। একটা লিখতে গিয়ে আরেকটা চলে আসে। সারাজীবন অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মীর তালিকায় ছিলাম। দিরাই-সুনামগঞ্জ-সিলেট এমনকি কেন্দ্রীয় রাজনীতির অনেক ঘটনারই স্বাক্ষী হয়ে আছি, হয়তো একদিন সময় ও সুযোগ পেলে লিখে যেতে পারব। সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে নব্বুই দশকের শুরু পর্যন্ত তো বলতেই পারব। পঁচাত্তর পুর্ব সময়ও এখনও ঝলঝল করে জ্বলে মনের মনিকোঠায়।
সামাদ আজাদকে অনেকেই বিভিন্নভাবে মুল্যায়িত করার চেষ্টা করেন। কেউ তাঁকে রাজনৈতিক জ্যোতিষি বলে থাকেন। সমালোচকরা বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করেন। কেউ বা বলেন তিনি ছিলেন অত্যন্ত রাশভারি লোক। তাঁকে নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত আছে। কিন্তু আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন মানবিক মানব। যেমনি ছিলেন রাশভারি, তেমনি ছিলেন অত্যন্ত আড্ডাবাজ, রসিক মানুষ। ছিলেন অত্যন্ত ভোজনরসিক। উনার সাথে এক টেবিলে বসে খাবার অনেক অভিজ্ঞতা আমার আছে। তিনি যখন খেতে বসতেন তখন টেবিল ভর্তি খাবার সাজানো থাকত। তবে প্রতিদিনই কোন কোন ভরতা, বিশেষ করে শুটকির ভরতা থাকত টেবিলে। ঢাকায় গেলে যেহেতু উনার বাসায় অবস্থান করতাম, তাই কখনোই আমাকে রেখে দুপুরে হউক অথবা রাতে হউক খাবার খেতেন না। উনার স্ত্রী, নানীজ্বী(সামাদ আজাদ সম্পর্কে আমার নানা ছিলেন), যাকে তিনি সব সময় বেগম সাব বলে সম্মোধন করতেন, আমাদের সাথে খেতেন না কিন্তু টেবিলের মধ্যখানে বসতে হত। সামাদ সাহেবের নির্দিষ্ট বসার চেয়ার ছিল এক প্রান্তে আর আমি বসতাম অন্য প্রান্তে। খা্বার টেবিলের সবচেয়ে মজার ঘটনা ছিল, তিনি জানেন টেবিলে কি কি তরকারি আছে। তবুও নানীজ্বীকে জিজ্ঞেস করতেন, বেগম সাব, ঐ যে বাটিটা, ওটা কিসের তরকারি? আমি উনার এ ধরনের ছেলেমানুষি দেখে এমনভাবে হাসতাম, তিনি যেন টের না পান। মাঝে মাঝে আমাকে প্রশ্ন করতেন, সুজাত বলতো তোর নানির রান্না কেমন হয়েছে?
তিনি যে অত্যন্ত আড্ডাবাজ ছিলেন তা টের পেতাম, দিরাই-সুনামগঞ্জ কিংবা সিলেট সফরে আসলে, শেষরাতে। দিরাই-সুনামগঞ্জ কিংবা সিলেটে উনার অনেক ভক্ত ছিলেন যাদের অনেকেই কোন কমিটিতে পদায়িত ছিলেন না। তবে তারা রাজনীতি, বিশেষ করে ভোটের রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতেন। তারাই ছিলেন মূলতঃ সামাদ আজাদের আসল শক্তির উৎস। তাদের অধিকাংশই মঞ্চে স্থান পেতেন না কিংবা মঞ্চে বসার জন্য ঠেলাঠেলি করতেন না। শেষ জীবনে এসে যে সব দুর্বত্তরা সামাদ আজাদের আশে-পাশে আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবার সুযোগ পেয়েছিল, তারা উনার প্রকৃত সুহৃদ ছিল না। তবে এদেরকে প্রশ্রয় না দিয়েও উপায় ছিল না। কেননা, ইতোমধ্যেই তাঁর প্রকৃত সুহৃদদের অনেকেই পরলোক গমন করেছেন অথবা বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় বিছানায় আশ্রয় নিয়েছেন।
এই যে বললাম সামাদ আজাদের আড্ডা গ্রুপের সদস্যদের কথা, তাদের অনেকে লুঙ্গিপরেই চলাফেরা করতেন। কখনো প্যান্ট বা পাজামা পরতে দেখিনি। যদিও কেউ কখনো কখনো পাজামা পরতেন কিন্তু প্যান্ট পরতে দেখিনি। দিরাই আসলে উনি মূলতঃ দিরাই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব আব্দুল কুদ্দুস স্যারের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিওসি কিংবা ডাকবাংলোতে আড্ডা বসত। সেখানে যারা উপস্থিত থাকতেন তাঁদের মধ্যে যাদের নাম এখন মনে আছে তারা হলেন ক্ষিতিশ চন্দ্র নাগ, চাঁনপুরের মফিজ ভাই, চন্ডিপুরের হাশিম মামা, আব্দুর রউফ মিয়া, জগদলের মাহতা্বুর রহমান, সাকিতপুরের ওয়াকিব মিয়া প্রমুখ। সুনামগঞ্জে যারা ছিলেন তারা হলেন, আব্দুল বারি চাচা, জয়কলসের জালু মিয়া, পশ্চিমবাজারের আফাজ চাচা, আছদ্দর আলী মোক্তার, দেলওয়ার চাচা আরো অনেকে। সুনামগঞ্জ আমাদের সাংগঠনিক জেলা হলেও আমাদের যোগাযোগটা সিলেটের সাথেই বেশি ছিল বরাবর। যদিও আমি ৭৯ সালে সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক হয়েছিলাম দিরাই স্কুলে অধ্যয়নকালীন সময়ে। পঁচাত্তরের পরে আব্দুস সামাদ আজাদ যখন দিরাই-শাল্লার পরিবর্তে জগন্নাথপুরকে তাঁর সংসদীয় আসন হিসেবে বেছে নেন, তখন অনেকেই উনাকে দিরাই-শাল্লায় নির্বাচন করার অনুরোধ জানান। তখন তিনি বলেছিলেন, আমাকে যে তোমরা দিরাই-শাল্লায় নির্বাচন করতে বল, আমি কিন্তু ভরসা পাই না। কেননা, আমি যাদের সাথে বুক মেলাতাম সে মানুষজনদের তো আর খুঁজে পাই না। তাঁদেরকে যদি এনে দিতে পার তাহলে আমি দিরাই-শাল্লায় নির্বাচন করতে পারব। বাস্তবচিত্র ছিল ভিন্ন।
এবার আসি সিলেটের কথায়। সিলেটের ঝেরঝেরি পাড়ার একটি বাসার তিনতলায় সামাদ সাহেবের জন্য রুম বরাদ্দ ছিল। চাবি উনার পকেটেই থাকতো। বাসাটার মালিক ছিলেন সিলেটের রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিচিতমুখ, সবার প্রিয় মনির মামা। সামাদ আজাদ সিলেট আসলে ঐ বাসায়ই থাকতেন বেশিরভাগ সময়। রাত ১টা বা ২টা পর্যন্ত চলত বিভিন্ন নেতাকর্মীদের সাথে বৈঠক। এরপর শুরু হত আসল আড্ডা। হাসি-ঠাট্টায় মশগুল আড্ডা হলেও এটা ছিল সিলেট রাজনীতির মূল আড্ডা। এই আড্ডার নিয়মিত সদস্য ছিলেন মনির মামা, টুকেরবাজারের ছমির উদ্দিন চেয়ারম্যান, ভুলাই মিয়া, কুচাইর ইসহাক মিয়া, মোগলগাও-এর নজির মিয়া, মৎসজীবি সমাজেরা নেতা জমির উদ্দিন, সিরাজ ভাই(রূপবান সিরাজ)। এঁদের অনেকেই লুঙ্গিপরে চলাফেরা করতেন, কখনো প্যান্ট পরতে দেখিনি। দিরাই-সুনামগঞ্জ কিংবা সিলেটের এইসব আড্ডায় আমাকে প্রায়ই সামাদ সাহেবের পানের বাটা হাতে বসে থাকতে হত। এটাও একটা রহস্যময় বিষয়। উনার একটা পানের বাটা ছিল। এই বাটা সহজে কারো হাতে দিতেন না। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল অনেকবার সেই পানের বাটা বহন করার।
এইসব আড্ডা অনেকের কাছে গুরুত্বহীন মনে হলেও সিলেট অঞ্চলের অনেক গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ঐ আড্ডাতেই হত। ওরাই ছিলেন সামাদ আজাদের মূলশক্তি, পরামর্শ দাতা, তথ্য সরবরাহকারী। উনাদের দেয়া তথ্য, পরামর্শ ও উপদেশ অনুযায়ীই সামাদ আজাদ অনেক গুরুত্বপুর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। জনগনের অতি কাছের এই মানুষগুলো সম্পর্কে আজকের সেলফিবাজ, মঞ্চ আর বক্তৃতাপ্রিয় নেতাকর্মীরা আদৌ অবহিত আছে কি? আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, না। আর এইসব ইতিহাস জানে না বলেই ওরা শেকড়ের টান অনুভব করে না। যেদিন শেকড়ের সাথে সম্পর্কিত এ মানুষগুলো সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে, অনুধাবন করতে পারবে এবং তাঁদের সাথে নিজেদের সেতুবন্ধন সৃষ্টি করতে পারবে সেদিনই মানবতার জয় হবে, জনতার জয় হবে। দেশ হবে কাদামাটির মানুষদের।