সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শেষ কোথায়?-কাজল ঘোষ
কাজল ঘোষ-গত ক’দিন ধরেই প্রায় প্রতিদিনই দেশ ও দেশের বাইরে থেকে ফোন আসছে। এই ফোনগুলো শারদীয় শুভেচ্ছা জানাতে নয়। উদ্বেগের। খোঁজ নেয়া হচ্ছে কোনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি কি-না? কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে যেন তাদের জানাতে ভুল না করি। তাদের বলেছি, উদ্বিগ্ন নই। এই দেশটা আমারও। যারা এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে যুক্ত তারা কোনো ধর্মের হতে পারে না। যারা মন্দিরে কোরআন রাখে আর যারা ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করে তারা একই সূত্রে গাঁথা।
কোনো ধর্মই ঠুনকো নয়।
আমি ধর্ম নিয়ে কিছু বললাম আর ধর্ম শেষ হয়ে গেল- এমনটি হতে পারে না। সমস্যাটা অন্যত্র। ধর্মের নামে লাঠি, আগুন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া অনেক সহজ। ধর্মের নামে সম্পদ লুণ্ঠন অনেক সহজ। ধর্মের নামে নির্যাতন অনেক সহজ। ধর্মকে ব্যবহার করে মহলবিশেষের এই স্বার্থসিদ্ধি কবে বন্ধ হবে? প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলছে যুগ যুগ ধরে।
বিষয়টি অদ্ভুত লাগে। অমর্যাদাকরও মনে হয়। প্রতিবার পূজা এলেই প্রতিমা ভাঙে। কিছু এলাকায় পূজামণ্ডপের চারপাশে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। খবরের কাগজে ছবি ছাপা হয় প্রতিমার ভঙ্গুর দেহের। নামকাওয়াস্তে বিবৃতি আসে বিভিন্ন সংগঠনের। সরকারের তরফে মিডিয়ায় হুঁশিয়ারি মন্ত্র উচ্চারিত হয়। তারপর বাত কি বাত। এটা যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে।
কথা হচ্ছে কারা এসব ঘটনার পেছনে? নেপথ্যে যারা কলকাঠি নাড়ছেন তাদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না কেন? প্রতিটি ঘটনার মতো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়েও চলছে দোষারোপের খেলা। সরকারের বেশির ভাগ নেতারাই দোষ চাপাচ্ছেন বিএনপি-জামায়াতের ওপর। কিন্তু তারা তো লম্বা সময় ক্ষমতার বাইরে। এই দীর্ঘ সময় দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতা তো আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের হাতেই। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপের মধ্যদিয়ে প্রকৃত ঘটনা আড়ালের চেষ্টা ছাড়া আর কি হতে পারে?
এবারের কুমিল্লার ঘটনা কারা ছড়িয়ে দিলো? পূজার মন্দিরে কোরআন পাওয়ার ঘটনায় পুলিশকে কারা ফোন দিলো? ফেসবুকে এই খবরটি রটিয়ে দেয়ার পেছনে কি উদ্দেশ্য ছিল? এই সংঘবদ্ধ চক্র কি এখনো আইনের আওতায় এসেছে? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে টানা তৃতীয়বার। তাদের এই লম্বা মেয়াদে একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামের বৌদ্ধ পল্লী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, পাবনার সাঁথিয়ায় হামলা, সুনামগঞ্জের শাল্লা, যশোরের অভয়নগর আর সবশেষ কুমিল্লার জেরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, রংপুরের পীরগঞ্জ, ফেনী, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, কমলগঞ্জসহ বেশকিছু এলাকায় হামলার খবর পাওয়া গেছে। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সরকার ত্বরিত কিছু পদক্ষেপ নেয়ায় হয়তো পরিস্থিতি ততটা নাজুক হতে পারেনি। যদি পূর্বের ঘটনাগুলোর যথাযথ তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন হতো তাহলে বোধকরি আজ এমন পরিস্থিতির জন্ম হতো না। এবারের ঘটনায় বেশকিছু এলাকায় সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের সম্পৃক্ততার খবর কাগজেই ছাপা হয়েছে। অথচ কারও বিরুদ্ধেই এখনো পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়ার তথ্য প্রকাশ হয়নি। উল্টো উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর খেলায় মগ্ন ক্ষমতাসীনরা। দোষারোপের পুরনো খেলায় লিপ্ত না হয়ে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দোষী যেই হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এখনই জরুরি। না হলে সাম্প্রদায়িক চক্রের বিষদাঁত ভাঙা যাবে না কখনই।
প্রতিবারের ন্যায় এবারো পূজার আগে বিভিন্ন বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হলো- নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে মন্দিরগুলোকে। আমরা কি দেখলাম? সরকারের নানা গোয়েন্দা সংস্থা মাঠ পর্যায়ের কি খবর রাখলো? একটি মন্দিরে কোরআন পাওয়ার খবরে এত বিস্তৃত ঘটনা সংঘটিত হলো কি করে?
সাম্প্রদায়িক হামলা আর বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়ার সবশেষ খবর এসেছে রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে। হামলা হয়েছে সেখানকার হিন্দুপল্লীতে। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ পাহারা থাকা অবস্থায় আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ সংগঠিত হয়ে কি করে হামলা চালালো? দুর্বৃত্তদের হামলা ও লুটপাটের ঘটনার যেসকল ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভেসে উঠেছে তাতে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের চেয়ে অর্থ-সম্পদ লুটই মুখ্য এটা স্পষ্ট। দুবৃত্তরা রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর গ্রাম থেকে মেয়ের বিয়ের জমানো টাকা আর গোয়ালের গরু লুট করে নিয়ে যায়। কাঁদছে জগদীশ রায়, কনিকা রানি, নন্দ রানীরা। দুর্বত্তরা ধর্মের নামে বর্বরতা চালিয়েছে, সর্বস্ব লুটে নিয়েছে। তাদের এই কান্নার শেষ কোথায়।
উৎসবের বাড়িতে উলুধ্বনির বদলে কান্না আর চিৎকারের ধ্বনি শুনতে তো এই দেশটির জন্ম হয়নি। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।