সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশিসহ অভিবাসী শ্রমিকদের বন্দিদশা, নির্মমতা
খোকন সেখানে একটি ডর্মে এক রুমে অন্য ১১ জনের সঙ্গে অবস্থান করেন। বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে তাকে বাইরে বের হতে দেয়া হয়েছিল। তারা যে রুমে থাকেন তা খালি। এতে আছে মাত্র ৬টি ধাতব বিছানা। বিছানার সামনে ঝুলিয়ে যারা হয়েছে কাপড়চোপড় ও তোয়ালে। এসব দিয়েই কেউ কেউ ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করছেন। খোকন বলেন, দিনরাত আমরা এই রুমের ভিতর। এটা আমাদের মনের ওপর প্রকৃতপক্ষে এক রকম নির্যাতন। এটা আমাদের জন্য জেলজীবন। এখানে স্থান সংকুলানের অভাবে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা যাচ্ছে না।
এরই মধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন জাকির হোসেন খোকন। সুস্থ হয়ে কাজে ফিরেছেন তিনি। কিন্তু তিনি মনে করেন, খারাপ দিনগুলো এখনও তার পিছু ধাওয়া করছে। জুনে তার ডরমেটরিকে ভাইরাসমুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু গত মাসে ওই ডর্মে নতুন করে ভাইরাসের ‘ক্লাস্টার’ দেখা দেয়। অন্য হাজার হাজার শ্রমিকের সঙ্গে তাকেও কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত কম আয়ের এসব মানুষকে বাসার ভিতরেই অবস্থান করতে হচ্ছে। অনিশ্চিত এক পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা।
যারা গড়ে তুলেছেন সিঙ্গাপুর
গত জানুয়ারির শেষের দিকে প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে সিঙ্গাপুরে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা একশত ছাড়িয়ে যায়। ব্যাপক আকারে করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালু করা হয়। দেশজুড়ে করোনা ভাইরাস বিষয়ক সচেতনতা বাড়ানো হয়। হার্ভার্ড মহামারি বিশেষজ্ঞরা সিঙ্গাপুরের ব্যবস্থাকে ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে একটি সঙ্কট গড়ে ওঠে, যা অনেক মানুষই দেখতে পান নি। সিঙ্গাপুরে অবস্থান করেন বাংলাদেশ, ভারতের মতো কম আয়ের দেশগুলোর কমপক্ষে ৩ লাখ শ্রমিক। তাদের বেশির ভাগই কাজ করেন নির্মাণ শিল্প ও কলকারখানায়। সিঙ্গাপুরে তাদের অবস্থান তাদের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের নিয়োগকারীরা থাকার ব্যবস্থা করে থাকেন। আবাসন থেকে তাদেরকে বাসে করে কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা যেসব ডর্মে অবস্থান করেন সেখানে প্রতিটি রুমে কতজন থাকতে পারবেন তার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণের কোনো আইন নেই। করোনাপূর্ববর্তী সময়ে প্রতিটি রুমে অবস্থান করতেন ২০ জন করে মানুষ। মার্চের শেষে, অভিবাসীদের অধিকার বিষয়ক গ্রুপ ট্রানসাইয়েন্ট ওয়ার্কার্স কাউন্ট টু (টিডব্লিউসি২) সতর্কতা দেয় যে, এই গ্রুপের মধ্যে নতুন করে করোনার ক্লাস্টার দেখা দেয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না।
প্রথমেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশজুড়ে যখন লকডাউন দেয়া হলো তখন জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। কিন্তু অধিকারকর্মীদের পূর্বাভাষ সত্যি হয়েছে। প্রতিদিন ডর্মের কয়েক শত করে অভিবাসী শ্রমিক নতুন করে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মধ্য এপ্রিল থেকে সরকার দুটি আলাদা তথ্য প্রকাশ করেছে। তা হলো স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংক্রমণ এবং অন্যটি হলো ডর্মে আক্রান্তের সংখ্যা। এতে দেখা যায়, অভিবাসীদের মধ্যে উচ্চ হারে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় ম্যাসি ইউনিভার্সিটির যোগাযোগ বিষয়ক প্রফেসর মোহন দত্ত বলেছেন, কোভিড-১৯ অন্য যেকোনো মহামারির মতোই। এতে সৃষ্টি হয়েছে এক অসমতা।
লকডইন
কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, এসব ডরমেটরি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া উচিত। অন্য আবাসনগুলোতে জরুরি সেবা দেয়ার জন্য প্রায় ১০ হাজার স্বাস্থ্যবান অভিবাসীকে সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগই থেকে যান ওইসব ডর্মে। তাদের অনেককে রুমের বাইরে যাওয়ার অনুমতিও দেয়া হয় নি। তাদের ওপর গণহারে পরীক্ষা করা হয়। আক্রান্ত রোগীদের সরিয়ে নিয়ে, বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসা দেয়া হয়। বাকি অংশের মানুষ যে সুবিধা ভোগ করছে, তার থেকে এটা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। অন্যরা কেনাকাটা করতে বাইরে যাচ্ছেন। প্রতিদিন তাদেরকে ব্যায়াম করতে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। সব ধরণের দোকান থেকে ডেলিভারি অফার করা হচ্ছে। কিন্তু এসব অভিবাসীকে সত্যিকার অর্থে লকডাউন করে রাখা হয়। তাদেরকে শুধু মৌলিক যে খাবার তা সরবরাহ দেয়া হয়। দক্ষিণ ভারতের বৈদ্যনাথন রাজা বিবিসিকে বলেছেন, লকডাউন দেয়ার পর আমাদেরকে রুমের বাইরে যেতে দেয়া হয় নি। এমনকি পাশের রুমের দরজার কাছেও যেতে দেয়া হয় নি। ভারতের ৫১ বছর বয়সী শ্রমিক মাহালিঙ্গাম ভার্টিসেলভান বলেছেন, তার ডর্মের সুযোগসুবিধা ভাল। সেখানে থাকার জন্য সিঙ্গেল বেড দেয়া হয়েছে। ভাল দূরত্ব রক্ষা করা হচ্ছে। আরেকজন বিদেশি অভিবাসী তার ডর্মের একই রকম চিত্র দিয়েছেন। বলেছেন, সেখানে ১৫ থেকে ৮টি বেড পাতা হয়েছে। আরেকজন শ্রমিক সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কারণ, নিয়োগকারীরা তাকে একটি হোটেলে সরিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশি শ্রমিক জাকিরের ভাগ্যে তেমনটা ঘটেনি। তিনি একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে প্রকল্প সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন। হাসপাতালে নেয়ার পর আবার তাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে ডর্মে। জাকির বলেন, ১৭ই এপ্রিল আমি ডরমেটরি ছেড়েছিলাম। আবার ৯ই জুলাই ফিরেছি। এখানে আমি কোনোই উন্নতি বা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। জাকিরের দেয়া তথ্যমতে, তার রুমের পরিমাপ ৬ মিটার বাই ৭ মিটার। এর ভিতর অবস্থান করেন তারা ১২ জন। জাকির বলেন, কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বলেছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে। কিন্তু বিষয়টি আমাদের কাছে কৌতুক ছাড়া কিছু নয়। কিভাবে এত্ত ছোট রুমের ভিতর আমরা সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করবো? জাকিরের এই ডর্মে প্রতিটি ফ্লরে আছে ১৫টি এমন রুম। এতে অবস্থান করতে হয় প্রায় ১৮০ জনকে। তাদেরকে ব্যবহার করতে হয় একই টয়লেট। ৬টি বেসিন। শাওয়ার ও পয়ঃনিষ্কাশনের অন্যান্য ব্যবস্থা। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতি ১৫টি বেডের জন্য একটি টয়লেট, একটি শাওয়ার ও একটি সিঙ্ক থাকতে হবে। বলা হয়েছে পরিষ্কার থাকতে। কিন্তু সোপ ডিসপেন্সারে কোনো সাবান নেই।
এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের মন্তব্য নেয়ার চেষ্টা করে বিবিসি। কিন্তু তারা কোনো উত্তর দেন নি। মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ ‘ইটস রেইনিং রেইনকোটস’-এর প্রতিষ্ঠাতা দীপা স্বামীনাথান বলেছেন, বহু অভিবাসী শ্রমিকের জন্য এটাই হয়ে উঠেছে দীর্ঘদিনের ব্যবস্থা। খাদ্য ও ডর্ম নিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে এখন, এটা বহু বছরের ঘটনা। এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কারণ, বিষয়গুলো অভিযোগ আকারে আসছে না। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে আরো ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে। অনেক অভিবাসী শ্রমিক হতাশায় ডুবেছেন। তাদের অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন বলে রিপোর্ট আছে। একটি ভিডিওর কথা এখানে বলা যায়। তাতে দেখা গেছে একজন শ্রমিক জানালার প্রান্তসীমায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তাকে তুলে নিচ্ছেন তার ফ্লাটমেটরা। জাকির নিজে অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য একটি দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, আমার ডরমেটরিতে অনেক মানুষকে আমি দেখেছি, তারা পরিবারের সঙ্গে কথা বলছেন। জানাচ্ছেন, তারা আর এ পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারছেন না নিজেকে। তারা শুধু কাঁদেন এবং বাড়ি ফিরে যেতে যান। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বেতন নিয়ে হতাশা। দেশে অবস্থানকারী আত্মীয়-স্বজনরা তাদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল। জাকির বলেন, কিন্তু আমরা বাড়িতে একটি পয়সাও পাঠাতে পারছি না। কারণ, আমরা তো বাইরেই যেতে পারি না। আবার অনেকের বেতনই দেয়া হয় নি। তবে মানবসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিবিসিকে বলেছেন, যেসব বিদেশি শ্রমিক পূর্ণ সময় কাজ করেন তাদের বেতন পরিশোধ করা উচিত।