সিলেটে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৭ বছরে ৭ খুন, বিচার হয়নি একটিরও
সিলেটে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীন কোন্দল যেনো কিছুতেই থামছে না। স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে বারবার নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ছে ছাত্রলীগ। ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। গত ৭ বছরে সিলেটে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন সংগঠনটির ৭ কর্মী। আহত হয়েছেন আরো অনেকে। একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটলেও এসব হত্যাকারীরা থেকে যায় আড়ালে। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় গ্রেপ্তার এড়িয়ে প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়ায় খুনিরা। আটকে থাকে হত্যা মামলার বিচারও।প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা দায়ের হলেও একটি মামলারও নেই তেমন কোনো অগ্রগতি। হত্যা মামলার আসামীরাও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেদের কর্মীকেও অস্বীকার করেছে ছাত্রলীগ। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু বিচার, দোষিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেওয়া হলেও তা কেবল আশ্বাসেই আটকে আছে। ফলে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে নিহতের পরিবার।
সর্বশেষ গত বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সিলেটের শিবগঞ্জে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে নিহত হন সুরমা গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম।এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের মা আতিয়া বেগম নিজে বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) মধ্যরাতে শাহপরান থানায় এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা টিটু চৌধুরীসহ ২২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।আসামীদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন শাহ পরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার বিকালে টিটু চৌধুরী অনুসারী কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী মাসুমের ছোটভাই খালেদকে শিবগঞ্জ লামাপাড়া এলাকায় জিম্মি করে। তারপর তারা খালেদের মাধ্যমে মাসুমকে খবর দিয়ে আনেন। মাসুম আসার পরপরই তাকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে দুর্বৃত্তরা। পরে তাকে উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গেলে বিকেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।এর আগে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ বিরোধের বলি হন ছাত্রলীগ কর্মী উদয়ন্দু সিংহ পলাশ, সুমন চন্দ্র দাশ, আব্দুল আলী, কাজি হাবিবুর রহমান, আব্দুল্লাহ কচি ও খালেদ আহমদ লিটু।
উদয়েন্দু সিংহ পলাশ: ২০১০ সালের ১২ জুলাই অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে নগরীর টিলাগড়ে খুন হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের ৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১০/১৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন পলাশের বাবা বীরেশ্বর সিংহ। এই মামলা এখন আদালতে বিচারাদিন রয়েছে বলে জানিয়েছেন শাহ পরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন।
আব্দুল্লাহ কচি: ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই সিলেট নগরীর মদিনা মার্কেট-কালিবাড়ি রোডের মদিনা মার্কেট অংশে ইজিবাইকের (টমটম) একটি নতুন স্ট্যান্ডের দখল নিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা ইমরান আহমদ ও গোলজার আহমদ গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ ওরফে কচি নিহত হয়। এ ঘটনায় কচির ভাই আসাদুল হক ভুঁইয়া বাদী হয়ে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি এখন সিআইডিতে তদন্তাধীন আছে বলে জানিয়েছেন জালালাবাদ থানার ওসি শফিকুর রহমান।
সুমন চন্দ্র দাস: ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের পার্থ-সবুজ গ্রুপের সাথে অঞ্জন-উত্তম গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী সুমন চন্দ্র দাস।এ ঘটনায় সুমনের মা প্রতিমা দাস বাদী হয়ে ছাত্রলীগের অজ্ঞাতনামা শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। এই মামলাটিও এখন সিআইডি তদন্ত করছে বলে জানিয়েছেন জালালাবাদ থানার ওসি।
আব্দুল আলী : ২০১৫ সালের ১২ আগস্ট দুপুর আড়াইটায় সিলেট মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজ দলের ক্যাডারদের ছুরিকাঘাতে খুন হন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজার থানার সিলাম তেলিপাড়া গ্রামের আকলিস মিয়া আরকানের ছেলে আব্দুল আলী (১৯)। তিনি ছাত্রলীগ বিধান সাহা গ্রুপের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ঘটনার দিন বিকেলে দক্ষিণ সুরমা থানার চন্ডিপুলস্থ ফুলকলি মিষ্টিঘর থেকে আটক করা হয় মূল ঘাতক সিলেটের ওসমানীনগর থানার দয়ামীর গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাশের ছেলে প্রণজিৎ দাশ ও সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামের বাসিন্দা হারুনুর রশিদের ছেলে আঙ্গুর মিয়া।হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রণজিত দাশ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। এই মামলাটি এখন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার ওসি গৌছুল হোসেন।
কাজী হাবিবুর রহমান : ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারী ছাত্রলীগের গ্রুপিংয়ের শিকার হন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী কাজী হাবিবুর রহমান। ঐদিন সকাল সাড়ে এগারোটায় নগরীর শামীমাবাদে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মাঠে ছাত্রলীগ নেতা হোসাইন মুহাম্মদ সাগর ও সোহেলের নেতৃত্বে একদল ছাত্রলীগকর্মী তার উপর হামলা চালায়। এসময় হাবিবকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তারা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় হাবিবের। পরে সহপাঠীরা জানান, হাবিব মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন সমর্থিত সাগরের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ থেকে আব্দুল আলিম তুষারের নেতৃত্বাধীন গ্রুপে যোগ দেওয়ার কারণেই সাগর গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মীরা তার ওপর হামলা করে। এ ঘটনায় ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারী নিহতের ভাই ১১ জনের নাম উল্লেখ করে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন। এই মামলার সকল আসামীরা জামিনে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার ওসি গৌছুল হোসেন।
খালেদ আহমদ লিটু: চলতি বছরের ১৭ জুলাই সোমবার দুপুরে সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের ১০২ নং শ্রেণী কক্ষের ভিতরে নিজেদের অবস্থানে পাইপগানের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন জেলা ছাত্রলীগের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক পাভেল গ্রুপের সমর্থিত কর্মী খালেদ আহমদ লিটু। ঐদিন বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবুল কাশেম পল্লব ও জেলা ছাত্রলীগের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক পাভেল মাহমুদ গ্রুপের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে শ্রেণিকক্ষের ভেতরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন উপজেলা ছাত্রলীগ কর্মী খালেদ আহমদ লিটু (২৩)।পরে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ ও সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে খালেদ আহমদ লিটু ছাত্রলীগ কর্মী নয় দাবি করের বলেন, “লিটু আসলে ছাত্রলীগের কর্মীই নয়। লিটু একজন অছাত্র এবং মোবাইল দোকানের সত্ত্বাধিকারী।
বিজ্ঞপ্তিতে তারা আরও উল্লেখ করেন, কারো গুলিতে নয় বরং অবৈধ অস্ত্র নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে অবাধে প্রবেশ ও অবৈধ অস্ত্রের ম্যাগাজিন লোড করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত নিজের গুলিতে নিজেই নিহত হয় লিটু।”এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় ওই রাতেই নিহত লিটুর বাবা ফয়জুর রহমান বাদী হয়ে পাভেল গ্রুপের সমর্থিত ছাত্রলীগ কর্মী ফাহাদ আমহদসহ মোট সাতজনকে আসামি বিয়ানীবাজার থানায় মামলা করেন। এই মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করলেও বাকিরা পলাতক রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিয়ানীবাজার থানার ওসি চন্দন কুমার চক্রবর্তী।একের পর এক এসব প্রাণহানির ঘটনায় মামলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে না আসামিরা। আবার কদাচিৎ ধরা পড়লেও কিছুদিন পরই জামিনে বেরিয়ে যায়। এসব মামলার কার্যক্রমও স্থিমিত হয়ে পড়ে।
এব্যাপারে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্রলীগ কর্মী খুনখারাপির সাথে জড়িত থাকার কথা নয়। কিন্তু যারা ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে এসব করছে আমরা তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করি। প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, এসব ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে যেন এমন শাস্তি দেওয়া হয় যাতে ভবিষ্যতে এধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।এব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) জেদান আল মুসা সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অপরাধী যে হোক তাকে আইনের আওতায় আনা পুলিশের কাজ। এসব বিষয়ে মহানগর পুলিশ আগেও তৎপর ছিলো, এখনো তৎপর আছে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে আসামীরা পলাতক থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করতে বিলম্ব হয়।