বার্তা ডেকাঃঃ‘আমার বাবা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি সুন্দর করে পরিচালনা করায় সরকার পুরস্কার দিছিল। মৎস্যজীবী বাবারে জবাই করছে এমপির লোকেরা। মামলা দিতে থানায় গিছিলাম আমরা। পুলিশ এমপির পক্ষ ধইরা শাসাইছে। তারা হুমকি দিছিল ধইরা জবাই করব, বাবারে জবাই করলও। এইটা তো মগের মুল্লুকের চাইতে বড় কিছু। এমপির মগের মুল্লুকের বিচার চাই, কিন্তু বাঁচমু কেমনে?’

মাইক্রোফোন হাতে কথা বলতে গিয়ে এ প্রশ্ন রেখেই বাকরুদ্ধ চন্দন বর্মণ (৩২)। আর কোনো কথা না বলে শুধু কান্নায় বুক ভাসালেন। মাইকে অস্ফুট কান্নার আওয়াজে ভারী হয়ে পড়ে আশপাশ। তাঁর পাশে দাঁড়ানো সবাই তখন নীরবে চোখের জল মুছে সমবেদনা প্রকাশ করেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ‘জলমহালে মগের মুল্লুকে সংক্ষুব্ধ নাগরিক বন্ধন’ শীর্ষক কর্মসূচিতে একাত্ম হয়ে চন্দন বর্মণ এভাবেই কেঁদে কেঁদে তাঁর মৎস্যজীবী বাবা শ্যামাচরণ বর্মণ (৬২) হত্যার বিচার দাবি করেন। সংক্ষুব্ধ নাগরিক বন্ধনের কর্মসূচির আয়োজন করে সিলেটের একটি নাগরিক মোর্চা ‘সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন’। চলতি বছরের মাছ ধরার মৌসুমকে সামনে রেখে মৎস্যজীবী সমিতির সদস্যদের বসবাস ও অন্যান্য কাজের জন্য জলমহালের পাড়ে খলাঘরসহ পাঁচটি ঘর নির্মাণ করা হয়। এই সময় সাংসদ মোয়াজ্জেম ও তাঁর ভাইয়েরা আট আনা ভাগ চান। তা না মানায় ৭ জানুয়ারি রাতে জলমহালে হামলা করে শ্যামাচরণকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

কর্মসূচির শুরুতে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০০৪ সালে সিলেটে জঙ্গি-সন্ত্রাসের ধারাবাহিক কয়েকটি ঘটনায় কোনো সামাজিক প্রতিবাদ না জানানোয় ‘সংক্ষুব্ধ নাগরিক বন্ধন’ গঠন করে প্রথম প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করা হয়। এরপর থেকে গত দেড় দশকে শতাধিক কর্মসূচি পালন হয়। ৭ জানুয়ারি সুনুই জলমহালে মৎস্যজীবী শ্যামাচরণ বর্মণকে বর্বর কায়দায় হত্যার ঘটনায় কোনো প্রতিবাদ না জানানোয় সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন তাদের ধারাবাহিক কর্মসূচি হিসেবে আজকের কর্মসূচি পালন করছে।

বিকেলে চারটার দিকে অনুষ্ঠিত এই ‘নাগরিক বন্ধনে’ সভাপতিত্ব করেন সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ বর্মণ রানা। এতে একাত্মতা প্রকাশ করে অংশ নেন নিহত শ্যামাচরণের ছেলে চন্দন বর্মণ ও ভাই মনীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ। পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁরা বলেন, সুনই জলমহালটি ছয় বছরের জন্য ইজারা পায় সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড। সমিতির সভাপতি চন্দন বর্মণ যথারীতি জলমহালটির খাজনা পরিশোধ করেন। চলতি বছরের মাছ ধরার মৌসুমকে সামনে রেখে তিনি তাঁদের সমিতির সদস্যদের বসবাস ও অন্যান্য কাজের জন্য জলমহালের পাড়ে খলাঘরসহ পাঁচটি ঘর নির্মাণ করেন। এই সময় সাংসদ মোয়াজ্জেম ও তাঁর ভাইয়েরা আট আনা ভাগ চান। তা না মানায় জবাই করে ফেলার হুমকি দেন। এরপর ৭ জানুয়ারি রাতে জলমহালে হামলা করে শ্যামাচরণকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনার পর থানায় মামলা দিতে গেলে স্থানীয় সাংসদ ও তাঁর ভাইদের নাম দেখে পুলিশ অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা নেয়। শ্যামাচরণের পরিবার ঘটনার এক সপ্তাহ পর ১৪ জানুয়ারি আদালতে লিখিত অভিযোগ করেন। এতে সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে রতনসহ ৬৩ জনকে আসামি করে আদালতে মামলার আবেদন করা হয়েছে। মামলার আবেদনে সাংসদের ছোট ভাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন ওরফে রোকন ও তাঁর বড় ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মোবারক হোসেন ওরফে মাসুদকে আসামি করা হয়।

হত্যার হুমকি দেওয়ায় আমরা মৎস্যজীবীদের নিয়ে স্থানীয় থানা-পুলিশকে জানিয়েছিলেন। ঢাকায় গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো নিরাপত্তা পাইনি। হত্যার পর থানা-পুলিশ মামলা না নেওয়ায় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি। এরপরও পুলিশ তদন্ত তো দূরের কথা উল্টো হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।

মনীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ, নিহত শ্যামাচরণের ভাই

নিহত শ্যামাচরণের ভাই মনীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ বলেন, একই ঘটনায় থানায় একটি মামলা চলমান থাকায় থানা থেকে আদালতে প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আদালতে দাখিল করা মামলাটি স্থগিত এবং থানা থেকে প্রতিবেদন আসার পর এ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মে আদেশ দেন আদালত। এই সময়ের মধ্যে তাঁরা অসহায়বোধ করেছেন। মনীন্দ্র অভিযোগ করে বলেন,হত্যার হুমকি দেওয়ায় তাঁরা মৎস্যজীবীদের নিয়ে স্থানীয় থানা-পুলিশকে জানিয়েছিলেন। ঢাকায় গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো নিরাপত্তা পাননি। হত্যার পর থানা-পুলিশ মামলা না নেওয়ায় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। এরপরও পুলিশ তদন্ত তো দূরের কথা উল্টো হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।

প্রকৃত মৎস্যজীবীরা যদি জলমহালে মাছ ধরার অধিকার না পান, হত্যার শিকার হয়ে বিচার না পান, তাহলে সেটা তো মগের মুল্লুক। এই মগের মুল্লুকের মূলোৎপাটন চাই আমরা। নিরীহ মৎস্যজীবী শ্যামাচরণ বর্মণ হত্যা ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই।

আবদুল করিম চৌধুরী, সমন্বয়ক, সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন

কর্মসূচিতে সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘ক্ষমতার দাপটে বর্বর ঘটনা ঘটেছে সুনুই জলমহালে। সেখানে যে মৎস্যজীবীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে, তিনি ২০১৮ সালে জলমহাল পরিচালনায় শ্রেষ্ঠ মৎস্যজীবী সরকারি পুরস্কার পেয়েছেন। প্রকৃত মৎস্যজীবীরা যদি জলমহালে মাছ ধরার অধিকার না পান, হত্যার শিকার হয়ে বিচার না পান, তাহলে সেটা তো মগের মুল্লুক। এই মগের মুল্লুকের মূলোৎপাটন চাই আমরা। নিরীহ মৎস্যজীবী শ্যামাচরণ বর্মণ হত্যা ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই।’

প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী চলা নাগরিক বন্ধনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সিলেট মহানগরের সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় ধর, সাংস্কৃতিক সংগঠক মিশফাক আহমদ চৌধুরী, এনামুল মুনীর, সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছামির মাহমুদ, টেলিভিশন সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ইমজা’ সাধারণ সম্পাদক সজল ছত্রী, নাগরিক মোর্চা দুষ্কাল প্রতিরোধ আন্দোলনের সংগঠক দেবাশীষ দেবু প্রমুখ।

সংক্ষুব্ধ নাগরিক বন্ধন থেকে সুনই জলমহাল তীরে মৎস্যজীবীদের বসতি এলাকায় নাগরিক কমিটির একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিন পরিদর্শনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এই প্রতিনিধিদলে মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক অধিকারকর্মী, গণমাধ্যমকর্মীসহ সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের একাত্ম করা হবে। এই পরিদর্শনকালের আগেই সাংসদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া ও হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করা হয়।-প্রথম আলো

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn