সিলেটে সেরা আয়োজন ছিল ১৪ কোটি টাকার ‘বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব’
মো. এনামুল কবীর :: সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ সিলেটের বিভিন্ন সামাজি সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে প্রায় সারা বছরই জমজমাট ছিলো সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। তবে বছরের শুরুর দিকে (ফেব্রæয়ারি) বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঙ্গনের শিল্পীদের নিয়ে আয়োজিত ১০ দিনের বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসবে রীতিমতো বুঁধ হয়েছিলেন সিলেটবাসী। ২২ ফেব্রæয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত নগরীর মাছিমপুরস্ত আবুল মাল আব্দুল মুহিত ক্রিড়াকমপ্লেক্সটি হাজার হাজার সংস্কৃতিপ্রেমির পদচারণায় মুখরিত ছিলো। ভারতের বিখ্যাত শিল্পী হৈমন্তি শুক্লা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের আব্দুল কুদ্দুস বয়াতি, সুবির নন্দি, কৃঞ্চকলিসহ নামিদামী তারকাদের পরিবেশনায় পুরো ১০টা দিন সত্যিকারের উৎসবেই মেতে ছিলেন সিলেটের সংস্কৃতিসেবীরা। আয়োজকরা জানিয়েছিলেন এর আগে দেশের কোথাও এত বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়নি। অবশ্য আয়োজক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের একটি বেফাঁস মন্তব্যকে কেন্দ্র করে পুরো আয়োজনের সফল সমাপ্তি ঝুঁকির মুখে পড়লেও, পরে বিবৃতির মাধ্যমে ও মঞ্চে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনার সুবাদে শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছিলো বিশাল এই সংস্কৃতি উৎসব।
উৎসব উপলক্ষে পুরো কমপ্লেক্সকে সিলেটের গুণী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নামানুসারে নানা ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। পুরো উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছিল জ্ঞানতাপস জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে। সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চ ও হাছন রাজা মঞ্চে মুল আয়োজনের পাশাপাশি শাহ আব্দুল করিম চত্বর, রাধারমণ দত্ত বেদী, গুরুসদয় দত্ত চত্বর ও কুশিয়ারা কলোনেড এর মধ্যেও ছিল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা আয়োজন। মূল উৎসব শুরু হয় ২২ ফেব্রæয়ারি বিকেলে। এদিন প্রদর্শিন হয় চলচ্চিত্র ‘বর্ন টুগেদার’, ‘টেলিভিশন’ ও ‘গেরিলা’। মূল মঞ্চের নামকরণ করা হয়েছিল হাছন রাজার নামে ‘হাছন রাজা মঞ্চ’। এ মঞ্চে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ছিল মণিপুরি নৃত্য, দেশের গান, অদিতি মহসিনের কন্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং ‘জলের গানে’র পরিবেশনা। রাত আটটায় উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখ। দ্বিতীয় দিন (২৩ ফেব্রুয়ারি) প্রদর্শন হয় চলচ্চিত্র ‘মেঘমল্লার’ও মঞ্চনাটক ‘কহে বীরাঙ্গণা’, বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের পরিবেশনায় তবলা, ভবন বাউলের কন্ঠে লোকগান, ভারতের মনোময় ভট্টাচার্যের কন্ঠে নজরুল সঙ্গীত, চন্দনা ও শতাব্দী রায়ের পরিবেশনায় লোকগান।
তৃতীয় দিন (২৪ ২৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা ৩০ থেকে ছিল কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলন। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ছিল বর্নালী চট্টোপাধ্যায় (রাগাশ্রিত সঙ্গীত), সুবীর নন্দী, ঝুমা খন্দকার, গানের দল ও কৃষ্ণকলির পরিবেশনা। চতুর্থ দিন (২৫ ফেব্রুয়ারি) সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চে সকাল ১০টা ৩০ থেকে ছিল কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ছিল গম্ভীরা (আতাউর রহমান মিন্টু ও তাঁর দল), ইফফাত আরা দেওয়ান, খায়রুল আনাম শাকিল, লাবিক কামাল গৌরব, নবনিতা চৌধুরী ও বেবী দেওয়ানের পরিবেশনা। পঞ্চম দিন (২৬ ফেব্রুয়ারি), সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চে সকাল ১০টা ৩০ থেকে ছিল কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ছিল নৃত্যনাট্য দ্রোহকাল, রাজরূপা চৌধুরীর সরোদ, লাইসা আহমেদ লিসা ও কুদ্দুস বয়াতীর পরিবেশনা। ষষ্ঠ দিন (২৭ ফেব্রুয়ারি) সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চে প্রদর্শন হয় ‘চলচ্চিত্র অজ্ঞাতনামা’, ‘জালালের গল্প’ও ‘আয়নাবাজী’। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ছিল রামকৃষ্ণ সরকার ও তার দলের পরিবেশনায় ধামাইল, ঝুমুর সঙ্গীত, শিল্পী সুষমা দাসের লোকসঙ্গীত, মো. শামীম আহমদ ও বাউল সূর্য্যলাল দাসের পরিবেশনায় আঞ্চলিক গান । সপ্তম দিন (২৮ ফেব্রুয়ারি) সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চে বিকাল ৪টা, সন্ধ্যা ৬টা ও রাত ৮টায় প্রদর্শন হয় চলচ্চিত্র ‘দিপু নাম্বার টু’, ‘আন্ডার কন্সট্রাকশন’ ও ‘অনিল বাগচীর একদিন’। হাছন রাজা মঞ্চে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ছিল মনিরুজ্জামানের বাঁশি, শারমিন সাথী ইসলাম ও বিজন চন্দ্র মিষ্টির ভজন ও কীর্তন, শামা রহমান এবং শ্রীকান্ত আচার্যের পরিবেশনা। অষ্টম দিন (১ মার্চ) সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চে প্রদর্শন হয় চলচ্চিত্র ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘রানওয়ে’ এবং ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। হাছন রাজা মঞ্চে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পরিবেশিত হয় মণিপুরি নৃত্য, প্রিয়াঙ্কা গোপ’র রাগাশ্রিত সঙ্গীত, বুলবুল ইসলামের কন্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত। নবম দিন (২ মার্চ) প্রদর্শন হয় চলচ্চিত্র ‘রিনা ব্রাউন’ ও লোকনাট্যদলের নাটক ‘কঞ্জুস’, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ সিলেটের শিশুদের দলবদ্ধ পরিবেশনা, শিশুতীর্থের পরিবেশনায় পরিবেশিত হয় গীতিনাট্য, রাকিবা ইসলাম ঐশী, ভাওয়াইয়া, ফেরদৌস আরা, শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা ও পার্বতী বাউলের পরিবেশনা। দশম দিন (৩ মার্চ) প্রদর্শন হয় চলচ্চিত্র ‘ঘাসফুল’, সুবচনের মঞ্চ নাটক ‘মহাজনের নাও’, গীতবিতানের শিশুদের পরিবেশনায় সঙ্গীত ও কবিতায় ঋতুরঙ্গ, অনিন্দিতা চৌধুরীর নজরুল সঙ্গীত, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও বাউল শফি মন্ডলের পরিবেশনা।
কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, সমরেশ মজুমদার, শাঁওলি মিত্রসহ ভারতের ২৩ জন প্রাবন্ধিক, কবি ও সাহিত্যিক এবং নেপালের ২ জন বিশিষ্ট লেখকসহ দেশের হাসান আজিজুল হক, ইমদাদুল হক মিলন, শাহীন আখতার ও হরিশংকর জলদাস, প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সনৎকুমার সাহা, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও শামসুজ্জামান খান, আনিসুল হক, রুবি রহমান, রবিউল হুসাইন, তারেক সুজাতসহ বাংলাদেশের মোট ৫০ জন কবি এবং লেখক। এছাড়াও শাহ আবদুল করিম চত্ত্বরে প্রদর্শিত হবে সঙ্গীত যন্ত্র ও সিলেটের লোকগানের প্রদর্শনী, কুশিয়ারা কলোনেডে স্থাপত্য প্রদর্শনী, গুরুসদয় দত্ত চত্বরে থাকবে হস্ত ও কুটির শিল্প এবং বেঙ্গল প্যাভিলিয়ন। উৎসবের রাধারমণ দত্ত বেদীতে বসছে চিত্রশিল্পীদের আর্ট ক্যাম্প। বিশিষ্ট চিত্রকর রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, শহিদ কবির, রোকেয়া সুলতানা, জামাল আহমেদ, শিশির ভট্টাচার্য্য, তৈয়বা লিপিসহ ২৭ জন শিল্পী উৎসব চলাকালীন ‘সুবীর চৌধুরী আর্ট ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করবেন। উৎসবের তৃতীয় দিন কৃঞ্চকলি ইসলাম কন্ঠের জাদুতে মাতিয়ে তুলেছিলেন হাজার হাজার ভক্তকে। তারা যখন ‘অইতো’ ‘অইতো’ বলে আরও বেশি গানের দাবি করছিলেন, তখন হঠাৎ ক্ষেপে উঠেন আয়োজক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু। হঠাৎ তিনি মঞ্চে উঠে ‘সিলেটের ব্যাপারে আমরা ইন্টারেস্টেড না’, ‘আমি কাউকে ভয় পাইনা’, ‘আমরা চলে যাবো’ ইত্যাদি বলে বেশ সমালোচিত হন।
এ প্রতিবেদক তখন একটি অনলাইন সংবাদপত্রের জন্য রিপোর্ট করতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে রাতেই একটি প্রতিবেদন জনপ্রিয় ঐ অনলাইন সংবাদপত্রে আপলোড হলে ক্ষেপে উঠেন সিলেটের হাজার হাজার সংস্কৃতিকর্মি ও সচেতন দর্শক। পরের সারাদিন চলে বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদ ও ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান। এরপর দিন উৎসব বয়কট এবং সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন কর্মসূচির আহ্বান করেন কয়েকটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। বিষয়টি বেঙ্গল কর্তৃপক্ষের কানে যায়। তারা দ্রæত ক্ষমা প্রার্থনা করে ঐ অনলাইন সংবাদপত্রে একটি সংবাদ বিজ্ঞপিত পাঠান। উৎসবের ষষ্টদিন রাতে মঞ্চে উঠে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন আবুল খায়ের লিটু। পরিস্থিতি আস্তে আস্তে শান্ত হয়। ভালোয় ভালোয় শেষ হয় ১৪ কোটি টাকা বাজেটের বিশাল এই সাংস্কৃতিক উৎসব।