ফাইল ছবি
ওয়েছ খছরু::করোনায় বিপর্যস্ত বৃটেন। আক্রান্ত ও মৃত্যুতে ভয় আর আতঙ্ক চারপাশে। এ অবস্থায় জরুরি প্রয়োজনে, প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে বৃটেনে অনেক প্রবাসী দেশে আসছেন। বাধ্যবাধকতার জন্য তারা সঙ্গে নিয়ে আসছেন করোনার নেগেটিভ সনদ। সনদ থাকলেও চারদিন কোয়ারেন্টিনে থেকে করোনা পরীক্ষা করানোর পর হোম কোয়ারেন্টিনের শর্তে বাড়ি ফিরছেন তারা। পরিস্থিতির কারণে এমন বাধ্যবাধকতার শর্ত মেনে নিচ্ছেন তারা। কিন্তু সর্বশেষ বৃহস্পতিবার একটি ফ্লাইটে আসা ২৮ যাত্রীর করোনা পরীক্ষার ফল ঘিরে রীতিমতো হুলস্থূল কাণ্ড বেধেছে। একটি বেসরকারি ল্যাবে ১৫৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
তাদের মধ্যে ২৮ জনের পজেটিভ আসে। শনাক্তদের সবাইকে সিলেটের ৩১ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারে নেয়া হয়। এর একদিন পর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে তাদের ২৫ জনের করোনা নেগেটিভ আসে। এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সরকারি ল্যাব থাকতে বেসরকারি ল্যাবে কেন প্রবাসীদের করোনা পরীক্ষা করা হলো। একসঙ্গে এতো মানুষের পজেটিভ আসার পর কেন তা যাচাই না করেই ঘোষণা দেয়া হলো এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এছাড়া ভুক্তভোগী প্রবাসীরা বলছেন, করোনা সনদ নিয়ে আসার পরও আবার পজেটিভ হওয়ায় তাদের পরিবার সীমাহীন দুশ্চিন্তায় পড়েছে। এছাড়া হঠাৎ করে হাসপাতালে নেয়ায় অনেকে ভেঙে পড়েছেন। অনেকে হাসপাতালের পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকে বলছেন, মহামারির এই সময়ে প্রবাসীদের জন্য বাড়তি সতর্কতার ব্যবস্থা না করে তাদের সঙ্গে বরং তামাশাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে।
এদিকে প্রথম পরীক্ষা করা বেসরকারি সংস্থা সীমান্তীকের ল্যাবের ত্রুটি আছে কিনা- তাও খতিয়ে দেখছে আইইডিসিআর। এদিকে সিলেটের ৩১ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রবাসীরা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আইসোলেশনে থাকতে হচ্ছে বলে দাবি তাদের। এতে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ওই সেন্টারে থাকা বৃটেন ফেরত প্রবাসীরা। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে লন্ডন থেকে সিলেটে আসেন ১৫৭ জন প্রবাসী। নিয়ম অনুযায়ী চারদিনের কোয়ারেন্টিন শেষে রোববার তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষায় দেয়া হয়।
সিলেটে বেসরকারি সংস্থা সীমান্তীকের পিসিআর ল্যাবের পরীক্ষায় গত মঙ্গলবার ২৮ জন প্রবাসীর রিপোর্ট আসে পজেটিভ। ফলে তাদের নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীরা দাবি করেন- তাদের মধ্যে কোনো উপসর্গ নেই। এমনকি কারো তাপমাত্রা বেশি নয়। এছাড়া- সিলেটে আসার আগের দিন তারা সবাই করোনার নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা প্রবাসীদের এসব কথা কর্ণপাত করেননি। তারা পজেটিভ হওয়া ২৮ জনকে পাঠিয়ে দেন আইসোলেশন সেন্টার শহরতলীর খাদিমপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তারা জানান- পজেটিভ হওয়া অনেক প্রবাসী নিজেদের অর্থায়নে হাসপাতালে আইসোলেশনের যাওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের সে প্রস্তাবও নাকচ করে দেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যুক্তি হচ্ছে- নিয়ম অনুযায়ী পজেটিভ হওয়া প্রবাসীদেরও সরকারি আইসোলেশনে থাকতে হবে। সুতরাং ব্যক্তিগত পছন্দে হাসপাতালে আইসোলেশনের কোনো সুযোগ নেই। তবে প্রবাসীদের দাবির প্রেক্ষিতে বিভ্রান্তি কাটাতে গত মঙ্গলবার পজেটিভ হওয়া ২৮ জনের নমুনা ফের সংগ্রহ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিসিআর ল্যাবে পাঠানো হয়। রাতে ওই পরীক্ষা রিপোর্ট দেখে আবারো চমকে উঠেন সবাই। পজেটিভ ২৮ জনের মধ্যে ২৫ জন বৃটেন প্রবাসীর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।
কেবলমাত্র তিনজনের রিপোর্ট এসেছে পজেটিভ। এই রিপোর্ট জানার পর আরো বিভ্রান্তিতে পড়ে সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। দুই পিসিআর ল্যাবে দুই ধরনের করোনা রিপোর্টে সন্দিহান হন তারা। এই অবস্থায় গত মঙ্গলবার বিকালে সিলেটে আসেন ঢাকার আইইডিসিআরের ৭ সদস্যর টিম। তারা এসে সন্ধ্যায় খাদিমপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। সেখানে প্রবাসীদের সঙ্গে কথাও বলেন। এ সময় তারা বিভ্রান্তি কাটাতে নতুন করে আবারো আইসোলেশনে থাকা ২৮ জন প্রবাসীর নমুনা সংগ্রহ করেন। একই সঙ্গে তারা বেসরকারি সংস্থা সীমান্তীকের ল্যাবও পরিদর্শন করেছেন। ওই ল্যাবে সাধারণত প্রবাসীদের করোনা পরীক্ষা করানো হয়। ফলে পিসিআর ল্যাবে কোনো সমস্যা রয়েছে কিনা- সেটিও খতিয়ে দেখা হয়। তবে এ ব্যাপারে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আইইডিসিআরের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছুই জানানো হয়নি।
সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে- আইইডিসিআর থেকে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এসে যে নমুনা সংগ্রহ করে গেছেন সেটি ঢাকার ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় ওই ল্যাবের পরীক্ষার রিপোর্ট আসার কথা ছিল। কিন্তু রাত ৮টা পর্যন্ত সিলেটে ল্যাব রিপোর্ট এসে পৌঁছেনি। ফলে আইসোলেশনে থাকা প্রবাসীদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। তারা এখনো সিলেটের খাদিমপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আইসোলেশনে রয়েছেন। স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান গতকাল বিকালে জানিয়েছেন, ‘আইইডিসিআরের রিপোর্ট ও তাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আমরা রয়েছি।
প্রবাসীদের ব্যাপারে তারা যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটি ফলো করা হবে। তবে সিলেটে দ্বিতীয় দফা পরীক্ষায় রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও তারা এখনো আইসোলেশনে রয়েছেন।’ তিনি জানান- ‘করোনা আক্রান্ত প্রবাসীরা বৃটেনে চলমান করোনার নতুন স্ট্রেইনে আক্রান্ত কিনা- সেটিও খতিয়ে দেখছে আইইডিসিআর। সংগ্রহ করা নমুনা থেকেই এ তথ্য জানা যাবে।’ সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছেন, প্রবাসীদের করোনা রিপোর্ট নিয়ে গতকাল স্বাস্থ্য বিভাগের উচ্চপর্যায়ের একটি জুম বৈঠকে সেটি আলোচিত হয়। এই আলোচনায় সিলেটের কর্মকর্তারা প্রবাসীদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন। বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিবসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সিলেটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার বিমানের ওঠার আগে তারা বৃটেনে যে পরীক্ষা করিয়েছিলেন সেখানে রিপোর্ট নেগেটিভ আসার কারণেই তাদের বিমানে ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হয়। এরপর দেশে আসার চার দিনের মাথায় তাদের রিপোর্ট আবার পজেটিভ। এর একদিন পরের রিপোর্টে আবার ২৫ জনের নেগেটিভ। বৈঠকে এসব বিষয় আলোচনার পর আইইডিসিআরের ল্যাবের পুনঃপরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করার কথা বলা হয়। যদি তৃতীয় দফা রিপোর্টে করোনা নেগেটিভ আসে তাহলে প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টিনে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে। তবে- গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তাই এসব তথ্য আনুষ্ঠানিক স্বীকার করেননি।
তারা বিষয়টি নিয়ে অপেক্ষা করতে সবাইকে পরামর্শ দেন। জানান, আইইডিসিআর সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছবে। এদিকে সিলেটে আইসোলেশনে থাকা বৃটেন ফেরত যাত্রীদের ভোগান্তির অন্ত নেই। বৃটেন থেকে সিলেট ফেরার পর হোটেলে তারা কিছুটা স্বস্তিতে ছিলেন। কিন্তু করোনা পজেটিভ আসার পর তাদের মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে। ওই যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই বয়স্ক, শিশুও রয়েছে। ফলে সরকারি আইসোলেশনে অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় তারা চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন।
আইসোলেশনে থাকা কয়েকজন প্রবাসী জানিয়েছেন, সিলেটের আইসোলেশন সেন্টারে দমবন্ধ অবস্থা। টয়লেট ময়লা আবর্জনায় ভর্তি। এছাড়া সেন্টারের পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। তাদের খাওয়া-দাওয়াসহ বসবাসে অসুবিধা হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে প্রবাসীরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে বলে জানান তারা। সিলেটের খাদিমপাড়া হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারের এই দুর্দশা থেকে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিডিও বার্তায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সিলেটের কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি ডা. জিয়া উদ্দিন আহমদ। তিনি জানিয়েছেন, করোনার কঠিন সময়ে কিডনি ফাউন্ডেশন ও প্রবাসীদের অর্থায়নে ওই হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য তারা প্রস্তুত করা হয়েছিল। তারা সিলিন্ডার অক্সিজেনেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে চিকিৎসা নিয়ে অনেক রোগী সুস্থ হয়েছেন। এরপর রোগী কমে যাওয়ায় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ছিল। এখন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রবাসীদের আইসোলেশনে থাকার খবরে তিনি বিস্মিত হয়েছেন। এ ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ নিতে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।মানবজমিন
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৬০ বার